ফেল কড়ি মাখো তেল' অনেক পুরোনো একটা বাংলা প্রবচন; কালের ধুলায় সে মোটেই মলিন হয়নি, উল্টো অতি ব্যবহারে ক্রমাগত উজ্জ্বল ও ধারালো হয়ে উঠেছে। এটি বাজারের কথা। বাজারে যিনি দোকান খুলেছেন তিনি একজন ব্যবসায়ী, পণ্য বিক্রি করছেন মুনাফার জন্য, তার চেষ্টা ক্রেতাকে যতটা পারা যায় ঠকাবেন, পারলে তেলে ভেজাল মেশাবেন। তার কাজ ও নীতি দুটিই পুঁজিবাদী। পুঁজিবাদ যত শক্তিশালী হয়েছে 'ফেল কড়ি মাখো তেল' নীতি ততই বিস্তৃত ও বলশালী হয়েছে, এখন তো বিশ্বময় তার একচ্ছত্র আধিপত্য। কোথায় সে নেই? যেমন স্বাধীনতার পর শোনা সেই আপাত মর্মস্পর্শী ও জনপ্রিয় গানটি : 'এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা আমরা তোমাদের ভুলবো না।' সেখানেও ওই কেনাবেচার কথা, আসলে যেটা কোনোভাবেই সত্য নয়। মঙ্গলবার (১১ আগস্ট) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, শহীদরা স্বাধীনতা এনেছেন হানাদারদের পরাভূত করে; রক্তের 'বিনিময়ে' তারা স্বাধীনতা কিনে এনে আমাদের উপহার দেননি। যুদ্ধটা ছিল জনগণের, তাতে আমরা সবাই ছিলাম, শহীদরা ছিলেন আমাদেরই অগ্রবর্তী অংশ। ব্যাপারটা এমন নয় যে এক সাগর রক্তে রাজি না হলে হানাদারদের দুই বা তিন সাগর রক্ত দিতে হতো। যুদ্ধক্ষেত্র দরকষাকষির বাজার নয়, জয়পরাজয়ের রণক্ষেত্র বটে।
পুঁজিবাদের এই বাজারি কারবার এখন বিশ্বের সর্বত্র। আর সে কারণেই বিশ্বের এখন ত্রাহি ত্রাহি দশা। ওই নীতির বিপরীতে পাল্টা আওয়াজও আছে। আমাদের এই বাংলাদেশেই উঠেছে সে আওয়াজ। তুলেছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। আওয়াজটা হলো, 'কেউ খাবে আর কেউ খাবে না তা হবে না তা হবে না'। এটা পুঁজিবাদের দ্বারা নিপীড়িত বিশ্ববাসী সবারই মনের কথা, বিশ্বজনীন প্রবচনে পরিণত হতে পারত। হয়নি। কারণ বাংলাদেশ একটি প্রান্তিক দেশ। এখানকার আওয়াজ বিশ্বময় পৌঁছায় না। পুঁজিবাদ তার বিরোধী আওয়াজগুলো শুনতেও চায় না, কণ্ঠরোধ করে। তবে বাংলাদেশ দরিদ্র বটে, কিন্তু পুঁজিবাদী সে ঠিকই।
বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাদের অতিসাম্প্রতিক অবদানটা হচ্ছে করোনাভাইরাস। পুঁজিবাদের সে প্রতিনিধি এবং নিজেও সে পুঁজিবাদী চরিত্রসম্পন্ন। পুঁজিবাদীদের একটি গণমুখপাত্র হচ্ছে আমেরিকার টাইম ম্যাগাজিন। করোনা মহামারির তাণ্ডব দেখে সে পত্রিকা মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছে যে এই আক্রমণ ইতোমধ্যেই 'is challenging our assumptions about humanity, about society, about greed and selfishness, about the need to cooperate[...]।' খুবই খাঁটি কথা। বিপদে পড়লে অনেক সময় খাঁটি কথা বের হয়ে আসে বৈকি। প্রাণের টানে। মনুষ্যত্ব ও মনুষ্যসমাজ সম্বন্ধে আমরা অতিউচ্চ ধারণা পোষণ করতাম। আমরা অর্থাৎ পুঁজিবাদী বিশ্বের সুবিধাভোগীরা এবং তাদের প্রভাবে পড়ে সুবিধাবঞ্চিতরাও। করোনার আক্রমণে সেসব ধারণার ভূলুণ্ঠিত হওয়ার দশা। সত্য হয়ে ফুটে উঠেছে আত্মস্বার্থকেন্দ্রিকতা ও লোলুপতা। ওগুলো অবশ্য ছিল, যতই সভ্য হওয়ার চেষ্টা করুক, মানুষ তো প্রাণীই বটে, প্রাণিজগতেরই এক সদস্য; আত্মস্বার্থকেন্দ্রিকতা ও ভোগলিপ্সা তো তার থাকবেই, আর ওগুলো জয় করেই তো সভ্যতার অগ্রগতি। কিন্তু জয় করা যে মোটেই সম্ভব হয়নি, করোনা এসে এক নিমেষে সেই খাঁটি সত্যটাই উন্মোচিত করে দিল।
