দিন দশেক আগে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে গিয়েছিলাম। আমার শিক্ষক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। একপর্যায়ে কথা প্রসঙ্গে কষ্টের সঙ্গে স্যার বলছিলেন বই-বিচ্ছিন্ন এই দেশে কী হবে! সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা থেকে বললেন— সরকারি কর্মকর্তাদের একটি ট্রেনিং প্রোগ্রামে গিয়েছিলেন বক্তৃতা করতে। বক্তৃতার মাঝখানে লক্ষ করলেন কয়েকজন ঘুমাচ্ছেন। অন্যদের মনোযোগ কতটা আছে বুঝতে পারছিলেন না। তবুও এই বিপন্ন সময়ে বইপড়া কর্মসূচি, আলোর স্কুল পরিচালনা, ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আলোকিত মানুষ গড়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন স্যার। যখন আমরা দেখি স্কুল আর কলেজ লাইব্রেরির আলমিরা বছরজুড়ে তালা বন্ধ থাকে তখন অনেক স্কুলে লাইব্রেরি চর্চার সুযোগ করে দিচ্ছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। কিন্তু একটি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আর একজন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ কতক্ষণ আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে এগিয়ে যাবেন!
ছেলেবেলায় স্কুলে বিজ্ঞান নিয়ে রচনা লিখতে গিয়ে এই মুখস্থবিদ্যা দিয়ে প্রায় সকলেই শুরু করতাম যে, ‘বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ আর কেড়ে নিয়েছে আবেগ।’ বড় হয়ে এ কথার তাত্পর্য খুঁজতাম। মাঝে মাঝে মনে হতো কথাটির মধ্যে যুক্তি আছে, আবার বড় একপেশে মন্তব্য বলেও মনে হতো। আমি অনেকদিন থেকে একটি গণ্ড গ্রাম খুঁজে বেড়াচ্ছি। এখনো কেউ সন্ধান দিতে পারেনি। যে-গ্রামে বড় সংখ্যক মানুষ যাতায়াতের অব্যবস্থার কারণে রাজধানী দূরের কথা নিজ জেলা শহরেও কখনো আসেনি। বিদ্যুতের দেখা পায়নি। শহর থেকে কোনো আত্মীয় দৈবাত্ বেড়াতে গেলে যারা মনে করে অন্য গ্রহের মানুষ। পাড়া ভেঙে মানুষ দলে দলে একনজর দেখতে আসে। দূরের আত্মীয় হলেও একবেলা অন্তত পিঠে খাওয়াতে না পারলে যেন কারো স্বস্তি নেই। আর বিদায়ের দিনে করুণ ছবি। সকলের মুখ ভার। পুরো গ্রামের বৌ-ঝি, ছেলে-বুড়ো বিদায় জানাতে গ্রামের শেষ মাথা পর্যন্ত চলে আসতো।
আমার ছেলেবেলার এমন দুটো গ্রামের কথা এখনো মনে পড়ে। একটি আমার নানা বাড়ি বিক্রমপুরের ভাগ্যকুলের উত্তর বালাসুর গ্রাম। আর অন্যটি বড় বোনের শ্বশুরবাড়ি শরিয়তপুরের নড়িয়া থানার শাওড়া গ্রাম। আমার ছেলেবেলায় অর্থাত্ পাকিস্তান আমলে আরো অনেক গ্রামের মতোই এই দুটো গ্রাম বিজ্ঞানের সুবিধাবঞ্চিত ছিল। আর তাই বোধহয় আবেগে আপ্লুত ছিল সবাই। প্রাণের টান প্রচণ্ডভাবে অনুভব করতাম। এখন রাস্তাঘাট হয়ে যাওয়ায় আর যানবাহনের সুবিধা বাড়ায় দু’আড়াই ঘন্টা গাড়ি চালিয়েই নারায়ণগঞ্জ থেকে নানাবাড়ি যেতে পারি। আর শাওড়াতে আড়াই-তিন ঘন্টায়। আজ এসব গ্রামে যেতে সড়কপথ তৈরি হয়েছে। বিদ্যুত্ পৌঁছে গেছে। রেডিও, টেলিভিশন আর ফ্রিজ চলছে। সড়ক ব্যবস্থাপনা না থাকায় গ্রাম তখন ছিল অনেকদূর। মনে পড়ে নারায়ণগঞ্জ ঘাট থেকে বিকেলবেলায় রকেট স্টিমার ছাড়তো। নাম ছিল ‘গোয়ালন্দ মেল’। মাঝরাতে ভাগ্যকুল ঘাটে ভিড়তো। এখান থেকে অন্তত দেড় কিলোমাটার দূরে উত্তর বালাসুর গ্রাম। দেখতাম আমাদের এগিয়ে নেয়ার জন্য ঘাট পর্যন্ত চলে আসতো গ্রামের কমপক্ষে ২০-২৫ জন ছেলেবুড়ো। বিদায়ের সময়টিও প্রায় একই রকম। আজ এই গ্রামগুলোতে আত্মীয়-পরিজন আছেন ঠিকই। আদর-আপ্যায়ন সাধ্যমতো করেনও। কিন্তু সেই আবেগটির আর খোঁজ পাওয়া যায় না। শহরের যান্ত্রিকতা তাদেরও গ্রাস করেছে। ছেলেবেলায় দেখতাম স্কুলে এবং পরিবারের ভেতরে ক্লাসের পড়াশুনোর পাশাপাশি পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার প্রণোদনা থাকতো। গ্রামে বা মহল্লায় পাঠাগার গড়ে তোলা হতো। বন্ধুদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল কে ক’টা বই পড়তাম তা নিয়ে। আমাদের হাতে বিজ্ঞানের অনেক আশীর্বাদই এসে তখনো পৌঁছেনি। ফলে সময় কাটাতে স্কুলের বাইরে খেলাধুলো আর বই পড়া বিনোদনের অংশেই পরিণত হয়েছিল।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে রেডিওর পাশাপাশি বিটিভি কিছুটা বিনোদনের উত্স ছিল। তবে তা বই পড়ার অভ্যাস ও সুস্থ সংস্কৃতি চর্চাকে তেমন বিঘ্ন ঘটায়নি। বরঞ্চ বলা যায় সাংস্কৃতিক আবহকে কিছুটা প্রণোদনাই দিয়েছে। একুশ শতকের শুরুর দিকে আমরা আকাশ সংস্কৃতির সাথে যুক্ত হলাম। দিনে দিনে অনেক টিভি চ্যানেল হলো। প্রাইভেট অনেক রেডিও সম্প্রচার শুরু করলো। চ্যানেলের কল্যাণে হিন্দি সিরিয়াল আর হিন্দি ছবি তরুণ প্রজন্মকে অনেকটাই বন্দি করে ফেললো। তখন এদের একটি বড় সংখ্যক পরীক্ষাকেন্দ্রিক প্রস্তুতি ছাড়া বই পাঠ আর নন্দনচর্চায় খুব একটা সময় বের করতো পারছিলো না। এবার দাবানলের মতো প্রবেশ করলো ফেসবুক, টুইটার জাতীয় আধুনিক সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম। এখনকার প্রজন্ম স্কুল-কলেজের দায় কিছুটা মেটাতে পারলেও ফেসবুক গ্রাসে তারা অনেকটাই বিপর্যস্ত। ক্লাসে অমনোযোগিতা বেড়েছে। টের পাই পেছনের দিকে বসা ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকেই স্মার্ট ফোনের বাটন টিপছে। অনেক বাবা-মাকে দেখি শিশু সন্তানটিকে ট্যাব কিনে দিয়ে ট্যাবাসক্ত করে দিয়েছেন। এদের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা নিয়ে আমার শঙ্কা হয়। আর বই পড়ায় মনোযোগী করে তোলা তো হবে সাধনার ব্যাপার।
