আমি হব সকাল বেলার পাখি, সবার আগে কুসুম বাগে উঠব আমি ডাকি। কবিতার লাইন দুটি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের। তিনি সকাল বেলার পাখি হতে চেয়েছেন। সকালের সূর্য উঠার আগে ঘুম হতে জাগার প্রত্যাশা করেছেন। সেই আমি হব কবিতাটির তাত্পর্য বর্তমান সময়ে ব্যক্তিগত জীবনে খুব প্রয়োজন বলে মনে হচ্ছে। কারণ ফেসবুক আসক্তি কেড়ে নিচ্ছে হাজারো সম্ভাবনাময়ী তরুণ-তরুণীর গুরুত্বপূর্ণ সময়। কেড়ে নিচ্ছে চোখের ঘুম। মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের সম্ভাবনাময়ী তারুণ্য।
মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী সবার ফেসবুক আইডি থাকাটা স্বাভাবিক। সবাই ভালো কিছু করার উদ্দেশ্য নিয়ে ফেসবুক আইডি ব্যবহার করে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় তা নেশায় পরিণত হয়ে যায়। একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে বিষয়টি বেশি লক্ষ্য করা যায়। গভীর রাত পর্যন্ত ফেসবুক চালানোয় সকালের ক্লাসটি করা হয় না তাদের। সবচেয়ে মারাত্মক ব্যাপার হচ্ছে সকালের নাস্তা না করে তাড়াহুড়ো করে ক্লাসে যাওয়া। যার ফলে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তারা।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পৌনে সাত কোটি ইন্টারনেট গ্রাহকের মধ্যে ফেসবুক ব্যবহারকারী আড়াই কোটি। এক গবেষণায় দেখা গেছে, শুধুমাত্র ৫% মানুষ একাডেমিক উদ্দেশ্যে, নিউজ আপডেট পেতে ২২%, অবসর সময় ব্যয় করেন ২৪%, গেম ৫৩%, ৫২.২% শিক্ষার্থী বেডরুমে এবং খেলার মাঠ কিংবা অন্য কাজে ৫১.৫% মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে থাকেন। এসব ব্যবহারকারীদের অধিকাংশের বয়স ১৭ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকরা বিভিন্ন বয়সী ফেসবুক ব্যবহারকারীদের উপর গবেষণা করে দেখেন যে, ‘ফেসবুক ব্যবহারকারীদের বিশেষ করে অল্পবয়সীদের সমাজ থেকে পৃথক করে দিচ্ছে। এ ছাড়াও তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি একা হয়ে যাচ্ছে।’
কেউবা এতটাই আসক্ত হয়ে যাচ্ছে খাওয়া, রাস্তা দিয়ে হাঁটা এমনকি পড়ার সময় ফেসবুক চালাচ্ছে। বর্তমানে ফেসবুককে নানা কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতারক চক্র ফেসবুক ব্যবহার করে মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এছাড়াও ফেসবুকের সাহায্য নিয়ে প্রশ্ন ফাঁসকারী চক্র বিভিন্ন পরীক্ষায় লাগাতার প্রশ্নফাঁস করে গেছে। যার ফলে সেই সময়টাতে শিক্ষামন্ত্রী কয়েক ঘণ্টার জন্য ফেসবুক বন্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। তবে আসক্তির পরিমাণ এতটাই প্রবল যে, ওই ঘোষণায় ক্ষোভে ফেটে পড়েন অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারী। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে বর্তমান সময়ে ফেসবুক কতটা ভয়ানক।
ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা দিন দিন পালাক্রমে বেড়েই চলছে। ফলে ফেসবুকে আসক্ত হয়ে পড়ছে যুবক-যুবতিরা। চার-পাঁচ বন্ধু একসঙ্গে থাকে ঠিকই কিন্তু নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতা রেখে ফেসবুকে আলাপচারিতা চলে। যার ফলে দিন দিন নিজেদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক সময় স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভাঙনের কারণ হয়ে দাঁড়ায় ফেসবুক। অতিরিক্ত ব্যবহারে অলস সময় কাটিয়ে কর্মক্ষমতা হারাচ্ছে হাজারো সম্ভাবনাময়ী তরুণ-তরুণী। ভুয়া আইডিতে প্রেমের ফাঁদে পা দিয়ে আত্মহত্যার নজিরও রয়েছে অনেক। ফেসবুক শুধু যে আসক্তি ঘটাচ্ছে তা কিন্তু নয়। যারা সঠিক পন্থায় এটিকে কাজে লাগাতে পারছে তারাই সফল হচ্ছে। তার নজির আমরা হরহামেশাই দেখতে পাই। ১০ মিনিট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আয়মান সাদিক। যিনি ফেসবুকের কল্যাণে দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও সুনাম অর্জন করে চলেছেন। এই আসক্তি হতে মুক্ত হয়ে ওঠা ড্যানিয়েল ওয়ালেন নামের এক যুবক পাঁচটি কারণ দাঁড় করেছেন। প্রথমত অযথা বসে থাকার বদঅভ্যাস, মাত্রাতিরিক্ত অপ্রয়োজনীয় অনুভূতি প্রকাশ, অযথাই আঁকড়ে থাকার বদঅভ্যাস, অধৈর্য হয়ে বারবার নোটিফিকেশনে চোখ রাখা ও কোনো কিছু মিস না করতে ক্রমাগত নিউজফিড রিফ্রেশের অভ্যাস। এসব বিষয়গুলো হতে মুক্ত হতে পারলে ফেসবুক আসক্তি হতে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তাই রাতের অন্ধকারে ফেসবুকের আলোয় মুখ আলোকিত না করে, সকালের সূর্যের আলোয় মুখ আলোকিত করি। ফেসবুক আমাদের যেন ব্যবহার না করে, আমরা যেন ফেসবুক ব্যবহার করি। ফেসবুককে নেশা না বানিয়ে, সুস্থ জীবন অতিবাহিত করি।
লেখক :শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।