গ্রাম থেকে শহর- সর্বত্র একটা উৎসব উৎসব ভাব। তবে নির্বাচনী উৎসব বাদেও দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের প্রায় সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থী অপেক্ষায় আছে একটি অন্য উৎসবের। আর সেটা হলো 'বই উৎসব'। সরকার কর্তৃক বিনামূল্যে বিতরণের জন্য এসব বই ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন স্কুলে পৌঁছানো শুরু করছে।
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে অন্যবারের মতো এবারও বছরের শুরুতেই এসব বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানোর কথা। প্রাথমিক শিক্ষার বই আগে থেকেই বিনামূল্যে বিতরণ করা হতো। তবে প্রথমবার মাধ্যমিক স্তরে বিনামূল্যে বই বিতরণ শুরু হয় ২০১০ শিক্ষাবর্ষ থেকে চলমান সরকারের প্রথম মেয়াদে। শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের এটি একটি মহতী উদ্যোগ, তা সরকারের কঠোর সমালোচকরাও হয়তো অস্বীকার করতে পারবে না।
প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি পেরিয়ে শুধু বই কেনার টাকা জোগাড় করতে না পারায় অনেকের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে এ রকম ঘটনা অহরহ। মাধ্যমিক স্তরের বইও বিনামূল্যে বিতরণ শুরু হওয়ায় এ সমস্যা আর থাকল না। প্রাথমিক শিক্ষার পরেই ঝরেপড়া শিক্ষার্থীর হার কমাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে এই বিনামূল্যে বই বিতরণ কর্মসূচি।
গত বছর জানুয়ারির ১ তারিখে 'জাতীয় পাঠ্যপুস্তক উৎসব' নামে বই বিতরণ কর্মসূচি পালন করা হয়। আর এই কর্মসূচির মাধ্যমে চার কোটি ৪২ লাখ চার হাজার ১৯৭ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩৫ কোটি ৪২ লাখ ১০ হাজার ১৬২ কপি নতুন বই বিতরণ করা হয়। এ বছর শিক্ষার্থী সংখ্যা এবং বিতরণকৃত বইয়ের সংখ্যা দুটিই বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
২০১০ খ্রিস্টাব্দের আগে এ বই নিয়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের ভোগান্তির অন্ত ছিল না। টাকা দিয়ে বই কিনতে হতো সেটা তো আছেই, টাকা দিয়েও সময়মতো বই পাওয়া যেত না। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজারে বইয়ের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করত অধিক মুনাফার আশায়। অনেক সময় একেকটি বই তার মূল দামের আড়াই গুণ-তিনগুণ বেশি টাকা দিয়ে কিনতে হতো। আর একসঙ্গে পাঠ্যসূচির সব বই কেনার কথা তো চিন্তাই করা যেত না। একটি-দুটি করে বই বাজারে আসত। পাঠ্যসূচির সব বই কিনতে অনেক সময় ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসও পার হয়ে যেত। এর ফলে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতো।
সরকারের বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণের এই উদ্যোগ ওই সব সমস্যাকে একসঙ্গে উড়িয়ে দিয়েছে। এখন শিক্ষার্থীরা আক্ষরিকভাবেই বছরের একেবারে শুরুতে নতুন ঝকঝকে তকতকে বইগুলো হাতে পেয়ে যাচ্ছে। এই বই বিতরণ কর্মসূচির আরেকটি ভালো দিক হচ্ছে, দেশের সব জায়গায় বই একই সঙ্গে দেওয়া হয়। শহর-গ্রাম ভেদাভেদ নেই। রাজধানীর বুকে বসে থাকা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যেদিন বই পায়, উপকূলীয় জেলা বরগুনার প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি স্কুলের শিক্ষার্থীরাও একই দিনে পায়। তবে এর মধ্যেও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে।
বই বিতরণ শুরু হওয়ার পরের কয়েকদিন প্রায়ই পত্রপত্রিকায় দেখা যায় যে, সরকার কর্তৃক প্রদত্ত বিনামূল্যের বই বিতরণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্কুল শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে। কোনো কোনো স্কুল সরাসরি টাকা নিচ্ছে আবার কোনো কোনো স্কুল বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে টাকা নিচ্ছে, যা সম্পূর্ণ বেআইনি। যদিও এ রকম ঘটনার সংখ্যা অনেক কম; তারপরও কর্তৃপক্ষের এ ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখা উচিত। বই বিতরণ কর্মসূচি একটি সত্যিকারের উৎসব। অন্যায়ভাবে টাকা নিয়ে সেই উৎসবে যাতে কেউ কালিমা লেপন করতে না পারে। আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক মনে করছি।
প্রতিটি নির্বাচনের পরেই নির্বাচন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহ্নত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বেশ কিছু নির্বাচনী সহিংসতার শিকার হয়। স্কুল ঘরে আগুন দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে অতীতে। এ বছর বই উৎসবের ঠিক আগেই জাতীয় নির্বাচন হতে যাচ্ছে। নির্বাচন যেন বই উৎসবের ব্যাঘাতের কারণ না হয়, সেটাই কাম্য।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়