বলল বাঁচতে হলে পালাও, গুহার ভেতর ঢোকো। অন্যের সঙ্গে মিলবে না। দূরে দূরে থাকবে। মনে করবে সবাই তোমার শত্রু। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলো। শারীরিক দূরত্বকে যে সামাজিক দূরত্ব বলা হচ্ছে এটা নিতান্ত আপতিক নয়, ঘটনা আসলে সামাজিক দূরত্বই। মানুষ যদি মানুষকে দেখে ভয় পায়; পরস্পরের হাত ধরবে কি, বরং হাত যাতে না ধরতে হয় তার বন্দোবস্ততে যদি সে সর্বক্ষণ উদগ্রীব থাকে, তাহলে তো বুঝতেই হবে যে মানুষ তার সামাজিকতার সবটাই খুইয়েছে। আর সামাজিকতা না থাকলে তো মানুষ আর মানুষই থাকে না, পশুতে পরিণত হয়। সেটাই ঘটছে। রোগী দেখলে প্রতিবেশী সাহায্য করবে কি দৌড়ে পালাচ্ছে। রোগাক্রান্ত বৃদ্ধ পিতামাতা মারা গেলে কাফন-দাফন করতে হবে ভয়ে পরিচয়ই দিতে চাচ্ছে না সন্তানরা; এমনও হয়েছে লাশ ভাগাড়ে ফেলে দিয়ে দ্রুত সটকে পড়েছে। অবিশ্বাস্য? হ্যাঁ, অবিশ্বাস্যতাই ঘটছে।
টাইম ম্যাগাজিন 'কোঅপারেশন'-এর আবশ্যকতার কথা বলেছে। কার বিরুদ্ধে? টাইমওয়ালারা অবশ্যই বলবে করোনার বিরুদ্ধে। বলে ক্ষান্ত দেবে। করোনা একটা ভয়াবহ রোগ, তার হাত থেকে বিশ্বকে বাঁচাতে হবে, সে জন্য সমবায়ী উদ্যোগে টিকা আবিস্কার চাই। কিন্তু আসল ব্যাধি তো করোনা নয়, সেটির নাম তো পুঁজিবাদ। সেই ব্যাধিই তো এই রোগকে পাঠিয়েছে। আর পুঁজিবাদের যেটা আসল স্বভাব- উন্নত করার নাম করে মানুষকে মারার ব্যবস্থা করা, পুঁজিবাদ সেটাই করছে। সে জন্যই বলা দরকার যে ঐক্য চাই কেবল করোনাকে নয়, পুঁজিবাদকে পরাভূত করার লক্ষ্যেও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এখন বেশ একটু কাহিল অবস্থাতেই আছে, তবু তার মধ্যেও সে আওয়াজ দিয়েছে যে বিশ্বের জন্য করোনার চাইতেও বড় বিপদ হচ্ছে করোনাকে মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজনীয় নেতৃত্ব ও ঐক্যের অভাব। তাদেরও ওই একই কথা, ঐক্য চাই টিকা ও চিকিৎসার সুব্যবস্থা করার জন্য। বলবে না, বলতে পারবে না যে, নেতৃত্ব ও ঐক্য চাই কেবল করোনাকে রোখার জন্য নয়, ঐক্য চাই করোনার যে আস্তানা তাকে ভেঙে ফেলার জন্যই। বললে তার মুখ পুড়ে যাবে। এমনিতেই তার কাহিল দশা; পুঁজিবাদী শিরোমণি ডোনাল্ড ট্রাম্প তা বলেই দিয়েছেন, এক পয়সা চাঁদা দেবেন না এবং সেখানেই ক্ষান্ত থাকেননি; ঘোষণা জারি করেছেন যে ডব্লিউএইচওর সঙ্গে তার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো রকমের সম্পর্কই রাখবে না। ডব্লিউএইচও বাড়াবাড়ি করলে অন্য পুঁজিবাদীরাও তার ওপর ওইভাবেই হামলে পড়বে। সব শেয়ালের একই রা।
