ফের পাবলিক পরীক্ষার সেই দুঃসহ স্মৃতি! - দৈনিকশিক্ষা

ফের পাবলিক পরীক্ষার সেই দুঃসহ স্মৃতি!

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

তাহলে পাবলিক পরীক্ষা মানেই কি অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, বিশৃঙ্খলা, অবজ্ঞা, অবহেলা ও খামখেয়ালিপনা? পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে এতদিনে এ কি আমাদের অর্জন! না, নিকট-অতীতের সঙ্গেও এখন আর মেলাতে পারছি না। এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। পরীক্ষা নিয়ে স্বাধীনতা-পরবর্তী কিংবা আশি অথবা নব্বই দশকের দুঃসহ স্মৃতিই যেন বারবার মনের মাঝে উঁকি দিচ্ছে। বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। 

নিবন্ধে আরও জানা যায়, ২০০০ খ্রিষ্টাব্দের এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয় ২ মার্চ। এ পরীক্ষায় দেশের বিভিন্ন পরীক্ষা কেন্দ্রে ব্যাপক গোলযোগ হয়। পরদিন ৩ মার্চ ‘দৈনিক যুগান্তর’ পত্রিকা পরীক্ষা নিয়ে প্রথম পাতায় ‘নকলের মহোৎসব’ শিরোনামে বিস্তারিত খবর ছাপে। এছাড়া সারা দেশের পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোতে ব্যাপক গণটোকাটুকি, অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা, হৈচৈ ও গোলযোগ নিয়ে পুরো একটি পাতায় কম্পাইল রিপোর্ট ছাপা হয়।

তদুপরি প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পাতায় ভিন্ন ভিন্ন খবরের শিরোনামগুলো ছিল ঠিক এমন- ১, এসএসসি : প্রথম দিনে বহিষ্কার প্রায় ৬ হাজার, ২. কলারোয়া ট্র্যাজেডি : পরীক্ষা কেন্দ্রে পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারাল চারজন, আহত ৬০, ৩. কন্যাশোকে মারা গেলেন বাবা, ৪. বস্তা বস্তা নকল উদ্ধার : গণটোকাটুকি, ৫. চট্টগ্রামে বহিষ্কার ৩৮৭ : রাঙ্গামাটিতে গোলাগুলি, ৬. এসএসসি পরীক্ষা : বরিশালে কেউ ১৪৪ ধারা মানছেন না, ৭. তালিকায় কেন্দ্রের নাম নেই, তাই ...।

যুগান্তর ছাড়া অন্য জাতীয় দৈনিকগুলোও গুরুত্বপূর্ণ এ পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে এমন শিরোনাম দিয়েই খবর ছাপা হয়। একই দিন (৩ মার্চ, ২০০০) যুগান্তর পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক গোলাম সারওয়ার ‘চোখের আলোয়’ শিরোনাম দিয়ে বেশ বড় পরিসরে একটি উপসম্পাদকীয় লেখেন।

স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়- যে কোনো স্তরেরই হোক, পাবলিক পরীক্ষার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষার্থী তো বটেই, এমনকি তাদের অভিভাবকরাও সারাক্ষণ থাকেন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়। পাস-ফেলের ভাবনা এবং বিরাজমান পরিবেশ-পরিস্থিতি সবকিছুই সংশ্লিষ্ট সবার ভাবনা বা দুর্ভাবনা এবং উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মূল কারণ। পরীক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চরম নির্লিপ্ততা, সীমাহীন উদাসীনতা ও খামখেয়ালিপনার জন্য যদি তাদের সারাক্ষণ দুর্ভাবনায় কাটাতে হয় তাহলে এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় আর কী হতে পারে!

দেশব্যাপী ৩ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছে ২০২০ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। প্রথম দিনের পরীক্ষার যেসব বর্ণনা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, তা যে কাউকেই ভাবিয়ে তোলার কথা। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এসব খবর সত্যিকারার্থে কীসের আলামত? কেন এত খামখেয়ালিপনা? এত অবহেলা? এমন অপরিণামদর্শিতা?

