পড়াশোনা ও রাজনীতির জগৎ আলাদা হোক - দৈনিকশিক্ষা

পড়াশোনা ও রাজনীতির জগৎ আলাদা হোক

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

পড়াশোনার জগৎকে সম্পূর্ণ আলাদা করতে হবে দেশের চলমান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে। দলবাজি করে লাভবান হওয়াটা দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত করে দেখা উচিত। পড়াশোনা শেষ করে একজন ছাত্র নিশ্চয়ই ব্যবসায়ী কিংবা ঠিকাদার হতে পারেন। ছাত্র অবস্থাতেও পড়াশোনার জগৎ ব্যাহত না করে এ কাজ করা যেতে পারে। কিন্তু দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে কাজ বাগানো কিংবা 'প্রকেটশন মানি' গ্রহণ করা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও বলা হয়, একটি ছেলে বা মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হতেই ১৭ বছর বয়স হয়ে যায়। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরবর্তী এক বছরের মধ্যেই সে ভোটাধিকার লাভ করে। তার মানে, যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের কিছু শিক্ষার্থী ছাড়া বাকি সব শিক্ষার্থীই ভোটাধিকার সম্পন্ন। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় বা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তারা নিজেদের পছন্দ-অপছন্দ প্রয়োগ করতে পারে। আমার এই কথার মর্মার্থ হচ্ছে- বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীকে অবশ্যই রাজনীতি-সজাগ হতে হবে। কিন্তু এ জন্য তাকে প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা আবশ্যক নয়।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মনমানসে রাজনৈতিক চিন্তাধারা লালিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। সে ক্ষেত্রে তার প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হতে পারে। কিংবা দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ধারাগুলোর সঙ্গে তার পরিচিতি প্রয়োজন। দেশ পরিচালনায় যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কাজ করে, সেগুলোর প্রতিটি বিষয়ে না হলেও প্রধান প্রধান বিষয়ে তার সুস্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। প্রশ্ন হচ্ছে, তাকে এই ধারণা কে দেবে? তার পক্ষে তো বই পড়ে এই জ্ঞান লাভ করা কঠিন। সে ক্ষেত্রে কারও হাত ধরে রাজনৈতিক চিন্তায় সক্ষমতা আনা যেতে পারে। ধীরে ধীরে যে মতাদর্শে তার আস্থা জন্মায়, সে বিষয়ে সমমনাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ধারণা গভীরতর করতে পারে। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি শিক্ষার্থী নিজস্ব বিবেচনাশক্তির ওপর নির্ভর করে কোনো না কোনো রাজনৈতিক ধারার পক্ষে অবস্থান নিতে পারে।

এতক্ষণ যা বললাম, একজন পাঠক যদি তাতে মোটামুটি একমত হন, তাহলে বুঝবেন, আমি শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ করার কথা বলছি না। বলতে চেষ্টা করছি, শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক চিন্তাধারা কীভাবে তৈরি হবে।

ব্রিটিশ শাসনামলে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো মোটামুটি একমত ছিল যে, ঔপনিবেশিক শক্তিকে হটিয়ে স্বাধীনভাবে দেশ পরিচালনা করতে হবে। এর উপায় নিয়ে মতপার্থক্য ছিল।

ব্রিটিশ শাসনামলে বিভিন্ন মতধারায় বিভক্ত প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই ছাত্র সংগঠনও ছিল। ওইসব ছাত্র সংগঠনের সদস্যরা কেউই ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জনের জন্য কাজ করেননি। কিংবা ক্যান্টিনে ফাও খাননি, চাঁদাবাজি করে পকেট ভরেননি। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়লে রাজনৈতিক দলের কিংবা মতাদর্শের সঙ্গে জড়িত ছাত্র সংগঠনের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা পাওয়া যায়।

ব্রিটিশরা বিদায় হলে পাকিস্তান আমলেও রাজনীতিবিদরা মোটাদাগে তিন ধারায় বিভক্ত ছিলেন। একটি ধারা পাকিস্তানি শাসকদের তোষণকারী হয়ে কিছুটা ক্ষমতার স্বাদ আস্বাদন করতেন। এদের রাজনীতির আরেকটি ভিত্তি ছিল ধর্ম। এই গ্রুপটি এখনও পাকিস্তানপন্থি হিসেবে আমাদের মধ্যে বিরাজমান। এদের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট ছাত্র সংগঠন ধর্মের নামে উগ্র হয়ে উঠেছিল। সহজ-সরল বঙ্গ সন্তানকে ধর্মের নামে প্রভাবিত করা যায়। এরা বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে জেঁকে বসেছে।

দ্বিতীয় ধারাটি হলো, বামপন্থি বা সমাজতন্ত্রীদের ধারা। এদের চিন্তা-ভাবনায়ও তরুণরা সহজে আকৃষ্ট হয়। কারণ এরা সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠার কথা বলে। ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে। দরিদ্র মানুষের কথা বলে চোখের পানি ফেলে। কিন্তু এদের নেতারা নিজেদের মধ্যে মতামতের সামান্যতম পার্থক্যও সহ্য করতে পারেন না। এরা আবার বিদেশি মতধারার লেজুড়বৃত্তি করতে পছন্দ করেন। বর্তমানে নিজেদের মধ্যেই বিভক্তি হতে হতে বোধ করি অর্ধশতাধিক ধারায় পরিণত হয়েছে। এদের অনেকেই এখন নামসর্বস্ব বা প্যাডসর্বস্ব রাজনৈতিক দল। কিন্তু তাদেরও লেজুড়বৃত্তি করে এ রকম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছাত্র সংগঠন রয়েছে। সমাজে এই ধারার রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো প্রভাব আছে বলে মনে হয় না। আমার তো মনে হয়, খবরের কাগজগুলো এদের সংবাদ প্রকাশ করে এদের জীবিত রাখছে।

তৃতীয় ধারাটি বর্তমানে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ধারা। এরা দারিদ্র্য বিমোচনে বিশ্বাস করলেও রাষ্ট্র পরিচালনায় ধনতন্ত্রভিত্তিক দেশগুলোর পন্থায় বিশ্বাসী। এদের ছাত্র সংগঠনগুলো পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে অত্যন্ত সক্রিয় ছিল। প্রধানত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে এরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে জনমত তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে এরা মানুষের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়ত। এ সময়ের ছাত্র সংগঠনগুলোও তাদের মতাদর্শ সোচ্চার করার পক্ষে নির্মোহভাবে কাজ করত। সত্তর ও আশির দশকে এরা উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়লেও সরাসরি ব্যক্তিগত সুবিধা অর্জনে ততটা নগ্ন হয়নি। যদিও তাদের মধ্যে অসহিষুষ্ণতা ও অভ্যন্তরীণ দলাদলি ছিল; সম্মিলিতভাবে স্বৈরাচারী সরকারের বিরোধিতা করতে সক্ষম হয়েছিল।

আমরা দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, নব্বইয়ের দশক থেকে আদর্শের কথা ভুলে গিয়ে অনৈতিক কার্যকলাপে ছাত্র নেতাদের আগ্রহ বেশি। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে থাকলে সুবিধা হবে ভেবে দলবদল করে সবসময়ই ক্ষমতাসীন দলে থাকতে চেষ্টা করে। এভাবেই উদ্ভব হয়েছে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও মারপিটের রাজত্ব। কথায় কথায় অস্ত্র নিয়ে প্রতিপক্ষকে ধাওয়া করা যেন ডাল-ভাতে পরিণত হয়েছে।

বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কি ছাত্র রাজনীতি আছে? তারা কি দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের অনুসারী? উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ। আমি স্কটল্যান্ডে ছাত্র থাকাকালে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রম দেখেছি। ছাত্র সংসদের প্রধানের পদে যারা নির্বাচিত হন, তারা ওই বছর ছাত্রত্ব থেকে ছুটি নেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট, সিন্ডিকেট ইত্যাদির সদস্য হন। ছাত্র সংসদের বিভিন্ন শিক্ষাবহির্ভূত কার্যক্রমের তদারক করেন। তারা বিভিন্ন ধরনের সমাজ উন্নয়নমূলক কাজও করে থাকেন। প্রতিটি সক্রিয় ছাত্র তার রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু কোনোভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাক্রম ব্যাহত করে না। ছাত্রাবাসগুলোয় সব ছাত্রই একই ধরনের সুযোগ-সুবিধা লাভ করে। অর্থাৎ তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ছাত্র হিসেবে একাডেমিক কার্যক্রমের কোনো সম্পর্ক নেই।

এখন প্রশ্ন উঠছে- বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকা উচিত কি-না। আমি মনে করি, পড়াশোনার জগৎকে সম্পূর্ণ আলাদা করতে হবে দেশের চলমান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে। দলবাজি করে লাভবান হওয়াটা দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত করে দেখা উচিত। পড়াশোনা শেষ করে একজন ছাত্র নিশ্চয়ই ব্যবসায়ী কিংবা ঠিকাদার হতে পারেন। ছাত্র অবস্থাতেও পড়াশোনার জগৎ ব্যাহত না করে এ কাজ করা যেতে পারে। কিন্তু দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে কাজ বাগানো কিংবা 'প্রকেটশন মানি' গ্রহণ করা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। দেশে ছাত্র রাজনীতি এখন সংশ্নিষ্ট রাজনৈতিক দলের লাঠিয়াল হিসেবে কাজ করে। এটা ছাত্র রাজনীতি শুধু কেন, দেশ শাসনের প্রক্রিয়ায় সুস্থ রাজনীতির পরিপন্থি। অর্থাৎ ছাত্র রাজনীতির পুরো প্রক্রিয়া ও কর্মকাণ্ড মূল্যায়ন করে তা নতুন করে সাজাতে হবে। কাজটি করবে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল। বাকি ক্ষুদ্র ছাত্র সংগঠনগুলো স্বাভাবিক নিয়মে শুধরে যাবে।

ছাত্র রাজনীতি আপাতত বন্ধ করে সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে এনে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। সব রাজনৈতিক দলকে এ কাজে সক্রিয় সমর্থন দিতে হবে। ছাত্র রাজনীতির অবয়ব কী হবে, সেটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে তার গাইডলাইন ঠিক করা যেতে পারে।

শেষ করছি এ কথা বলে, রাজনৈতিক দলগুলোর পূর্ণ সমর্থন ছাড়া জাতীয় জীবনে দুষ্ট ক্ষতের মতো বিরাজমান বর্তমান ছাত্র রাজনীতিকে শোধরানো যাবে না।

ড. আইনুন নিশাত : পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ; ইমেরিটাস অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

স্কুল-কলেজ, মাদরাসা খুলবে ২৮ এপ্রিল - dainik shiksha স্কুল-কলেজ, মাদরাসা খুলবে ২৮ এপ্রিল সাত দিন বন্ধ ঘোষণা প্রাথমিক বিদ্যালয় - dainik shiksha সাত দিন বন্ধ ঘোষণা প্রাথমিক বিদ্যালয় তীব্র গরমে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসও বন্ধ ঘোষণা - dainik shiksha তীব্র গরমে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসও বন্ধ ঘোষণা প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ছাত্ররাজনীতি লাভজনক পেশায় পরিণত হয়েছে : ড. আইনুন নিশাত - dainik shiksha ছাত্ররাজনীতি লাভজনক পেশায় পরিণত হয়েছে : ড. আইনুন নিশাত কারিগরির সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটির প্রজ্ঞাপন জারি - dainik shiksha কারিগরির সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটির প্রজ্ঞাপন জারি মাদরাসায় ছুটির প্রজ্ঞাপন জারি - dainik shiksha মাদরাসায় ছুটির প্রজ্ঞাপন জারি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.030132055282593