ল্যাটিন শব্দ প্লাজার থেকে ইংরেজি প্লাজারিজম শব্দের উত্পত্তি। যার সমার্থক শব্দ অপহরণ বা হরণ। মেরিয়াম ওয়েবস্টার’স অনলাইন ডিকশেনারির সংজ্ঞা অনুযায়ী প্লাজারিজম হলো এক ধরনের জালিয়াতি। প্লাজারিজমের বাংলা শাব্দিক অর্থ হলো লেখা চুরি। অন্যের গবেষণা কার্যকে নিজের বলে চালিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা অথবা নিজের গবেষণা কর্মে অন্যের অবদানের যথার্থ উল্লেখ না রেখেই গবেষণাটি উপস্থাপন করা। নতুন জ্ঞান সৃষ্টির জগতে এমন অপচেষ্টা গর্হিত কাজ হিসেবে গণ্য হবে এটা খুবই স্বাভাবিক।
একটি দেশের অগ্রগতির অন্যতম প্রধান মানদণ্ড হচ্ছে ঐ দেশের শিক্ষার হার। এরপরেই আসে মানসম্পন্ন শিক্ষা। মানসম্পন্ন শিক্ষা বলতে বোঝানো হয় মৌলিক গবেষণাকে প্রাধান্য দেয়া। আমাদের দেশে বর্তমানে ৪২টি পাবলিক এবং ৯৫টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এ সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়গু বিভিন্ন বিষয়ে বি.এসসি, এম.এসসি, এম.ফিল এবং পিএইচ.ডি ডিগ্রি প্রদান করে থাকে। শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ডিগ্রি দেয়ার হারও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা কি ডিগ্রি প্রদানের সময় প্লাগারিজম (লেখা চুরি) বিষয়টি সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করছি? যদি পর্যবেক্ষণ না করি তবে আমাদের মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদানের যে অভিপ্রায় তা কখনোই সার্থক হবে না। শুধু তাই নয়, ইনফরমেশন টেকনোলজির যুগে প্লাগারিজম চেকের অনেক সফটওয়্যার রয়েছে। যা কোনো একজনের গবেষণা কর্মের কতটুকু অন্য কারোর গবেষণা কর্মের সঙ্গে হুবহু মিলে যায় তা স্বল্প সময়ের মধ্যেই খুঁজে বের করতে পারে। বিষয়টি উদঘাটিত হলে ঐ গবেষণা কর্ম বা গবেষণাপত্রের বিরুদ্ধে কপিরাইট আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রবিধান রয়েছে বিশ্বজুড়ে। তাই আমরা যারা শিক্ষক তাঁরা আমাদের তত্ত্বাবধানে বি.এসসি, এম.এসসি, পিএইচ.ডি ছাত্রদের গবেষণা কর্মগুলো আগে থেকেই যদি সফ্টওয়্যারের মাধ্যমে প্লাগারিজম ফ্রি করে নেই তাহলে ছাত্র, শিক্ষক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এই তিনের জন্যেই মঙ্গলজনক। অন্যথায় ছাত্র, শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এই তিনটি সত্তাই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে ইমেজ সংকট বা কপিরাইট আইনে যে কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়তে পারে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোনো গবেষণাপত্রে ৩০% পর্যন্ত প্লাগারিজম গ্রহণযোগ্য।
পেশাগত কারণে প্রায়ই বিভিন্ন কনফারেন্স বা জার্নালের টেকনিক্যাল রিভিউয়ার হিসেবে কাজ করতে হয়। গবেষণা পেপারগুলো পেলে প্লাগারিজম চেকের জন্য প্লাগারিজম সফটওয়্যার ব্যবহার করি। যদি সিমিলারিটি ৩০%-এর মধ্যে থাকে তখনই কেবল পেপারগুলো রিভিউ করি তা না হলে তা রিজেক্ট করি। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, কয়েকটি ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে পেপার রিভিউ করতে গিয়ে প্লাজারিজম চেকিং-এ ৯৫% সিমিলারিটি পেয়েছি। যা গবেষকদের নৈতিক স্বচ্ছতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। পৃথিবীতে যেহেতু প্রতি মুহূর্তে অসংখ্য গবেষণা হচ্ছে তাই সফটওয়্যারের সহায়তা না নিলে এরূপ ঘটনা গবেষক এবং তত্ত্বাবধানকারীর অজান্তেই ঘটে যেতে পারে। কিছু রোগ আছে যা মানুষের অজান্তেই নীরবে মানুষের জীবনীশক্তি নিঃশেষ করে দেয় এবং মানুষকে মৃত্যু-ঝুঁকিতে ঠেলে দেয়, সেই রোগগুলোকে বলা হয় গুপ্তঘাতক। তেমনি নতুন জ্ঞান সৃষ্টির তাগিদে গবেষণার কার্যক্রমে রয়েছে নিভৃতচারী গুপ্তঘাতক-প্লাজারিজম। প্লাজারিজম চেকের বিষয়ে সচেতনতার অভাবে একজন গবেষকের মান-সম্মান তার অজান্তেই ধূলোয় মিশে যেতে পারে।