এবার পরীক্ষার্থী ২০ লাখ ৪৭ হাজার। প্রথম দিনের পরীক্ষায় ১২ হাজার ৯৩৭ পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত। বহিষ্কার এখন আর তেমন কোনো ব্যাপার নয়, প্রথম পরীক্ষার দিন মাত্র ২২ জন। কিন্তু বিভিন্ন কেন্দ্রে ভুল প্রশ্নপত্রের ছড়াছড়ির যে বর্ণনা পাওয়া গেছে, তা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। কোথাও ভুল প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি চলে যাওয়ার পর আবার পরীক্ষার্থীদের ডেকে এনে পরীক্ষা নেয়া হয়। এ যেন এক তেলেসমাতি কাণ্ড। অন্য কোনো কাগজ নয়, প্রথম দিনের পরীক্ষার বর্ণনা দিয়ে কেবল দৈনিক যুগান্তরের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত খবরের অংশবিশেষ এখানে উদ্ধৃত করা হল- ‘... ভুল প্রবেশপত্র সরবরাহের কারণে নীলফামারীর ডোমারে এক ছাত্রী আত্মহত্যা করেছে।

পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন, বোর্ড থেকে ভুল প্রবেশপত্র বিতরণ, নকল সরবরাহ, পুরনো প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা গ্রহণের মতো ঘটনাও ঘটেছে এদিন। আছে ফরমপূরণ করেও প্রবেশপত্র না পাওয়ার ঘটনা। এসব কারণে সারা দেশে ৩৪ জন শিক্ষককে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ওইসব শিক্ষকের মধ্যে ৫ জনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে ...।’ অন্য কাগজের কথা নাই বা বললাম, যুগান্তরেরই পরীক্ষা সম্পর্কিত অন্যসব উদ্বেগজনক খবরের কথা উল্লেখ করে লেখার কলেবর বাড়াতে চাই না। পরীক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারোই কোনো অবস্থাতেই অমনোযোগী হওয়া বা থাকার কোনো অবকাশ নেই। অনেক সময় ছোট ভুলের জন্য বড় মাশুল গুনতে হয়। আর মাশুলটা দিতে হয় সাধারণ শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের।

পাবলিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে, বিশেষ করে মাধ্যমিক স্তরে বলতে গেলে প্রতি বছরই বিভিন্ন কেন্দ্রে নানা ধরনের বিপত্তি ঘটে থাকে। যেমন- সময় গণনা ও মানা, কোনটি সকাল আর কোনটি বিকালের প্রশ্নপত্র, নৈর্ব্যক্তিক ও সৃজনশীল প্রশ্নপত্র বিলি-বণ্টন এবং উত্তোলনে অসতর্কতা-উদাসীনতা, প্রশ্নপত্রের সেট ও নিয়মিত-অনিয়মিত পরীক্ষার্থী শনাক্তকরণ, মূল উত্তরপত্র থেকে ওএমআর সিট ছিন্নকরণ, উচ্চস্বরে কথা বলা, সবার সামনে দু-একজন বা গুটিকয়েক উত্তর বলে দেয়া।

এগুলো খুবই অশোভন, দৃষ্টিকটু ও অপরাধ। পরীক্ষা শেষের দিকে একশ্রেণির শিক্ষক উত্তরপত্র উত্তোলনের জন্য যেন একেবারে অস্থির হয়ে পড়েন। অনেক ক্ষেত্রে তাগিদ দিতে দিতে পাঁচ বা দশ মিনিট আগেই তা নিয়ে নেন। কিছু পরীক্ষার্থী থাকে, যারা এতসব খেয়াল করে না। কিন্তু যারা সিরিয়াস, খুবই সিরিয়াস- তাদের বেলায়?

