প্রাথমিকের সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়ে ভাবনা - দৈনিকশিক্ষা

প্রাথমিকের সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়ে ভাবনা

মো. সিদ্দিকুর রহমান |

প্রাথমিকের সহকারী প্রধান শিক্ষক পদ নিয়ে বর্তমান সরকারের ভাবনা নিয়ে নানা জনের নানা মত লক্ষ্ করা যাচ্ছে। বেশিরভাগ সহকারী শিক্ষক এ পদায়নকে বেতন বৈষম্য দূরীকরণের ষড়যন্ত্র হিসেবে মনে করে। এ প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট এরশাদ আমলের কিছু স্মৃতি উল্লেখ করছি। সে আমলে ওসমানী উদ্যান, পাকশী ব্রীজ সংলগ্ন পদ্মা নদীর তীরে ও বিজয় সরণীতে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি প্রেসিডেন্ট এরশাদকে প্রধান অতিথি করে ৩টি মহাসমাবেশ করলেন। সারাদেশে ভয়ঙ্কর ঝড়।

এ ঝড়-বৃষ্টিতে ভিজে লাখো শিক্ষক মহাবেশে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিল ধরনের ঠাঁই ছিল না পাকশীর মহাসমাবেশে। তৎকালীন সভাপতি অধ্যাপক আবুল কালাম আযাদের নেতৃত্বে মঞ্চ থেকে বের হয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বৃষ্টির পানিতে ভিজে সাধারণ শিক্ষকদের সাথে একাত্মতা পোষণ করলেন। সভাপতির বক্তব্যে মরহুম অধ্যাপক আযাদ বললেন, সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস প্রধানের অনুপস্থিতিতে কাজ করার জন্য সহকারী প্রধান থাকে। কেবল নেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তিনি সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদ সৃষ্টির দাবি করলেন। সে মোতাবেক সারাদেশে সিনিয়র সহকারী শিক্ষকদের মধ্য থেকে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে কাজ করার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হলো। সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে সিনিয়র সহকারীরা নিয়োগ পেয়ে কাজ করতে লাগলেন।

তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী শেখ শহিদুল ইসলামের সাথে আলোচনা করে ২৫ টাকা দায়িত্ব ভাতা প্রদানের প্রস্তাবের ফাইল অর্থমন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের আগেই এরশাদ সরকারের পতন হয়।

পরবর্তীতে বিএনপি সরকারের আমলে মহাপরিচালক প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রজ্ঞাপন বাতিল করে ও সহকারী প্রধান শিক্ষকদের আবার তাদের সহকারী শিক্ষক হিসেবে বদলি ও সকল ক্ষেত্রে সহকারী প্রধান শিক্ষক না লেখার নির্দেশ দেন। এভাবে বিলুপ্ত হলো সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদ। শিক্ষকরা জাতি গড়ার কারিগর। শিক্ষকদের মাঝে বৈষম্য সৃষ্টি অপরাধের সমতুল্য। একশ্রেণির ঘৃণ্যচক্র শিক্ষকদের মাঝে বৈষম্যে সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালিয়ে শিক্ষাবান্ধব সরকারের সাথে প্রাথমিক শিক্ষকদের দূরত্ব সৃষ্টি করে চলেছেন।

সরকারের দায়িত্বশীল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশে বলছি, চাটুকার স্বার্থান্বেষীরা শিক্ষকদের মনের কথা আপনাদের সামনে না বলে নানা উপায়ে তাদের স্বার্থসিদ্ধি করে যাচ্ছে। দীর্ঘ সময় প্রাথমিক শিক্ষকদের সংগঠন করে আজও নিজেকে নেতা তো নয়-বরং একজন সফল কর্মীও ভাবতে পারিনি। আজকাল মন্ত্রী, সচিব, ডিজি, যে কোন কর্মকর্তার সাথে একটু ছবি উঠিয়ে নেতা বনে যায় ও দালালির সাইন বোর্ড গায়ে জুলিয়ে দেয়। চালাতে থাকে প্রাথমিক শিক্ষার নানা দুর্নীতি ও অপকর্ম। মাসের  পর মাস এমনকি বছরের পর বছর ডিজি অফিস, মন্ত্রণালয়ে নিয়মিত হাজিরা দিয়ে শিক্ষকতা পেশাকে কলঙ্কিত করেছেন, কুমিল্লা জেলার ব্রাক্ষ্মণপাড়া উপজেলার এক নেতা। অভিভাবকরা অভিযোগ করেও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে তদন্ত দীর্ঘ সময় পড়ে আছে বরং পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছেন মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টরা। শিক্ষকের সম্মান বৃদ্ধি হলে গোটা জাতি সম্মানিত হবে। বিশ্বের প্রায় সকল দেশে শিক্ষকেরা ১ম শ্রেণির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। হতভাগা দেশের মন্ত্রী, সচিবসহ সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি জেনে শুনে কেন শিক্ষকদের যথাযথ সম্মান ও বেতন দিতে বিলম্ব করছেন? তাদের মনের ভাবনা হয়তো ‘প্রায়-মরা’ শিক্ষকদের যত মেরে মেরে রাখা যায়। গুটিকয়েক নেতা নামধারীদের প্রশংসা বা বাতাস সাধারণ শিক্ষকদের বাতাস নয়, সাধারণ শিক্ষকদের প্রশংসা বা বাতাসে আলোকিত হোক শিক্ষাবান্ধব সরকার ভিত। 

