প্রাথমিকে প্রয়োজন কাঠামোগত পরিবর্তন - দৈনিকশিক্ষা

প্রাথমিকে প্রয়োজন কাঠামোগত পরিবর্তন

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

শিক্ষা। মানবিক গুণসমৃদ্ধ যা কিছু অর্জন তাই আমার কাছে শিক্ষা। আর প্রাথমিক পর্যায়ে বা জীবনের শুরুতে যে শিক্ষা অর্জন করে তাই প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক পর্যায়ে বা জীবনের শুরুতে যে বিদ্যালয়ে বা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রী শিক্ষা অর্জন করে তাই প্রাতিষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা। একটা সময় ছিল এই প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পাড়ি দিতে হতো দীর্ঘপথ। তৎকালীন সময়ে যে কারণে শিক্ষার হার ছিল নগণ্য। বিদ্যালয়গামী ছাত্রছাত্রী ছিল সংখ্যায় কম। শিক্ষক ছিল অপ্রতুল। বই কিনতে হতো অর্থ দিয়ে লাইব্রেরি থেকে। ফলে দারিদ্র্যের কারণে ঝড়ে পরত অনেক শিক্ষার্থী। সবকিছু মিলিয়ে পড়ালেখার প্রতি মানুষের আগ্রহ ছিল কম।  বুধবার (১৮ মার্চ) দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়। 

উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, বর্তমান চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। এখন প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দুরত্বের মধ্যে। রয়েছে বিভিন্ন বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। শিক্ষক রয়েছে পর্যাপ্ত সংখ্যক। বই দেওয়া হচ্ছে সরকার থেকে বিনা মূল্যে। যার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে এখন বিদ্যালয়মুখী। তাছাড়া পড়ালেখার ব্যাপারে এখন অনেক পরিবারই সচেতন। সন্তানের পড়ালেখা করাতে অনেক পরিবারই দরিদ্রকে জয় করছে। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের প্রাথমিক থেকেই গুরুত্ব সহকারে তৈরি করছে। আমাদের সময় যে যত্নটার অভাব ছিল বর্তমান সময়ে সেই যত্নটা প্রাক-প্রাথমিক থেকেই পাচ্ছে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী। আর কেনই বা করবে না, একটি বাড়ির ভিত্তি যদি মজবুত না থাকে তাহলে সেই বাড়ি কিন্তু বেশিদূর পর্যন্ত উঁচু করা যাবে না। 

ঠিক তেমনি একটি সন্তানকে যদি শিক্ষা জীবনের শুরু থেকেই যত্ন না করা যায় তাহলে রত্ন হবে না। যেমন আপনি যদি শুরু থেকেই আপনার সন্তানের হাতের লেখা সুন্দর করতে জোর না দেন তাহলে পরবর্তীতে তার লেখার কাঠামো পরিবর্তন করাতে সম্ভব হবে বলে আমার মনে হয় না। আবার শিশুবেলা থেকেই যদি একজন শিক্ষার্থীকে বই রিডিং পড়ার ওপর জোর না দেয়া যায় তাহলে সে পরবর্তী শ্রেণীতে গিয়ে স্পষ্ট উচ্চারণ সহকারে পড়তে পারে না। তাই আমার কাছে মনে হয় প্রাথমিক শিক্ষাই শিক্ষার মূলভিত্তি।

তাই এই সময়ে অভিভাবকদের উচিত মানসম্মতভাবে গড়ে তোলা এবং গড়ে তুলতে মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেছে নেয়া ও সন্তানের যতœ নেয়া। আর সেই কারণে সরকার প্রাথমিক শিক্ষার ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। তারপরও কিছু অচেতন অভিভাবক আছে যারা সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে চান না বা শিক্ষার মর্মটা উপলব্ধি করেন না। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২০ বছরের প্রথম দিনে দেশের ৪ কোটি ২০ লাখেরও বেশি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মাঝে ৩৫,৩১,৪৪,৫৫৪টি বই বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য ১০ কোটি ৫৪ লাখ ২ হাজার ৩৭৫টি বই বিনা মূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে, যা প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে মাইলফলক।

