দোহাই লাগে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংকটের বারোটা বাজাবেন না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উচ্চ শিক্ষিত শিক্ষকের সমাহার। অধিকাংশ বিদ্যালয়ে পূর্বের তুলনায় শিশু শিক্ষার পরিবেশ বিদ্যমান। মাননীয় প্রতিমন্ত্রী ও সচিবের জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষকেরা নিয়মিত ও সময়মতো উপস্থিত থেকে কর্তব্যপরায়ণ হতে শুরু করেছে।
শিশু শিক্ষায় অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ না করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা আছে। সচিব মহোদয়ের one day one word কার্যক্রম শিশু শিক্ষায় এক বিষ্ময়কর সাফল্য দেখা দিচ্ছে। স্লিপে বছরে এক লাখ টাকা বরাদ্দ। নানা উদ্যোগে প্রাথমিক শিক্ষা আজ এগিয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতার দীর্ঘ সময়ের পর প্রাথমিক শিক্ষায় নতুন আলো দেখা যাচ্ছে। ঠিক সে সময়ে প্রাথমিকের বর্তমান ১ শিফটের বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংকটের করুণ দৃশ্য সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তা হৃদয়ের অনুভূতি দিয়ে উপলদ্ধি করার জন্য বাস্তবতা উপস্থাপন করছি।
কর্মকর্তা বিদেশ ঘুরে এসে আমাদের দেশের শিশুদের কর্মঘণ্টা বিদেশের মতো করতে আগ্রহী। তারা আমাদের দেশের সার্বিক পরিবেশ নিয়ে ভাবেন বলে মনে হয় না। উন্নত দেশে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, বিনোদনসহ বিদ্যালয়ই শিক্ষাদানের সবকিছু করে থাকে। অথচ আমাদের দেশে শুধু বিরামহীন পড়া আর পড়া, নেই কোনো খেলা, বিনোদন। সে শিক্ষা কোনো কার্যকর শিক্ষা নয়।
এক শিফটের বিদ্যালয়ের করুণ শিক্ষার্থী সংকট ঢাকা শহরের বিদ্যালয়গুলি সরেজমিনে পরিদর্শন করলে উপলব্ধি হবে। কিন্ডার গার্টেন ও উচ্চ বিদ্যালয়ের কর্মঘণ্টার মাঝে প্রাথমিকের কর্মঘণ্টার বিশাল ব্যবধান। সে কারণে ৭ টা হতে ২ টা ৪৫ সময়সূচির কারণে স্বচ্ছল অভিভাবক ও গরিব মানুষের সন্তানরাও পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধাকে উপেক্ষা করে এক শিফটের বিদ্যালয়ে ভর্তি করে না।
শিক্ষার্থী কম ‘যত দোষ নন্দ ঘোষে’র মতো শিক্ষকদের ওপর নেমে আসে যন্ত্রণা। তৃণমূল থেকে উপর মহল পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে কারো ভাবনা আছে বলে দৃশ্যমান নয়। সকলে যেন তেলে তেলে সময় পার করছে। শিশু শিক্ষায় আর বেশি বেশি তেল নয়। আগামী প্রজন্ম ক্ষতিগ্রস্থ হবে এ তেল প্রয়োগ বন্ধ করুন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে সকাল বেলা আরবি পড়া, বিকেল বেলা খেলাধুলা করার পর্যাপ্ত সময় রেখে সকল শিশুর জন্য অভিন্ন কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ শিশু শিক্ষায় বৈষম্য দূর করার জন্য সর্বস্তরের আন্দোলন চালিয়ে আসছে। সে লক্ষ্যে ২১ মার্চ ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দ জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অভিন্ন (কর্মঘণ্টা ও পাঠ্যবই) দাবিতে মানববন্ধন করেন। মানববন্ধন শেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমীপে স্মারকলিপি প্রদান করেন।
কিন্ডার গার্টেন ও প্রাথমিকের কর্মঘণ্টা ও পাঠ্যবইয়ের বিশাল ব্যবধান। অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের পারিবারিক কাজে সহযোগিতা, সকালে আরবি পড়া ও বিকেলে খেলাধুলা বা একটু বিশ্রামের সুযোগের প্রতি গুরুত্ব দেন। তারা প্রাথমিকের ১ শিফটের স্কুলে অমানবিক সময়সূচি মেনে নিতে পারে না। দেশের শিক্ষিত অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের শিশুকালেই সব কিছু শিখিয়ে মহাজান্তা বানাতে চায়। তাদের ধারণা কিন্ডার গার্টেন স্কুলে বেশি বই পড়ে শিশু মহাপণ্ডিত হবে। তাদের বহির্বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই।
তারা বেশি বইয়ের সাথে সাথে পরীক্ষা পাগলও। কতটুকু জ্ঞান অর্জন হলো তাদের কাছে মুখ্য নয়। কত বেশি নম্বর পেয়েছে তা মুখ্য।
পরীক্ষার ফলের আনন্দে আজ ভাসছে দেশ। অভিন্ন (কর্মঘণ্টা, বই ও মূল্যায়ন) ব্যবস্থা ব্যতিরেকে প্রাথমিকে শিক্ষার্থী সংকট চরমে নেমে আসবে। বিগত বিএনপি সরকারের আমলে ১ শিফটের স্কুল চালু করে শহরাঞ্চলের বিশেষ করে ঢাকা শহরে শিক্ষার্থী সংকটে আজ অস্তিত্ব বিলীন হচ্ছে। শিক্ষার্থী সংকটে বহু স্কুল একীভূত করেও শিক্ষার্থী বাড়েনি, বরং কমেছে।
এদিকে, প্রাথমিকে ১ শিফটের যন্ত্রণাময় সময়সূচি প্রবর্তন না করে সব শিশুর জন্য শিশুবান্ধব, অভিন্ন (কর্মঘণ্টা, বই ও মূল্যায়ন) পদ্ধতি চালু করা অতীব জরুরি। এর মাধ্যমে শিশু শিক্ষায় বৈষম্য, আনন্দময় শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংকট দূর হবে। বঙ্গবন্ধু ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের সুফল দেশবাসী জানতে পারবে এবং ভোগ করবে।
একগুয়েমি ও তেল দেয়ার মানসিকতা পরিবর্তন করে সকলে বিষয়টি নিয়ে ভাববেন এবং কার্যকর ব্যবস্থা নেবেন। শিশু শিক্ষায় বৈষম্য দূর হোক। এ প্রত্যাশায়।
লেখক: আহ্বায়ক, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ এবং প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম; সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিক শিক্ষা।