বই নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে - Dainikshiksha

বই নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে

ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী |

মানুষের মৌলিক অধিকার শিক্ষাকে সাজাতে হয় তার সর্বজনীনতা ও বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সৃজনশীলতায়। আর এ জন্য প্রয়োজন শিক্ষা নিয়ে গবেষণা। শিক্ষাক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক বিশ্লেষণ দরকার। আবার শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির যোগসূত্র তৈরি করতে না পারলে তা নিজেকে ও নিজের শিকড়কে চেনার, জানার ও চর্চার ক্ষেত্রে এক ধরনের সংকীর্ণ মনোভাব গড়ে ওঠে। শিক্ষা ও সংস্কৃতির মূল লক্ষ্য হলো মানবকল্যাণ। কাজেই উদ্দেশ্য যেখানে সমান্তরাল, সেখানে একটিকে অপরটির প্রতিবন্ধক হিসেবে কখনোই বিবেচনা করা যায় না। শিক্ষা ও সংস্কৃতি একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। যেখানেই একটি অগ্রসরমাণ সংস্কৃতি আছে, সেখানেই গৌরবান্বিত হওয়ার মতো শিক্ষাকাঠামো গড়ে উঠেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, সময়ের সঙ্গে শিক্ষা রূপান্তরিত হতে পারে আর অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার রূপান্তরণের বিষয়টি সাংস্কৃতিক ধারণাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। এখানে প্রশ্ন হতে পারে, যদি নিজস্ব সাংস্কৃতিক ভাবধারায় শিক্ষার কাঠামো গড়ে ওঠে, তবে কিভাবে একটি বিদ্যমান সংস্কৃতির পরিবর্তনশীলতা ঘটে। প্রকৃত অর্থে সংস্কৃতির রূপান্তর উন্নত, উদার ও কল্যাণমুখী শিক্ষার চর্চা ও তার বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমে সম্ভব।

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা-ভাবনা তাঁর সময়কে অতিক্রম করে আধুনিক চিন্তাধারার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। প্রকৃতির সঙ্গে ব্যক্তির, ভাবনার সঙ্গে কর্মের, জ্ঞানের সঙ্গে মানবিক মূল্যবোধের, স্থানিকতার সঙ্গে বিশ্বায়নের, গ্রহণের সঙ্গে বিতরণের আর আনন্দের উপাত্ত হিসেবে শিক্ষা লাভের ও তার বিকাশের যে চিন্তা তিনি করেছিলেন, তা আজও প্রাসঙ্গিক। আর এটি হলো শিক্ষা ও সংস্কৃতির পারস্পরিক সম্পর্কের চিরায়ত রূপ। মানুষের ভেতরের অন্তর্নিহিত শিক্ষার আস্বাদন নিংড়ে বের করার মধ্যেই শিক্ষার সাফল্য। শিক্ষায় কখনো শ্রেণিবৈষম্য থাকতে পারে না। শিক্ষার শ্রেণিবিভাজন সমাজ, শিক্ষা আর সংস্কৃতির মধ্যে বিভাজন তৈরি করে। কাজেই শিক্ষা হতে হবে সংস্কৃতিবান্ধব। বিজ্ঞানচর্চা, সমাজ, দর্শন আর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমেই একমুখী শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার ভিত্তি গড়ে তুলতে পারে। শিক্ষা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হতে পারে, তবে তা যেন কখনো মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
দুই.

মা যখন সন্তানের সঙ্গে কথা বলেন, যখন ঘুম পাড়ানি গান শোনান, শিশু যখন হাঁটি হাঁটি পা পা করে চলতে শুরু করে তখন থেকেই ক্রিটিক্যাল অ্যানালিসিসের প্রক্রিয়াটি আরো পূর্ণতা লাভ করে। কারণ একটি শিশু যখন কথা বলতে শুরু করে, আনন্দে নেচে ওঠে আর কারো সাহায্য ছাড়া হাঁটতে শুরু করে তখন বোঝা যায়, শিশুটি প্রকৃতি, মানুষ আর তাদের জীবনাচরণকে বিশ্লেষণ করে তার মধ্যে এই সক্ষমতা গড়ে তুলেছে। ফলে শিশুটির শেখার আগ্রহ বেড়ে যায়। এটা তার শিক্ষার হাতেখড়ি বলা যায়। কিন্তু ভোগবাদী ও বস্তুবাদী শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে যখন সে পদার্পণ করে তখন তার ক্রিটিক্যাল অ্যানালিসিস করার যে সক্ষমতা গড়ে উঠেছিল, তা রুদ্ধ হয়ে যায়। ফলে শিক্ষাকে প্রকৃত অর্থে গ্রহণ করার পরিবর্তে তার মধ্যে কৃত্রিম শিক্ষা গ্রহণের প্রবণতা বাড়ে। বইয়ের বোঝা তার মধ্যে জ্ঞান সৃষ্টির উপাদান হিসেবে কাজ না করে তা এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করে। ফলে শিক্ষা তার মূল উদ্দেশ্য হারায়। প্রশ্ন হতে পারে, তার মধ্যে প্রকৃতিগতভাবে ক্রিটিক্যাল অ্যানালিসিস করার যে সক্ষমতা জন্মের আগে থেকেই তৈরি হয়েছিল, তা থেকে সে কেন বিচ্যুত হয়ে পড়ল।