বর্তমান সরকার শিক্ষাকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। তাই ২০১০ সাল থেকে বর্তমান সরকার বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করছে। এছাড়াও চালু রয়েছে বৃত্তিমূলক ব্যবস্থা। সরকারি শিক্ষকদের বেতন হয়েছে দ্বিগুণ। কিন্তু যত সুবিধা দিচ্ছে তার থেকে ভালোটা কম পাচ্ছে বলে আমার মনে হয়। শিক্ষার দিক থেকে যদি বলি তবে সবকিছুর মাঝেও দেখা যায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো কিছু ঘাটতি রয়েছে। দুর্বল শিক্ষার্থীদের উন্নতি করাতে তারা হিমশিম খাচ্ছে। আবার মেধাবী শিক্ষার্থীদেরও মানসম্মত উন্নতি করাতে পারছে না। আর কেজি স্কুলগুলো সেই সুযোগটা লুফে নিচ্ছে। তবে পূর্বের প্রাথমিকের কিছু চিত্র বর্তমানে অনেকাংশে কমেছে। পূর্বে যেমন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত ক্লাস হতো না। শিক্ষিকাদের ক্লাসে না গিয়ে মাঠে বসে রোদ পোহাতে দেখা যেত। শিক্ষকদের ক্লাস না করে ক্লাসচলাকালীন সময়ে বাজার করতে দেখা যেত। বর্তমানে তা বহুলাংশে কমেছে।

এখন যে বিষয়গুলো আমার কাছে ঘাটতি বলে মনে হয় তা হলো (১) এক ক্লাসে অধিক ছাত্রছাত্রী (২) শিক্ষার্থী অনুপাতে ক্লাসের সময়সীমা স্বল্প (৩) শিক্ষকদের যোগ্যতা আর সবচেয়ে বেশি যে বিষয় নিয়ে আমি চিন্তিত তা হলো (৪) পাঠ্যপুস্তক ও প্রশ্নকাঠামো। সরকার বইপ্রদানসহ বিভিন্ন সুযোগ দিলেও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো একটি ক্লাসে ছাত্রছাত্রী রয়েছে অধিক পরিমাণে। যার ফলে শিক্ষকরা যথাযথ ক্লাস নিতে পারছে না বলে আমার মনে হয়। পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার এয়ারপোর্ট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তথ্য থেকে জানতে পারি সেখানে একটি শ্রেণীতে সর্বোচ্চ ৮৬ জন ছাত্রছাত্রী রয়েছে। তার বিপরীতে ক্লাসের সময় ৫৫ মিনিট। একটি শিক্ষার্থীকে ১ মিনিট করে যদি পড়া ধরা হয় সেখানে সময় লাগবে ৮৬ মিনিট। এর সঙ্গে শিক্ষককে পড়াটা বোঝানোর একটা ব্যাপার থাকে।

লেখানো ও লেখা দেখার একটি বিষয় থাকে। কারণ অনেক অভিভাবকই বাড়িতে গেলে শ্রেণির কাজ দেখতে চায়। আসলে কীভাবে শিক্ষকরা পড়াটাকে বুঝিয়ে যাচাই-বাছাই করবে বা লেখাবে? আমার বোধগম্য হয় না। অভিভাবকদের আবেদন কিন্তু থাকে যে শিক্ষক প্রতিদিনের পড়া প্রতিদিন ধরবেন। আমার মনে হয় যদি শ্রেণীকে স্বল্প শিক্ষার্থী দিয়ে ভাগ করা যায় অথবা ক্লাসের সময় বাড়ানো যায় তবেই পড়াটা বা ক্লাসটা আরও কার্যকর হতো। স্বল্প সময়ে শিক্ষকরা বোঝাতে সক্ষম হচ্ছে না বলে বাধ্য হচ্ছেন প্রাইভেট পড়াতে। আর অভিভাবকরাও বাধ্য হচ্ছেন প্রাইভেটে দিতে।