এই দুনিয়াতে এখন কোটি কোটিপতিদের সংখ্যা একশ' দুশ' নয়, তিন হাজারের কাছাকাছি। তাদের মধ্যে সেরাদের একজন হচ্ছেন বিল গেটস। দাতব্যের জন্যও তিনি বিখ্যাত। করোনা মোকাবিলার ব্যাপারে তিনিও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতোই উদ্বিগ্ন। প্রবন্ধ লিখে পরামর্শ দিয়েছেন। তার লেখা দুটি প্রবন্ধ দেখলাম। তিনি মহাজন, তার বক্তব্য তাই বিশ্বজুড়ে প্রচার পেয়েছে। প্রথম বক্তব্য ছিল, করোনার মুখোমুখি বিশ্বের এখন এক নম্বর কর্তব্য হচ্ছে সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া, শাটডাউন করা, অন্যরা যাকে বলছে লকডাউন সেটা করা। ভালো কথা, এই লকডাউন জিনিসটা ঠিক লকআপ নয়। পার্থক্য আছে, লকআপ করে কারাকর্তৃপক্ষ, কারাবন্দিদের তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে খুপরির ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। আর লকডাউন হচ্ছে স্বেচ্ছায় বন্দি হওয়া, আত্মরক্ষার জন্য। পরিণাম অবশ্য একই। আটক থাকা। বিল গেটস সাহেবের দ্বিতীয় পরামর্শ টেস্ট করো; রোগের সংক্রমণ ঘটেছে কিনা সেটা পরীক্ষা করে দেখ। টেস্ট, আরও টেস্ট। তার তিন নম্বর কথা টিকা আবিস্কার চাই। তার উদ্বেগ মর্মস্পর্শী।
বিল গেটস সাহেব সুপ্রসিদ্ধ জ্ঞানী, তিনি সবই জানেন, শুধু এটুকু জানেন না যে আসল ব্যাধিটি হচ্ছে পুঁজিবাদ, যার ওপরে তার ও তাদের ধনবৃদ্ধির পূর্ণ নির্ভরতা। তবে এই মহাসংকটের সময়ে তিনি কেবল পরামর্শই দেননি, চিকিৎসা ও ত্রাণের জন্য দানও করেছেন, যদিও দানের পরিমাণ খুবই সামান্য। তার মোট সম্পদের একশ' ভাগের এক ভাগও নয়, শূন্য দশমিক দুই আট (০.২৮) শতাংশ মাত্র। আমরা নিশ্চিত নই যে, কোনটি অধিক মূল্যবান, তার দান নাকি তার উপদেশ। অবশ্য উপদেশও এক প্রকারের দান বটে। তবু তিনি যা হোক হাত উপুড় করেছেন, অন্য ধনীরা সেটাও করেননি।
মানুষ কিন্তু দিচ্ছে, মেহনতিরা মানুষের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান যে বস্তু সেই প্রাণটিই দিয়ে দিচ্ছে। দিতে বাধ্য হচ্ছে। হ্যাঁ, ধনীরাও আক্রান্ত হচ্ছে বৈকি। ব্রিটেনের যুবরাজ, সেখানকার প্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর বান্ধবী- এরাও আক্রান্ত হয়েছেন। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী, যিনি সদাসর্বদা গর্জন করেন ফিলিস্তিনিদের গিলে খাবেন বলে, তিনিও আক্রান্ত হয়েছেন সস্ত্রীক। ব্রাজিলের ডানপন্থি প্রেসিডেন্ট করোনা কিছু না, ইনফ্লুয়েঞ্জা মাত্র, তাই ভয় করার কিছু নেই বলে তুড়ি বাজিয়েছেন এবং দম্ভভরে বলেছেন তার নিজের জন্য কোনো পরোয়াই নেই কারণ বয়স যদিও পঁয়ষট্টি তবু তিনি একজন ক্রীড়াবিদ; শেষ পর্যন্ত তিনিও আক্রান্ত হয়েছেন। বন্ধু ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরামর্শমতো ম্যালেরিয়া প্রতিষেধক ওষুধের ওপর তিনি ভরসা করেছিলেন, কাজ হয়নি। জার্মানরা মনের শক্তিতে বিলক্ষণ বলীয়ান বলে পরিচিত, কিন্তু জানা গেছে তাদের অর্থমন্ত্রী আত্মহত্যা করেছেন। যা দেখেছেন ও দেখবেন বলে ভয় পেয়েছেন তা সহ্য করতে পারেননি।