তার বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সেটিও তো বেড়ে ওঠার কথা। প্রকৃতপক্ষে এমনটিই ঘটার কথা ছিল; কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থার গলদের কারণে তা তার গতিপথ হারায়। এর পরিণতিতে শিক্ষিত হয়েও মানুষের মধ্যে স্বশিক্ষা থাকে না। এর জন্য প্রয়োজন শিক্ষাকে সহজ করে জীবনমুখী করে তোলা। আর এটি সম্ভব হলে ক্রিটিক্যাল অ্যানালিসিস তার বাড়ার সক্ষমতা বজায় রেখে শিক্ষিত মানুষের মধ্যে স্বশিক্ষার শিকড় শক্ত করে ধরে রাখত। আর প্রকৃত শিক্ষার মূল্য এখানেই। শিক্ষাকে যদি প্রকৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হতো, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের সঙ্গে যুক্ত করা হতো, বিজ্ঞানকে যদি হাতে-কলমে আনন্দের ও সৃষ্টির অনুসর্গ হিসেবে চিন্তা করা হতো, জীবন, মানুষ, বাস্তবতাকে চেনা ও জানার আগ্রহ সৃষ্টির প্রয়াস থাকত, তবে ক্রিটিক্যাল অ্যানালিসিস করার সক্ষমতা বাড়তে থাকত; যা শিশুকে আনন্দপূর্ণ জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে একদিন পরিপূর্ণ একজন মানুষে পরিণত করত। হয়তো একদিন তেমনটিই ঘটবে। কারণ আমরা আশাবাদী আর হার না মানা এক বীর জাতি।

তিন.

জসীমউদ্দীন বলতেন, বই হলো এমন একটা জিনিস, যা একজন মানুষকে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ—যেকোনো কালেই নিয়ে যেতে পারে। যে দেশে কোনো দিনও যাওয়ার সম্ভাবনা নেই, বইয়ের পাতার রথ মানুষকে সে দেশেও নিয়ে যেতে পারে। কথাটা মিথ্যা নয়। কারণ বই হলো জীবন ও বিবেকের দর্পণ। ‘দেশে-বিদেশে’ বইটিতে উনিশ শতকের বিশের দশকের আফগানিস্তানের বর্ণনা করেছেন মুজতবা আলী। তাঁর মধ্যে কাজ করেছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদর্শ। অনেকেই বলেন, বইটি পড়ার সময় তাঁদের মনে হয়েছে, তাঁরা আফগানিস্তানের মরুময় পথ-ঘাট, পাহাড়-পর্বত আর মানুষকে খুব কাছ থেকে দেখছেন।

বইয়ের অক্ষর যে জীবন্ত হতে পারে, এটি তার উদাহরণ। আবার ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়ে অনেকের মনে হয়েছে, তাঁরা যেন ইতিহাসকে দেখছেন খুব কাছ থেকে। তাঁরা যেন ইতিহাসের সঙ্গে চলেছেন এক স্বাধীন বাংলাদেশ পাওয়ার তীব্র বাসনায়। এ ধরনের জীবন্ত বইগুলোর আদলে যদি পাঠ্য বইগুলো শিক্ষার প্রধান উপকরণ হিসেবে প্রচলিত থাকত, তবে বইকে বোঝা না মনে করে মানুষ তার জীবন ও সৃজনশীলতার অংশ হিসেবে গ্রহণ করত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাঠ্য বইগুলোর করুণ দুর্দশা দেখে বলেছিলেন, মুখস্থ করিয়া পাস করাই তো চৌর্যবৃত্তি! যে ছেলে পরীক্ষাশালায় গোপনে বই লইয়া যায়, তাকে খেদাইয়া দেওয়া হয়; আর যে ছেলে তার চেয়েও লুকাইয়া লয়, অর্থাৎ চাদরের মধ্যে না লইয়া মগজের মধ্যে লইয়া যায়, সে-ই বা কম কী করিল? তাই শিক্ষাকে আলোকিত করার মাধ্যমে সোনার মানুষ তৈরির জন্য বই নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও

প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ - dainik shiksha এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0080900192260742