বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার - দৈনিকশিক্ষা

বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার

মো. আব্দুল মোমিন |

স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের পাঠশালা নামক সেই ক্ষুদ্র বিদ্যাপীঠ এর সংস্করণ হলো বর্তমান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ইতিকথায় দেখা যায় যে, প্রাচীনকালে শিক্ষাব্যবস্থা বৈদিক, বৌদ্ধ ও মুসলিম শিক্ষা নামে তিন শ্রেণির শিক্ষার পরিসর ছিল। বৈদিক শিক্ষায় পাঁচ বছর বয়সে স্বীকরনম অর্জনের মধ্য দিয়ে শিশুশিক্ষা শুরু হতো। বৌদ্ধ শিক্ষায় ছয় বছর বয়সে মুখে মুখে বাস্তব গল্পের মাধ্যমে নিজ ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে শিশুদের গড়ে তোলা হতো।

মুসলিম শিক্ষায় দেখা যায়, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ১২০৩ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিম শাসক ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী বাংলায় মসজিদ ও মক্তবভিত্তিক শিশুশিক্ষা চালু করেন। সাধারণত চার বছর বয়সে নিজ ধর্মের কালেমা পাঠের মাধ্যমে এ শিক্ষা শুরু হতো। ধর্মীয় গণ্ডির মধ্যেই থাকতো এই অর্জিত শিক্ষাটুকু।

ইংরেজ আমলে তাদের শাসনের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে বাংলার প্রাথমিক শিক্ষা আলোর মুখ দেখতে পায়নি। ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে লর্ড মেকলের ‘নিম্নগামী পরিস্রবণ নীতি’র ফলে তৎকালীন বাংলায় শিশুশিক্ষা ব্যাপক বৈষম্যের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়। বাধাগ্রস্থ হয় প্রাথমিক শিক্ষার প্রসারে।

পাকিস্থান আমলে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর অসদিচ্ছা ও অর্থ বরাদ্দের অপ্রতুলতার কারণে প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো ছিল না। আঞ্চলিক বৈষম্যের স্বীকার হতে হয় পূর্ববাংলার তৎকালীন প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা। পাকিস্থান সরকার ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে আতাউর রহমান শিক্ষা কমিশন গঠন করে। এ কমিশনে প্রাথমিক শিক্ষাকে মডেল, নন-মডেল দুটি ভাগে বিভক্ত করে। এ পর্যায়ে উর্দু ভাষার প্রতিষ্ঠানগুলো মডেল আর বাংলা ভাষার স্কুলগুলো নন-মডেল এর আওতায় পড়ে, ফলে বাংলাভাষা অধ্যুষিত পূর্ববাংলার প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের মুখ থুবড়ে পড়ে।

১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ‘ম্যানেজড’ নামক প্রাথমিক স্কুল চালুর মাধ্যমে পাকিস্তান সরকার পূর্ববাংলার প্রাথমিক শিক্ষাকে ধ্বংস করার মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে। তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর এ নীতির ফলে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ব্যাপক সংখ্যক বয়স্ক নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষা আন্দোলনেও এই বিষয়ে দাবি করা হয়। কিন্তু পাক শাসকরা কখনই এদেশের সাধারণ জনগণকে শিক্ষার আওতায় আনার চেষ্টা তো করে নাই বরং পক্ষপাতিত্ব করেছে।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে দীর্ঘ ৯ মাস মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হয়। তবে পাকিস্তানিরা এদেশের সকল কিছু ধ্বংস করার সাথে সাথে প্রাথমিক শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধ পরবর্তী বিধ্বস্ত দেশ ও জনগনের সেবা দেয়ার জন্য সরকার গঠন করেন। নতুন স্বাধীন দেশের দায়িত্ব নিয়ে তিনি কীভাবে অনগ্রসর নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত নাগরিক হিসেবে গড়া যায় তার মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম নজর দিলেন প্রাথমিক শিক্ষার ওপর। তিনি বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে এক যুগান্তকারী সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে এই প্রাথমিক শিক্ষাকে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে জনগণের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেন। তিনি সমস্ত শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর জন্য ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠনের নির্দেশ প্রদান করেন। এই কমিশনে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক হিসেবে গণ্য করেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সেদিন ঘোষণা করেন একটা উন্নত দেশ গঠন করতে হলে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা ছাড়া সম্ভব না।

১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা অর্ডিনেন্স জারি করেন এবং ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রাথমিক বিদ্যালয় অধিগ্রহণ আইন জারি করেন। এরই আলোকে বঙ্গবন্ধু সেদিন দেশের আনাচে কানাচে গড়ে উঠা শিশুশিক্ষা নামক পাঠশালাগুলোকে সরকারিকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দেশের ৩৭ হাজার স্কুলকে সরকারিকরণ করেন এবং এসকল স্কুলের ১ লাখ ৫৭ হাজার ৭৪২ জন শিক্ষককে স্বাধীন দেশের নব সরকারের কর্মচারীর মর্যাদায় আদিষ্ট করেন এবং সর্বক্ষেত্রে মর্যাদা প্রদান করেন। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে সর্বোচ্চ অর্থ বরাদ্দ দেন। তখন থেকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জ্ঞানের আলো জ্বলতে শুরু করে। প্রাথমিক শিক্ষকরা তখন নিজেদের অত্যন্ত উৎফুল্ল হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের শিশুদের জ্ঞান দানে মনোনিবেশ করেন।

বেশ কিছুদিন চলতে না চলতেই ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রের ন্যায় প্রাথমিকের জ্বলন্ত আলো নিভিয়ে দেয়া হয়। পাকিস্তানি হানাদারদের এ দেশিয় বংশধররা সেদিন আবার পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করে। শুরু হয় ক্ষমতা কাড়াকাড়ির পালা এবং স্বৈরশাসকদের আমলাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা। স্বৈরশাসকরা দেশের উন্নয়নের চেয়ে নিজের মুকুট রক্ষার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকে।

দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের সরকার প্রধানের দায়িত্ব নেন প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণের মহান কারিগর বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি দেশের শাসনভার নিয়েই পিতার পথ অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি ভিশন-২১ বাস্তবায়নের জন্য ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে দেশের ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক স্কুল সরকারিকরণ করেন এবং এসকল বিদ্যালয়ের ১ লাখ ৩ হাজার ৮৪৫ জন শিক্ষককে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ন্যায় মর্যাদা প্রদান করেন। তিনি প্রাথমিক শিক্ষাকে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক দুটি স্তরে বিভক্ত করার ঘোষণা দেন।

প্রাথমিক স্তরে ১৭টি লক্ষমাত্রা অর্জনের জন্য ১৬৯টি টার্গেট নির্ধারণ করা হয়। বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শতভাগ ভর্তি, ঝরেপড়া রোধ, বৃত্তি কোটা বৃদ্ধি, শতভাগ উপবৃত্তি প্রদান, বিনা মূল্যে নতুন বছরের শুরুতেই শিশুদের হাতে বই তুলে দেয়া, অভিন্ন প্রশ্নপত্রে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরিক্ষা পদ্ধতি চালু, প্রতিটি বিদ্যালের শিক্ষকদের আইসিটি প্রশিক্ষণ, বিনা মূল্যে সকল স্কুলে ল্যাপটপ, প্রজেক্টর, বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ প্রদান করে প্রাথমিক শিক্ষাকে আধুনিকায়নের জগতে ঠাঁই রাখতে সক্ষম হয়।

এছাড়াও প্রাথমিকের ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের মনোবল জাগ্রত করতে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা প্রাথমিক বিদ্যালয় গোল্ডকাপ খেলার আয়োজন করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক মানসিকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রাথমিক স্টুডেন্ট কাউন্সিল নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষকদের দেশে বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে শিক্ষকদের পাঠদান মনোবল উন্নত করা হয়েছে। প্রতি বছর নতুন শিক্ষক নিয়োগ এবং তাদের পে-স্কেলের মাধ্যমে সাচ্ছন্দ্যে চলার মতো বেতন কাঠামো নির্ধারণ করা হয়েছে। স্কুলের সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, ওয়াশব্লক নির্মাণ, বহুতল ভবন নির্মাণের মাধ্যমে স্কুলের পাঠাদানের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করে একটি শিশুবান্ধব পাঠদান প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরে সক্ষম হয়েছেন বঙ্গকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকার।

বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার আলোকবর্তিকা হিসেবে বঙ্গকন্যা জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গঠনে স্বর্ণোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে চলেছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উন্নত দেশ বিনির্মাণের ভাবনায় প্রাথমিক শিক্ষা আজ বিশ্বের বুকে প্রশংসার দাবিদার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

লেখক : মো. আব্দুল মোমিন, কবি ও শিক্ষক, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ।

[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন।]

প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0050070285797119