আমি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচ.ডি স্টুডেন্টের থিসিস ডিফেন্সের বহিঃবিশেষজ্ঞ সদস্য হিসেবে মনোনীত হয়েছিলাম। মনোনয়নপ্রাপ্তির পর যখন আমার কাছে ঐ গবেষণা প্রবন্ধটির বাঁধাই কপি প্রেরণ করা হয় তখন আমি তার সুপারভাইজারকে উক্ত গবেষণাপত্রের সফট্ কপি আমাকে প্রেরণ করতে অনুরোধ করি। প্রথমে তিনি আমাকে বলেন, “বাঁধাই কপি তো দেয়া হয়েছে, আবার সফট ্কপি কেন?” আমি প্লাজারিজমের বিষয়টি তুলে ধরি এবং আমার যেহেতু বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে প্লাজারিজম চেকিং সফট্ওয়্যার ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে, তাই আমি ঐ গবেষণাপত্রটি প্লাজারিজম টেস্টের জন্য প্রেরণ করতে আগ্রহ প্রকাশ করি। প্রথমে উনি বলেন, “ছাত্র অনেকদিন ধরে কাজটি করেছে, সুতরাং কাজটি ভালো। প্লাজারিজম হওয়ার চান্স নেই।” আমি তাঁকে বলি তাহলে তো খুবই ভালো। কিন্তু একেবারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্লাজারিজম টেস্ট করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।” এরপর ছাত্রের গবেষণাপত্রটি প্লাজারিজম চেকিং-এর জন্য পাঠানো হয়। পরেরদিনই ৬৯% প্লাজারিজম রিপোর্টসহ প্রবন্ধটি সুপারভাইজারের কাছে ই-মেইল করি। যদি মৌলিক গবেষণার নিজ অবদানের অংশে অন্যের গবেষণা কর্মের হুবহু মিল না থাকে, তাহলে গবেষণাপত্রের অন্যান্য অংশের প্লাজারিজম ঠিক করতে ছাত্রের হয়তো কিছু পরিশ্রম করতে হবে কিন্তু এর ফলে ছাত্র, সুপারভাইজার এবং বহিঃবিশেষজ্ঞ সদস্য সবাই গবেষণার স্বচ্ছতা, সততা এবং মৌলিকত্বের বিষয়ে নিশ্চিত থাকবেন।
আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করি- একটি স্বনামধন্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের থিসিস ডিফেন্সের বহিঃবিশেষজ্ঞ সদস্য আমি। সাধারণত বি.এসসি থিসিস ডিফেন্সের ব্যাপারে খুব বেশি কড়াকড়ি আরোপ করা হয় না। কারণ ছাত্ররা জীবনের প্রথম প্রজেক্ট বা থিসিস লেখে বি.এসসি প্রোগ্রাম শেষ করার সময়। কিন্তু এম.এসসি’র ক্ষেত্রে যখন দুইজন বিদেশি ছাত্র ডিফেন্স দিতে আসল তখন তাদের বিষয়ে আমার মূল্যায়ন ছিল এরূপ:‘প্লাজারিজম টেস্টের পরেই কেবল তাদের ডিফেন্সের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে।’ প্লাজারিজম টেস্ট করে তাদের গবেষণাপত্রের প্লাজারিজম পাওয়া গিয়েছে ৭৫%। তাই মানসম্মত উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্লাজারিজমের বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণ করা আবশ্যক।
২৩ এপ্রিল ২০১৬ তারিখের দৈনিক একটি পত্রিকায় “নিজের ডিগ্রি নেই তবুও তারা পিএইচডির শিক্ষক” শিরোনামে একটি খবর প্রকাশিত হয়। খবরটির এক অংশে প্রকাশ “টাকায় মিলছে থিসিস: নবীন গবেষকরা রাজধানীর নীলক্ষেতকে ইদানিং থিসিসের আঁতুড়ঘর হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। অনার্স, মাস্টার্স, এমফিল, পিএইচডি সকল ধরনের থিসিস এখানে পাওয়া যায়। এছাড়া একজনের থিসিস অন্যজন হুবহু নকল করে জমা দেয়ার রেকর্ড আছে।” এরূপ বিষয়গুলোর নিয়ন্ত্রণ শুধুমাত্র প্লাজারিজম টেস্টের মাধ্যমেই সম্ভব।
প্লাজারিজম পরীক্ষায় যে সফট্ওয়্যার ব্যবহূত হয় তা উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে এখনো এ ব্যাপারে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ই কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। প্লাজারিজম সফট্ওয়্যারগুলো বেশ ব্যয়বহুল। ২০০ ব্যবহারকারীর জন্যে বছরে ৫,০০,০০০/- টাকা প্রদান করতে হয়। আমার প্রস্তাবনা থাকবে ইউজিসিতে একটি প্লাজারিজম চেকিং সেল থাকবে, যা ইউজিসি’র অন্তর্ভুক্ত সকল বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবহার করতে পারবে এবং আইন করতে হবে যেকোনো বিষয়ের ওপর ডিগ্রি প্রদানের ক্ষেত্রে গবেষণাপত্র প্লাজারিজম টেস্টের পরেই ডিফেন্সের জন্যে অনুমোদিত হবে। আমার বিশ্বাস এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষক, ছাত্র কারো পক্ষ থেকেই কোনো বাধা আসবে না। কারণ, বিষয়টি তিনটি সত্তার সুনাম অক্ষুণ্ন রাখা এবং উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণার মানোন্নয়নের জন্যে অপরিহার্য। প্লাজারিজম নিরসনে আমার প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়িত হলে সার্থক ও সাফল্যমণ্ডিত হবে আমাদের উচ্চশিক্ষা। “সমুন্নত হোক আমাদের উচ্চশিক্ষার মান, বিপদমুক্ত থাকুক শিক্ষক ও গবেষকদের সম্মান”— এই স্লোগানটি হোক উন্নত দেশ ও জাতি গঠনের অন্যতম প্রেরণা।
লেখক :ডীন (ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদ)
বিভাগীয় প্রধান (কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ)
ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর-১৭০০
সৌজন্যে: দৈনিক ইত্তেফাক