কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগে বিতর্কিত ব্লাসফেমি আইনে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে পাকিস্তানের এক শিক্ষাবিদ ও প্রফেসরকে। দেশটির মুলতান জেলা ও সেশন কোর্টের বিচারক শনিবার এ রায় দেন। এর ফলে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় উঠেছে। পাকিস্তানের এমন বিচারব্যবস্থা নিয়েও উদ্বেগ জানিয়েছে দেশটির মানবাধিকার সংস্থাগুলো। এ খবর দিয়েছে আল-জাজিরা।
মুলতানে বাহাউদ্দিন জাকারিয়া ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি সাহিত্য বিভাগে ভিজিটিং লেকচারার ছিলেন তিনি। কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগে ২০১৩ সালের ১৩ই মার্চ তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বিচারকাজ শুরু হয় ২০১৪ সালে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি ইসলামের নবী ও মুসলিমদের কাছে পবিত্র গ্রন্থ কোরানের অবমাননা করেছেন।
মুলতানের ওই আদালত তার বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে। দীর্ঘ বিচারকার্য শেষে শনিবার তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
নিউ সেন্ট্রাল জেল মুলতানে উচ্চ নিরাপত্তা সম্বলিত ওয়ার্ড নাম্বার দুইয়ে রাখা হয়েছে হাফিজকে। এর আগে তার পক্ষে আইনজীবী ছিলেন রশিদ রেহমান। কিন্তু ২০১৪ সালের মে মাসে ইসলামপন্থিরা প্রকাশ্যে ঘোষনা দিয়ে তার অফিসে ঢুকে তাকে গুলি করে হত্যা করে। হত্যার পূর্বে আদালতের কার্যক্রম চলাকালীনই পাকিস্তানি ধর্মীয় নেতারা ও আইনজীবীরা তাকে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। তাকে হত্যার পর থেকে এই বিচারকার্য উচ্চ নিরাপত্তাযুক্ত জেলে চলে আসছে। এ বছরের শুরুতে সাবেক প্রধান বিচারপতি আসিফ সাঈদ খোসার কাছে সন্তানকে মামলা থেকে মুক্তি দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন হাফিজের পিতামাতা। তারা সন্তানের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।
হাফিজের বর্তমান আইনজীবী নিজেও ইসলামপন্থীদের হুমকির মুখে রয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, আদালতে মামলা চলাকালীন যে পরিবেশ সৃষ্টি করা হয় তা ভয়াবহ। তিনি লাহোর হাইকোর্টে এ মামলা নিয়ে আপিল করবেন বলে জানান। এমন পরিবেশে কোনো বিচারক ন্যায় বিচার করার ঝুঁকি নেবে না বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
হাফিজের আইনজীবী আরো বলেন, হাফিজ বেশ উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছেন। তিনি স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারছেন না। যখন আমি তার সঙ্গে কথা বলতাম তিনি সবসময় হাসিমুখে কথা বলতেন। কিন্তু এতদিনের নির্জন কারাবাসের কারণে তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
এদিকে, বৃটেনভিত্তিক অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই রায়কে প্রহসন বলে আখ্যা দিয়েছে। অ্যামনেস্টির পাকিস্তান বিষয়ক গবেষক রাবিয়া মেহমুদ বলেন, জুনায়েদ হাফিজের মৃত্যুদণ্ড আইনের অপব্যাবহারের স্পষ্ট উদাহরণ। মুলতান আদালতের এই রায় চূড়ান্ত পর্যায়ের হতাশাজনক ও বিষ্ময়কর। জুনায়েদের এই দীর্ঘ মামলা ও তার রায় পুরোটাই একটি প্রহসন ও পক্ষপাতদুষ্ট।
শনিবার এই রায়ের নিন্দা জানিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশনও। এতে বলা হয়, এই রায়ে ভীতির প্রদর্শন হয়েছে। পাকিস্তান মানবাধিকার কমিশন বিশ্বাস করে, ব্লাসফেমি আইনের যথেচ্ছ অপব্যাবহার হচ্ছে। সংস্থাটি আশা প্রকাশ করে, উচ্চ আদালতে আপিলে তার মৃত্যুদণ্ড বাতিল হয়ে যাবে।
উল্লেখ্য, সন্ত্রাসবাদের উচ্চহারের জন্য পরিচিত পাকিস্তানে ধর্ম অবমাননা একটি অতি স্পর্শকাতর বিষয়। সেখানে ইসলামের নবী ও মুসলিমদের কাছে পবিত্র গ্রন্থ কোরান অবমাননার কারণে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। দিনদিন দেশটিতে এ সংক্রান্ত অভিযোগের জেরে বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ড ও দলবদ্ধ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বাড়ছে। আল-জাজিরার হিসেবে, ১৯৯০ সালের পর থেকে দেশটিতে অন্তত ৭৫ জন মানুষকে এমন অভিযোগে মধ্যযুগীয় কায়দায় হত্যা করা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে, যাকে অভিযুক্ত করা হয়, যিনি তার পক্ষে আদালতে লড়েন, তার পরিবারের সদস্য ও যে বিচারক ঝুঁকি নিয়ে এসব মামলায় নিরপেক্ষ রায় দেন। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দাবি, পাকিস্তানে সংখ্যালঘু ও ভিন্নমত পোষণকারীদের দমাতে প্রচলিত এই মধ্যযুগীয় আইনের অপব্যাবহার বেড়ে চলেছে।