সব মৃত্যুই দুঃখজনক ও শোকাবহ। কিন্তু আমরা বিশিষ্টজনের মৃত্যুর খবরই শুধু জানতে পারি। মেহনতিদের প্রাণত্যাগের খবর কে রাখে? তারা মারা যাচ্ছে হাজারে হাজারে। যারা বাঁচছে তারাও অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে পড়ছে। কিন্তু তারা তো পরিসংখ্যানের অকিঞ্চিৎকর সংখ্যা মাত্র; সম্পদ বলতে আছে শুধু একটা প্রাণ, আক্রান্ত হয়ে ওটি ত্যাগ করেই কোনোমতে যন্ত্রণামুক্ত হচ্ছে।
বলা হচ্ছে করোনাভাইরাস প্রকৃতির সৃষ্টি, মানুষের নয়। এক অর্থে দাবিটি মিথ্যা নয়, যদিও পুঁজিবাদী বিশ্বেরই একাংশ বলে বেড়াচ্ছে যে চীনের মনুষ্যবিনাশী জীবাণু তৈরির এক গবেষণাগার থেকেই ফাঁকফোকরে কোনো একটি জীবাণু বেরিয়ে গিয়ে এমন দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। এ নিয়ে আবার তদন্তও হবে বলে শোনা যাচ্ছে। তা হোক। আমরা মেনে নিলাম যে রোগটি এসেছে প্রকৃতি থেকেই। কিন্তু প্রকৃতির কেন হঠাৎ এমন দুর্বুদ্ধি হলো যে সে বেরিয়ে পড়ল মানুষ মারার মিশন নিয়ে? প্রকৃতির তো এটা স্বাভাবিক কাজ নয়। তার জন্য স্বাভাবিক কাজ হচ্ছে নিজে বেঁচে থাকা। তাহলে? আসলে প্রকৃতির এই অস্বাভাবিক কাজের জন্য প্রকৃতি নিজে দায়ী নয়, দায়ী মানুষই। সব মানুষ নয়, পুঁজিবাদী মানুষ, প্রকৃতিকে যারা পণ্যে পরিণত করেছে এবং উত্ত্যক্ত করেছে সর্বক্ষণ। প্রকৃতি তার নিজস্ব প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। জানানোটাই স্বাভাবিক। প্রকৃতিরও তো প্রাণ আছে; প্রাণ বাঁচার দায় আছে। প্রাণের ওপর আঘাত করলে প্রত্যাঘাত তো সে করবেই।
এক সময়ে মহামারি প্লেগও মনুষ্যদেহে এসেছিল প্রাণীদেহ থেকেই। প্রচলিত গল্পটা এই রকমের। এক পাদ্রি তার বক্তৃতায় ভক্তদের জোরেশোরে বলেছিলেন যে শয়তান নানা রূপ ধারণ করে থাকে। তবে শয়তানের প্রিয় রূপটি হচ্ছে বিড়াল। সেই কথা শুনে বিড়াল-হত্যার ধুম পড়ে যায়। পাদ্রি অবশ্য কালো বিড়ালের কথা বলেছিলেন, কিন্তু কালো-ধলো সব বিড়ালেরই নিধন চলে। বিড়াল মারা পড়ায় সুবিধা হয় ইঁদুরদের, তারা নিরাপদে বংশবৃদ্ধি ঘটাতে থাকে। ইঁদুররা নোংরা স্যাঁতসেঁতে জায়গাতে থাকতে পছন্দ করে; সে রকম পরিবেশে থাকতে থাকতে তাদের গায়ে প্লেগের ভাইরাস জমে। একেকটির গায়ে হাজার হাজার ভাইরাস। ইঁদুরের স্বভাব যেখানে-সেখানে মুখ দেওয়া। তাদের মুখ স্পর্শ থেকে প্লেগের ভাইরাস চলে যায় মানুষের দেহে। এভাবে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে এবং মহামারির আকার ধারণ করে। এবার চীনে করোনা হয়তো বাজারে আনা বাদুড় থেকে চলে গেছে আরেক ছোট প্রাণী প্যাঙ্গোলিনের দেহে এবং সেখান থেকে মানুষের দেহে ঢুকেছে।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়