এইবার আলোচনায় আসি যোগ্যতা নিয়ে। বর্তমানে পঞ্চম শ্রেণীর যে সিলেবাস বা প্রশ্নকাঠামো তাতে একটি দক্ষ ইংরেজি শিক্ষক প্রয়োজন। বিভিন্ন শিক্ষকদের মন্তব্য থেকে জানা যায় যে পঞ্চম শ্রেণির ইংরেজি বিষয়টি তুলনামূলক জেএসসি থেকে কঠিন। কিন্তু সেখানে অনেক শিক্ষিকা রয়েছে যারা এসএসসি পাস। ফলে আমার মনে হয় তাদের যোগ্যতার অনেক ঘাটতি রয়েছে। একসময় সৃজনশীল ছিল না বা পড়ালেখার কারিকুলাম এমন ছিল তা সেই সময়ের জন্য তারা উপযুক্ত ছিল। কিন্তু বর্তমান পেক্ষাপটে তাদের যোগ্যতা নিয়ে আমি চিন্তিত। ইংরেজি ও গণিতে ভালো করতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের নেয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। আর প্রাথমিকে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টা নিয়ে আমি চিন্তিত বা যে বিষয়টা আমি গত বছর ভাবলেও লিখতে পারি নাই তা হলো পাঠ্যপুস্তক ও প্রশ্নকাঠামো। গত বছর লিখি নাই এই ভেবে যে বইতো অনেক আগে থেকেই তৈরি হয়ে যায়। তবুও এবছর বিষয়টি তুলে ধরতে চাইছি কারণ এখনও প্রশ্নকাঠামো দেয়া হয় নাই বা আগামী ২০২১ সালের বই তৈরির কাজ হয়ত এখনো শুরু হয় নাই।

তৃতীয় শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত বিভিন্ন সাময়িক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বা প্রশ্নকাঠামোর দিকে তাকালে লক্ষ্য করা যায় সেখানে কিছু অংশ পাঠ্যপুস্তক বহির্ভূত। যদি বাংলার বিষয়ে বলি সেখানে রয়েছে বিরামচিহ্ন। অথচ বিরামচিহ্নের যে নিয়মটা রয়েছে কোথায় কি থাকলে কোন চিহ্ন হয় তা পাঠ্যপুস্তকে নাই। ফলে শিক্ষার্থীরা মুখস্ত করছে। ইংরেজির প্রায় অর্ধেকের বেশি অংশ থাকে পাঠ্যপুস্তক বহির্ভূত। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত কোন গ্রামার নাই অথচ পরীক্ষাতে আসছে ডব্লিউ এইচ প্রশ্ন। এটা করতে গেলে সাবজেক্ট, নাম্বার, ভার্ব, টেন্স জানা দরকর। এগুলো না পড়িয়ে রিয়ারেঞ্জ বা ডব্লিউ এইচ প্রশ্ন করলে “গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল” দেবার মতো পরিস্থিতি করা হয়।

তাছাড়া যেখানে টেন্স শেখানো হচ্ছে না সেখানে আনসিন প্যাসেজ দিলে কিভাবে লেখা সম্ভব? ধাপে ধাপে না শেখালে ভিত্তি কীভাবে মজবুত হবে? আমার মতে তৃতীয় শ্রেণী থেকে কিছু কিছু গ্রামার যোগ করা দরকার। তাছাড়া ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়তে গিয়ে শিক্ষার্থীদের হিমশিম খেতে হয়। এছাড়াও বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়, প্রাথমিক বিজ্ঞান ও ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্ন আসে কিন্তু কোন অধ্যায়ে সৃজনশীল প্রশ্নের নমুনা নাই। পূর্বে কেমন প্রশ্ন হবে তার নমুনা দেয়া হতো এখন কেন নেই? তাতে কি গাইড বিক্রেতাকে সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে না? নমুনা দিলে কি খুব ক্ষতি হতো? জানি জাতীয় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন কমিটি অতি দক্ষ ও মেধাবি তবুও আমার স্বল্প মেধায় একজন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে এই বিষয়গুলো আমার কাছে পরিবর্তন বা সংযোজন প্রয়োজন বলে মনে হয়েছে। সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে এবং যে সৃজনশীলতা নিয়ে জাতি গঠনে এগিয়ে চলছে তাতে পাঠ্যপুস্তক সংশ্লিষ্ট প্রশ্ন কাঠামো করলে উদ্দেশ্য বেগবান হবে। ফলাফল আরও সুন্দর হবে সর্বোপরি সৃজনশীলতা এগিয়ে যাবে বলে আমার মনে হয়। তাই পাঠ্যপুস্তক নয়ত প্রশ্নকাঠামো পরিবর্তনের জোর দাবি করছি। সেই সঙ্গে উপরোক্ত সমস্যাবলি আসলে সমস্যা কি না তা যাচাইয়ে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন কমিটি সর্বোপরি সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি।

লেখক : গোপাল অধিকারী, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0076198577880859