আমাদের স্কুলের শিক্ষার্থীদের আমরা অদ্ভুত পরীক্ষানিয়ন্ত্রিত জীবন উপহার দিয়েছি। ওদের কারো মুক্তচিন্তা করার মতো জীবন নেই। পাঠক্রম-বহির্ভূত পাঁচটা বইয়ের খোঁজ রাখার সময় ওদের নেই। ক্লাস, কোচিং আর পরীক্ষা— এই তিনে আটকে গেছে জীবন। জিপিএ-৫ অর্জন ছাড়া ভবিষ্যতের আর কোনো স্বপ্ন নেই।
শহরকেন্দ্রিক হাতেগোনা কয়েকটি কলেজ ছাড়া অধিকাংশ কলেজের শিক্ষক মনে করেন না রেগুলার কলেজে যেতে হয়। আর গেলেও ক্লাস নিতে হয়। অন্যদিকে শিক্ষার্থী মনে করে শিক্ষক নির্দেশিত নোট গাইড সংগ্রহ করার বাইরে ক্লাসে যাওয়ার খুব একটা আবশ্যকতা নেই। ফলে ক্লাসের বই বলতে যারা গাইড বই বোঝে তাদের কাছে পাঠবহির্ভূত বইয়ের খোঁজ রাখা বাতুলতা মাত্র।
বিশ্ববিদ্যালয়কে কি এ অবস্থা থেকে দূরে রাখা যাবে? আমার মনে হয় না। আকাশ সংস্কৃতি আর ফেসবুক টুইটার সংস্কৃতির ভেতর অবগাহন করতে গিয়ে অনেকের কাছে বইপড়া উপদ্রব ধরনের বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এখন তরুণদের অনেকেরই কানে হেডফোন আর হাতের মোবাইল সেটে অনবরত আঙুলের ছন্দময় দোলা। বই পড়ার সময় কোথায় ওদের? ভোরবেলা হাঁটতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে ছাত্র-ছাত্রীদের ভিড় দেখে নতুনভাবে আশাবাদী হয়েছিলাম। তাহলে নিন্দুকের মুখে ছাই দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা কি আবার লাইব্রেরিমুখি হতে শুরু করেছে! খোঁজ করে জানলাম বিষয়টা তেমন নয়। এখন লাইব্রেরিতে আসন পাওয়া ভার। বিসিএস বা অন্য কোনো চাকরি প্রত্যাশীরা নিজেদের প্রস্তুত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বেলায় এসে লাইব্রেরিতে যাচ্ছে। ভাগ্যিস স্নাতক স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা এখন আর তেমন লাইব্রেরিতে যাওয়ার সময় পায় না। নয়তো লাইব্রেরিতে স্থান সংকুলান না হওয়ার কারণে এতদিনে আন্দোলন শুরু করে দিতো।
কলকাতা বই মেলার পূর্ব অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে। আগে যখন ময়দানে বইমেলা হতো তখন অনেকবারই আমি বইমেলায় গিয়েছি। এখনকার তুলনায় ময়দানের বইমেলা অনেক বেশি জাঁকালো ছিল। দীর্ঘ লাইন ধরে টিকিট কেটে মেলায় ঢুকতে হতো। আমি গত শতকের ’৯০-এর দশকের কথা বলছি। আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে একটি স্মৃতিকথা অনেক লেখাতে লিখেছি। বলেছি লাখ লাখ বইপ্রেমিক মানুষকে দেখেছি যাদের অধিকাংশই হাতভরা বই কিনে বাড়ি ফিরছে। তখন আফসোস করে বলতাম, আহা, আমাদের একুশের বইমেলায় দর্শকদের অর্ধেকও যদি বই কিনতো তাহলে আমাদের প্রকাশনার চেহারাটাই পাল্টে যেতো।