এ কামনা দেশবাসীর সাথে আমারও। সংশ্লিষ্টরা হয়তো বলবেন, বর্তমান সরকার শিক্ষার জন্য অনেক কাজ করছেন। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। এ প্রসঙ্গে শিশুকালে আমার মরহুম পিতা বলেছিলেন, বাবা সব সময় সতর্ক থাকবে, মনে রাখবে এক কলস দুধ নষ্ট হওয়ার জন্য এক ফোঁটা চনাই যথেষ্ট। তেমনি সহকারী শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য দূরীকরণ, প্রধান শিক্ষকদের ১০ গ্রেড দিতে যে বিড়ম্বনা তা সে ফোঁটা চনার মতো। সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদ সৃষ্টি হলো প্রতিষ্ঠানে একজন স্বীকৃত দায়িত্বপ্রাপ্ত লোক থাকবে। তেমনি বিদ্যালয়ের বিভিন্ন কাজে প্রধান শিক্ষককে সহযোগিতার পাশাপাশি তাঁর অনুপস্থিতিতে কাজ করবেন। চাকরি চলাকালে বেশিরভাগ শিক্ষক এ পদোন্নতির সুযোগ পাবে।

বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন, তার স্বপ্নকে বাস্তবায়নে সকল শিক্ষককে থার্ড ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস মর্যাদা আসন থেকে সরিয়ে নিতে হবে। প্রাথমিক, গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিপুল সংখ্যক শিক্ষক থার্ড ক্লাস। মন্ত্রী, সচিব ও কর্মকর্তা হয়েও এ অবমাননা থেকে তারা মুক্ত কিনা জানি না? একজন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীর মানসিকতা কীভাবে দেশে সুনাগরিক তথা প্রথম শ্রেণির নাগরিক তৈরির সূচনা পর্ব শুরু হবে, ভাবতে অবাক লাগে। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সকল শিক্ষকের মর্যাদা একই হলে মর্যাদার বৈষম্য নিয়ে আত্মাহঙ্কার দূর হবে।

শিক্ষকতা পেশাকে আজও সকল মহল সম্মানের সাথে দেখে আসছে। আজও গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ ভোট, বিয়ে-শাদি ও নানা সামাজিক কাজে শিক্ষকদের পরামর্শ নিয়ে থাকেন। প্রাথমিক শিক্ষকেরা ‘প্রায়-মরি থেকে প্রায়-মারি’ ভূমিকা পালন করে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী সর্বনাশের হাত থেকে মুক্ত করতে পারেন।

বৈষম্য দূরীকরণে প্রাথমিকসহ সকল শিক্ষকের মর্যাদা থাকবে প্রথম শ্রেণি। শিক্ষকতাকে মর্যাদাহীন করে রাখা দেশ ও জাতির কলঙ্ক। বর্তমান বেতন বৈষম্য দূর করার জন্য সকল শিক্ষকের প্রথম শ্রেণির বেতন স্কেলসহ প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষকের সম্মানজনক দায়িত্ব ভাতা প্রদান করা হোক। এর মাধ্যমে দূর হবে বেতন বৈষম্য ও শিক্ষকদের, সরকার তথা জাতির সম্মান। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদ সৃষ্টির পাশাপাশি অফিস সহকারীও পদ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। এ পদ সৃষ্টি যেন সহকারী শিক্ষকদের বৈষম্য দূরীকরণে ষড়যন্ত্র না হয়। সহকারী শিক্ষকদের যৌক্তিক প্রত্যাশা প্রধান শিক্ষকের পরের ধাপ বেতন। 

সহকারী প্রধান শিক্ষক পদের যৌক্তিক ভাতা দিয়ে সহকারী শিক্ষকদের প্রত্যাশার পাশাপাশি মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন স্বপ্ন পূরণ হবে বলে আশাবাদী।

লেখক: আহ্বায়ক, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ এবং প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম; সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিক শিক্ষা।

প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0034110546112061