আমার কথায় অনেকে অসন্তুষ্ট হতে পারেন। তাদের বিগত বছরগুলোতে পরীক্ষা চলাকালীন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত এ সম্পর্কিত খবরগুলোর প্রতি দৃষ্টি দিতে অনুরোধ করি। সব খবর আবার পত্রিকায় প্রকাশও হয় না, কেন্দ্রের আশপাশের লোকদের কানে-চোখে ভেসে বেড়ায়। রয়েছে সংকীর্ণতা-হীনমন্যতার প্রশ্নটিও। কে কোন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। শিক্ষক-পরিদর্শক কিংবা অন্য কেউ- যার কারণেই হোক এসব কিছুর মাশুল দিয়ে যেতে হয় সাধারণ পরীক্ষার্থীদের।

একটি গণতান্ত্রিক সরকার জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ইচ্ছা করলে অনেক কঠিন এবং দুঃসাধ্য কাজও সহজে সম্পাদন করতে পারে। তবে এর জন্য সততা, দক্ষতা ও নিষ্ঠার প্রয়োজন। অবশ্য সততা, দক্ষতা ও নিষ্ঠার চেয়েও এ ক্ষেত্রে সদিচ্ছাটাই বড় কথা। বয়স্কদের মনে থাকার কথা, স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পর ১৯৭২ সালে এসএসসি, এইচএসসি এবং ডিগ্রি পাস ও অনার্সসহ দেশের সবক’টি শিক্ষা বোর্ড ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন পরীক্ষায় ব্যাপক হারে নকল হয়। নকলের মহোৎসবে সবাই একেবারে মেতে ওঠে।

কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, সদ্য স্বাধীন একটি দেশে স্বাভাবিকভাবেই বিরাজমান সীমাহীন সমস্যা, সংকট এবং অস্থিরতার মাঝেও মাত্র দেড় বছরের মধ্যে নকল বন্ধ করে দিয়ে পরীক্ষা তথা শিক্ষা ক্ষেত্রে মোটামুটি একটি স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয় বঙ্গবন্ধু সরকার। আশির দশক থেকে পরীক্ষায় নকল আবারও ক্রমে সর্বগ্রাসী রূপ নেয় এবং বিশ বছরে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাটিকেই একেবারে বিপর্যস্ত করে ফেলে।

২০০২ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের প্রতিমন্ত্রী এহসানুল হক মিলন পাবলিক পরীক্ষায় নকল দূরীকরণকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে এর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ঝাঁপিয়ে পড়েন। নকল বন্ধ করার ব্যাপারে কতখানি আন্তরিকতা থাকলে নিজ দলীয় নির্বিশেষে সব সংসদ সদস্যের উদ্দেশে বলা যায়, পরীক্ষা চলাকালে তদের কেউ-ই পরীক্ষা কেন্দ্রে যেতে পারবেন না কিংবা স্থানীয় ‘আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি’ হিসেবে অল্প সময়ের জন্য তিনি পরীক্ষা কেন্দ্রে গেলেও তার সঙ্গে অন্য কোনো লোক রাখা যাবে না।

এহেন নির্দেশনা সংসদ সদস্য বা জনপ্রতিনিধিদের প্রতি এক ধরনের অনাস্থা, অবিশ্বাস ও সন্দেহেরই নামান্তর বলে মনে হলেও এবং এতে অনেকে মনে মনে নাখোশ হলেও নকলের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী তথা সরকারের স্পষ্ট ও দৃঢ় অবস্থানের কারণে সবাই তা মেনে নিয়েছিলেন। মূলত এসব কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের ফলেই টানা দুই দশক ধরে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় দুরারোগ্য ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত নকলের মাত্রা অল্পদিনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমে আসে। কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছাকে সর্বস্তরের মানুষ সমর্থন না জানালে কাজটি বোধ করি সহজ হতো না।

ক্রমে নকল নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। জোট সরকারের পর মহাজোট সরকারের আমলেও আমাদের অতীতের দুঃসহ স্মৃতি খুব একটা তাড়া করেনি। কিন্তু ইদানীং? নকল এবং নকলের সঙ্গে সঙ্গে নানা অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা-অমনোযোগ। অনিচ্ছাকৃত ভুল কম আর ইচ্ছাকৃত ভুল যাতে একেবারেই না হয়। পরীক্ষার সময়টিতে সংশ্লিষ্ট সবার মনোযোগী থাকার কোনো বিকল্প নেই। এজন্য দরকার কর্তৃপক্ষের কার্যকর কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ।

লেখক: বিমল সরকার, অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0044832229614258