২০১৭-তে কলকাতা বইমেলায় গিয়ে দেখি অবস্থা পাল্টে গেছে। কলকাতা বইমেলা চলে গেছে সল্ট লেকে। বড় বড় প্যাভেলিয়ন খুব কমই চোখে পড়লো। বাংলাদেশের প্রায় ত্রিশটি প্রকাশনা সংস্থার স্টল ঘিরে একটি আলাদা প্যাভেলিয়ন করা হয়েছে। বই ছাড়াও সেখানে রয়েছে নানা রকম খাবারের দোকান। তাঁতবস্ত্রের দোকান, আচার চাটনির দোকান। বইয়ের দোকানের চেয়ে এখানে এসব দোকানেই ভিড় তুলনামূলকভাবে বেশি। মেলা থেকে বই কিনে বাড়ি ফেরা মানুষের সংখ্যাও বেশ কমে গেছে। আগে ‘অবসরে বইপড়া’ বলে একটি কথা ছিল। এখনতো ফেসবুক, টুইটার আর আকাশ সংস্কৃতির চাপে অবসর বলে কোনো কিছু নেই। তাই অবসরে বইপড়াটি ক্রমে নতুন প্রজন্মের কাছে অচেনা হয়ে পড়ছে।
আমি দেখেছি—অনুভব করেছি কলকাতা বইমেলার চেয়ে একুশের বইমেলার চরিত্র এবং আবেগ আলাদা। একুশের বইমেলা অনেক বেশি গোছালো। বই প্রকাশ নিয়ে প্রকাশকদের পরিমার্জনাও একটু আলাদা। অনেকগুলো বছর ধরেই মেলায় আসা মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। জায়গা সংকুলান না হওয়ায় বইমেলার বড় অংশ এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। আকর্ষণীয় স্টল সাজিয়ে বসেছেন প্রকাশকরা। সুখের কথা, এখন প্রতি মেলায় ক্রেতার সংখ্যা বাড়ছে। তবে এতে সারা দেশে যে বই পড়ার প্রবণতা বাড়ছে তা বলা যাবে না। এদেশে নানা নীতিনির্ধারণী খেলায় বিভ্রান্ত আমরা আসলে প্রজন্মকে বইমুখি করে তুলতে পারছি না। আমি দেশের অন্যতম নামি এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করি। আমি ক্লাসে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, এদের কমপক্ষে পাঁচ ভাগ ছাত্র-ছাত্রী একুশের বইমেলা সম্পর্কে তেমন পরিষ্কার কিছু জানে না। পাঁচ ভাগ ছাত্র-ছাত্রী জানে না কোথায় বসে একুশের বইমেলা। প্রায় ৪০ ভাগ ছাত্র-ছাত্রী কখনো বইমেলায় যায়নি। এই অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি নিয়মের হাতে বন্দি। ক্লাস-পরীক্ষা দিতে দিতে এরা তিন মাসের সেমিস্টারে নোট আর হ্যান্ডআউটের বাইরে যাওয়ার সময় পায় না। যারা সংবাদপত্র পড়ার ধারণাই হারিয়ে ফেলছে তারা পরীক্ষার অক্টোপাস বেস্টনির বাইরে গিয়ে কীভাবে বই পড়ার জগতে প্রবেশ করবে!
এভাবেই আমাদের প্রজন্ম জ্ঞানচর্চার জগত্ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। দেশের ভবিষ্যত্ নেতৃত্ব যারা দেবে তাদের এমন বইপড়া-বিমুখ জীবনে সঞ্চয় বেশি থাকার কথা নয়। সুতরাং ভয়ঙ্কর এক ভবিষ্যত্ আমাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে না? বিষয়টি নিয়ে সকল মহলের ভাবনা সম্প্রসারিত হলেই মঙ্গল।
লেখক: অধ্যাপক ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক