যুগে যুগে বিভিন্ন দার্শনিক বিভিন্ন দর্শনের আলোকে শিক্ষার স্বরূপ উন্মোচনের মাধ্যমে শিক্ষা-চেতনার বিকাশ ঘটিয়েছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাতত্ত্ব ও শিক্ষাদর্শন ভাববাদ, প্রয়োগবাদ বা বস্তুবাদের গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়—বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাতত্ত্ব মানবতাবাদ বা মানুষের মুক্তির নিষ্পন্ন ইতিহাস। বিশেষ করে বাঙালি জাতির মুক্তি ও বিশ্বরাষ্ট্রে বাঙালির মাথা উঁচু করে নেতৃত্ব দেওয়ার দর্শন। বাংলার মানুষ ছিল বঙ্গবন্ধুর পাঠশালা। লোকায়ত বাঙালি সমাজের মানবতাবাদী ধ্যান-ধারণা পরিপুষ্ট করেছে তাঁর কর্ম, কথা, আচরণ ও দর্শনকে। শিক্ষার লক্ষ্য ও স্বপ্নকে বঙ্গবন্ধু আত্মার সন্তান হিসেবে লালন করেছিলেন। তাই ১৯৫২ সালে ভাষার ওপর আঘাত এলে তিনি প্রতিবাদী হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন, বাংলা ভাষার বিলয়ে মুখ থুবড়ে পড়বে শিক্ষাব্যবস্থা, বোবাপুরীতে পরিণত হবে সমগ্র বাংলা। ব্রিটিশদের পশ্চিমা শিক্ষাতত্ত্ব, পাকিস্তানিদের শিক্ষা কমিশন ষড়যন্ত্র আর প্রচলিত মধ্যযুগীয় শিক্ষাব্যবস্থার বিপরীতে বঙ্গবন্ধু দিয়ে গেছেন বাঙালির মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর এক মৌলিক শিক্ষাদর্শন।মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।
১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থার উদ্যোগ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭২ সালের সংবিধানের ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’ অংশেই শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। শিক্ষার ওপর বঙ্গবন্ধু যে অধিক গুরুত্বারোপ করেছেন তার প্রমাণ মেলে বাংলাদেশের প্রথম বাজেটে। সে বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতের চেয়ে শিক্ষা খাতে তিন কোটি ৭২ লাখ টাকা বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। উচ্চশিক্ষার প্রসারের জন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স ঘোষণা করা হয়েছিল, যার মূল কথা—বিশ্ববিদ্যালয়ে চিন্তার স্বাধীনতা ও মুক্ত-বুদ্ধিচর্চার পরিবেশ সৃষ্টি করা। ১৯৭২ সালে ড. কুদরাত-এ-খুদাকে সভাপতি করে বঙ্গবন্ধু গঠন করেছিলেন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় শিক্ষা কমিশন। কমিশন শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ, বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার, শিক্ষকের মর্যাদা বৃদ্ধি ও গবেষণার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিল। ১৯৭৩ সালে শূন্য কোষাগার নিয়েও বঙ্গবন্ধু দেশের সাধারণ মানুষের সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণের জন্য প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করেছিলেন। শিক্ষকদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, আগামী প্রজন্মের ভাগ্য শিক্ষকদের ওপর নির্ভর করে। শিশুদের যথাযথ শিক্ষার ব্যত্যয় ঘটলে কষ্টার্জিত স্বাধীনতা অর্থহীন হবে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের মাঝে বিনা মূল্যে বই, খাতা, পেনসিল, দুধ, ছাতু, বিস্কুট বিতরণ করা হতো।
বঙ্গবন্ধু নিয়মিত পড়াশোনা করতেন। তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তার পেছনে ছিল গভীর অধ্যয়ন, জানা-চেনা-শোনা ও দেখার গভীর অন্তর্দৃষ্টি। তাঁর ব্যক্তিগত পাঠাগারের উজ্জ্বল সংগ্রহের কথা অনেকেই জানতেন। শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমলা নয়, মানুষ সৃষ্টি করুন।’ ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে দেশবাসীর উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, ‘সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতে পুঁজি বিনিয়োগের চেয়ে উত্কৃষ্ট বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারে না। ...দারিদ্র্য যাতে উচ্চশিক্ষার জন্য মেধাবী ছাত্রদের অভিশাপ হয়ে না দাঁড়ায় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।’
১৯৭৪ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সাহিত্য সম্মেলনের বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, ‘একটি সুষ্ঠু জাতি গঠনে শিল্প, যোগাযোগব্যবস্থা বা অন্য সব ক্ষেত্রে যেমন উন্নয়ন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন চিন্তা ও চেতনার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করা। আমি সর্বত্রই একটি কথা বলি, সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই। সোনার মানুষ আকাশ থেকে পড়বে না, মাটি থেকেও গজাবে না। এই বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্য থেকেই তাঁদের সৃষ্টি করতে হবে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের (১৯২০-১৯৭৫) জীবন, কর্ম, চিন্তা, চেতনা, দর্শন ও মানস গঠনে বিভিন্ন শিক্ষকের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ও প্রভাব রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিজীবন চর্চায়ও শিক্ষক, কবি, শিল্পী ও সাহিত্যিকদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধার বহু দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। চট্টগ্রামের শ্রমিক নেতা জহুর আহমেদের আচরণে শিক্ষক অপমান বোধ করলে বঙ্গবন্ধু নিজে ওই শিক্ষকের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। অবরুদ্ধ শিক্ষকদের মুক্ত করতে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে অনুষ্ঠিত (বর্তমান গণভবন) মন্ত্রিসভার জরুরি সভা বাদ দিয়ে তিনি ছুটে গিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের সভাকক্ষে। স্বাধীন বাংলাদেশের উন্নয়নের পরিকল্পনায়ও তিনি শিক্ষকদের যুক্ত করেছিলেন। পরিকল্পনা কমিশনে ড. নূরুল ইসলাম, প্রফেসর রেহমান সোবহান, প্রফেসর আনিসুর রহমান, ড. মোশাররফ হোসেনসহ অসংখ্য শিক্ষক, প্রকৌশলী ও পেশাজীবীকে জড়ো করেছিলেন। প্রফেসর কবীর চৌধুরীকে তিনি শিক্ষাসচিব নিযুক্ত করেছিলেন। প্রফেসর মোজাফফর আহমদ চৌধুরী ও ড. এ আর মল্লিককে মন্ত্রিসভায় নিয়েছিলেন। সাহিত্যিক আবুল ফজলকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করেছিলেন। জয়নুল আবেদিনসহ সব শিল্পী ও শিক্ষাবিদকে তিনি শিক্ষকতুল্য সম্মান করতেন এবং তাঁদের উপদেশ শুনতেন।
একটি জাতি বা রাষ্ট্রের শিক্ষাদর্শ নির্ভর করে সে রাষ্ট্র বা জাতির শাসক বা জনকের নীতি-আদর্শের ওপর। এ কারণে রাষ্ট্রের পথপ্রদর্শক বা জাতির অগ্রনায়ক যত বেশি গুণাবলির অধিকারী হন, সে জাতির শিক্ষাব্যবস্থা তত বেশি উন্নত হয়। আমরা জানি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিয়মিত বই পড়েন। বিশ্বের অন্যতম বুদ্ধিভিত্তিক শাসকের স্বীকৃতিও তিনি পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শের আলোকে একটি সুখী-সমৃদ্ধ ও সমুন্নত বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘শিক্ষাকে আমি খরচ মনে করি না; আমি মনে এটি একটি বিনিয়োগ, জাতিকে গড়ে তোলার বিনিয়োগ।’ ঐতিহাসিক সমুদ্রজয়ের কারিগর শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিও উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিত্ব। দেশীয় শিক্ষাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নত করতে তাঁর বেশ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন-সংস্কারের পদক্ষেপও দৃষ্টিগ্রাহ্য হচ্ছে। স্বীকার্য যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের প্রতিটি স্তরেই রেখে গেছেন কালোত্তীর্ণ মুক্তিদর্শনের পথ। তাই, বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শন নিয়ে অধিক গবেষণা করা হলে এবং তার আলোকে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করা হলে বাঙালির শিক্ষামুক্তির পথ হবে আরো মসৃণ ও যথাযথ।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক। শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড