একজনকে এক রুমে দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখা হলো। তাকে জিজ্ঞাস করা হলো যে, বাইরের কিছু দেখতে পাচ্ছে কিনা। সে সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, না। না আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। এখন ঘরের এক দেয়ালে একটু ছিদ্র করে তাকে বলা হলো, দেখাদেখি এইটুকুন ছিদ্র দিয়ে বাইরের কিছু দেখতে পাচ্ছ কিনা। সে জবাব দিল তেমন কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। এখন সেই ছিদ্রটাই ঐ ছিদ্র থেকে দ্বিগুণ করে দেওয়া হলো। তারপর তাকে আবার বলা হলো, এখন কি বাইরের কিছু দেখতে পাচ্ছ? সে জবাব দিল, হ্যাঁ দেখতে পাচ্ছি। একটা গাছ, ফসলের মাঠের কিছু অংশ। এই। এর বেশি কিছু দেখতে পাচ্ছি না। সেই ছিদ্র দ্বিগুণ থেকে দশগুণ, দশগুণ থেকে বিশগুণ করা হলো। এখন সে একটা গাছের পরিবর্তে সাত-আটটা গাছ, পুরো ফসলের মাঠ, তার পাশ দিয়ে যে একটা ছোট নদী বয়ে গেছে সেটাও সে দেখতে পেল।
এখন ঐ জানালাটাই খুলে দেওয়া হলো। অবশ্যই সে এখন আগের চেয়ে অনেক অনেক বেশি কিছু দেখবে। এখন তাকে ঐ রুম থেকে বের করে ছাদে নিয়ে যাওয়া হলো। ছাদ থেকে সে পুরো নীল আকাশ দেখল। নীল আকাশের দক্ষিণে সাদা মেঘের লুকোচুরি দেখল। এক ঝাঁক পাখি উড়ে গেল, তাও দেখল। দিগন্ত জোড়া ফসলের মাঠ, মাঠে কৃষকের হালচাষ, আঁকাবাঁকা ছোট নদী, নদীর উপর পাল তোলা নৌকা, মাঝি, গায়ের বধূরা কাখে কলসি ভর্তি পানি নিয়ে যাওয়া, নদীর ধারে রাখাল বালকের গরুর পাল সব দৃশ্যই সে দেখল।
বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল্লা আবু সায়ীদ স্যার “বই পড়া”কে ছিদ্র জানালা আর ছাদের সঙ্গে তুলনা করেছেন। আমরা যখন বই পড়ি না তখন আমাদের চারদিকে অন্ধকার। কিছুই দেখতে পাই না। দরজা-জানালা বন্ধ অন্ধকার রুমের মত। আমরা যত বই পড়ব আমাদের অন্ধকার তত কেটে যাবে। ছিদ্র বেড়ে যাবে। সেই ছিদ্র দিয়ে আমরা সব কিছু দেখব। বই পড়ে এভাবেই আমাদের জানালা খুলতে হবে। জানালা থেকে চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য ছাদে যেতে হবে।
এখন কথা হচ্ছে আমরা যারা ‘পড়ালেখা’ বা ‘লেখাপড়া’ করি আমরা আসলে কি ‘পরীক্ষার্থী’ নাকি ‘শিক্ষার্থী’। পড়ালেখা আর লেখাপড়া আমার দৃষ্টিতে এক নয়। ‘পড়ালেখা’ শব্দটা থেকে আমরা খুব সহজেই বুঝতে পারি যে, বই পড়ে যদি লেখা হয় তবে সেটাকে মোটামুটি পড়ালেখা বলা যায়। যেমন পরীক্ষার আগে পড়ে পরীক্ষার খাতায় লেখা। সেটাকেই আবার পরীক্ষার্থী বলা যায়। অর্থাত্ যারা পরীক্ষায় পাস বা ফলাফল ভালো করার জন্য বই পড়ে তাকেই পরীক্ষার্থী বলা চলে। আমাদের দেশে পরীক্ষার্থীই মূলত বেশি। কারণ আমরা আমাদের সিজিপি বা জিপিএ ভালো করার জন্যেই পড়ি।
অপরদিকে ‘লেখাপড়া’ শব্দটা ‘পড়ালেখা’ শব্দের বিপরীত। অর্থাত্ প্রথমে লিখতে হবে তারপর পড়তে হবে। মূলত এই লেখাপড়া করে থাকেন মননশীল ব্যক্তিরা। অর্থাত্ যারা লেখালেখি করে। যেমন কবি, সাহিত্যিক, কলামিষ্ট, সাংবাদিক। একজন কবি যখন একটা কবিতা লেখেন তখন লেখার পর তিনি আবৃত্তির ঢংয়ে পড়েন। অতএব এটা লেখাপড়া। একজন সাহিত্যিক যখন একটা বই লেখে তখন আমরা সেই বইটা পড়ি। অর্থাত্ লেখাপড়া। মূলত যারা লেখাপড়া করে তাদেরকেই শিক্ষার্থী বলা চলে। কারণ যারা লেখাপড়া করে তারা শেখার জন্য করে। এজন্যেই তারা শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীরা জিপিএ বা সিজিপি বাড়ার জন্য পড়ে না এজন্য তাদের পরীক্ষার্থী বলা চলে না।
এখন কথা হলো আমরা যারা পাঠ্য বইয়েই শুধু পড়ি আমরা কি ছাদ পর্যন্ত যেতে পারব? না! পারব না। কারণ পাঠ্য বইয়ের নির্দিষ্ট বই কেবল ছিদ্র মাত্র। সেই ছিদ্রের আলো আমাদের আলোকিত করতে পারবে না। বেশি কিছু দেখাতে পারবে না। তাহলে সেই ছিদ্র থেকে জানালা, জানালা থেকে ছাদ পর্যন্ত পৌঁছাতে কত্ত কত্ত বই পড়তে হবে সেটা এখন বুঝার বিষয়।
লেখক :শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
সৌজন্যে: ইত্তেফাক