ইউনিসেফ সম্প্রতি একটি তথ্য প্রকাশ করেছে। তথ্যটি এক ভয়ংকর চিত্র তুলে ধরেছে। সেখানে বলা হয়েছে বন্ধুর হাতে নিগৃহীত হচ্ছে অর্ধেক কিশোর-কিশোরী। একমাসে ( আগস্ট) কটুক্তি বা গালমন্দের শিকার হয়েছে অথবা গত এক বছরে শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে এমন শিক্ষার্থীদের উপর জরিপ চালিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে । সংস্থাটি বলছে ধনী ও দরিদ্র সব দেশেই শিশুদের শিক্ষাগ্রহণ ও ভালোভাবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এ বিষয়টি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শারীরিক নির্যাতন ও কটুক্তি বা গালাগালের মতো নিগ্রহের কারণে বিশ্বে কিশোর বয়সী ১৫ কোটি শিশুর শিক্ষাগ্রহণ বিঘ্নিত হচ্ছে। ইউনিসেফের এক সমীক্ষায় এই ভয়ানক তথ্য উঠে এসেছে।
২০১৮ খ্রিস্টাব্দের ৬ সেপ্টেম্বর ’অ্যান এভরিডে লেসন: অ্যান্ড ভায়েলেন্স ইন স্কুলস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘের এ সংস্থা বলছে, বিশ্বে ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের অর্ধেকই বিদ্যালয়ে সহপাঠী অথবা সঙ্গীদের সহিংসতার শিকার হয়।
কিছু দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখানো শারীরিক শাস্তি পুরোপুরি নিষিদ্ধ হয়নি। এসব দেশে প্রায় ৭২ কোটি শিশুরা বসবাস করে। বাংলাদেশে ২০১৪ খিস্টাব্দের জরিপ থেকে উদ্ধৃত করে ইউনিসেফ বলছে ,১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের ৩৫ শতাংশ মাসে গড়ে এক বা একাধিক দিন গালমন্দ বা কটুক্তির শিকার হয়েছে। বছরে অন্তত একবার শারীরিকভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছে তারা।
ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর বলেন, শান্তিপূর্ন সমাজ গঠনের চাবিকাঠি হচ্ছে শিক্ষা। অথচ বিশ্বের লাখো শিশুর জন্য বিদ্যালয় এখানো নিরাপদ স্থান নয়। কঠিন সত্য কথা বলেছেন হেনরিয়েটা। শিশুরা স্কুলে আসে না, স্কুলে আসতে চায় না , বাবা-মা অভিভাবক স্কুলে যাওয়ার জন্য চাপ দেন,অনেক ক্লাস টিচার অভিভাবকদের কাছে অভিযোগ করেন যে, তার বাচ্চা নিয়মিত স্কুলে আসে না। স্কুলে না আসলে শিশু শিক্ষার্থীদের অনেক ক্ষেত্রেই শারীরিক ও মানসিক শাস্তির সম্মুখীন হতে হয় । স্কুলগৃহ, শ্রেণিকক্ষ যে তার কাছে নিরাপদ নয়, আকর্ষণীয় তো দূরের কথা, সেটি আমরা শিক্ষক, অভিভাবক ও কর্তৃপক্ষ কেউই খেয়াল করছি না। অপেক্ষাকৃত ইনট্রোভার্ট, নিরীহ ও চুপচাপ শিক্ষার্থীরা যেন শ্রেণিকক্ষে কিংবা বিদ্যালয়ে বেশি হেনস্তার শিকার হন। অগ্রহণযোগ্য একটিমাত্র কথা বা বাক্যই যে নিষ্পাপ প্রাণে কত বড় আঘাত হানতে পারে সেটি কোন শিক্ষক, কোন অভিভাবক কিংবা পারিপার্শ্বিক কেউ বোঝে না। কথাটি যে ছোট শিশুর মনে ঝড়ের মতো ঢেউ খেলে যায় তার খবর কেউ রাখেনা। সে স্কুলে আসা বন্ধ করে দেয়। বিভিন্ন ধরনের নেগেটিভ সিদ্ধান্ত নেয়। সবাই দায়ী করে শিশুদের, কিন্তু কেন এটি করা হচ্ছে তা কেউ ভেবে দেখে না।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিল্পোন্নত ৩৯টি দেশে প্রতি ১০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩ জন সহপাঠীদের কটুক্তি বা গালমন্দের শিকার হওয়ার কথা বলছে। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর বিভিন্ন স্কুলে ৩৯৬টি হামলার ঘটনার তথ্য পাওয়া গেছে। দক্ষিণ সুদানে এই সংখ্যা ২৬, সিরিয়ান আরব রিপাবলিকে ৬৭ এবং ইয়েমেনে ২০। এই পরিস্থিতিতে স্বল্পমেয়াদে শিক্ষা গ্রহণে তাদের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আর দীর্ঘমেয়াদে তাদের মধ্যে বিষন্নতা ও উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে। এমনকি তাদের আত্মহত্যায়ও প্ররোচিত করতে পারে। সহিংসতা আসলে চিরদিন মনে রাখার মতো একটি শিক্ষা, যা কোন শিশুরই শেখার দরকার নেই। তারা যাতে কোন ধরনের সহিংসতা, পরিবারে, বিদ্যালয়ে, সমাজে, টিভির পর্দায় না দেখে সেটির প্রতি সংশ্লিষ্ট সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রতিদিন শিশুরা শারীরিকভাবে হেনস্তার শিকার হচ্ছে, গ্যাংয়ে যোগ দিতে তাদের চাপ দেওয়া হচ্ছে এবং কটুক্তি বা গালমন্দ করা হচ্ছে। এ ছাড়া তারা সরাসরি অনলাইনে যৌন হয়রানি ও সশস্ত্র সংঘাতের মতো বিপদের মুখোমুখি হচ্ছে। কটুক্তি বা গালমন্দের শিকার হওয়ার ক্ষেত্রে ছেলে ও মেয়ে সমান ঝুঁকিতে থাকলেও মেয়েদের ক্ষেত্রে মানসিকভাবে হয়রানির শিকার হওয়ার ঝুঁকি বেশি। আর ছেলেদের ক্ষেত্রে শারীরিক নির্যাতন ও হুমকির শিকার হওয়ার ঝুঁকি বেশি। বিদ্যালয়ে সহিংসতা ঠেকাতে কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে ইউনিসেফের প্রতিবেদনে। এর মধ্যে নীতিমালা ও আইন বাস্তবায়ন, প্রতিরোধ ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা শক্তিশালী করা এবং সহিংসতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে সমাজের বিশিষ্টজনদের আহ্বান জানানোর কথা বলা হয়েছে।
আমরা জানি শিক্ষাবিদ মন্টেসরি উদ্ভাবিত শিক্ষাপদ্ধতি যা ’মন্টেসরি এডুকেশন’ নামে পরিচিত, সেখানে ব্যক্তি সৃজনশীলতা ও আগ্রহকে সমান গুরুত্ব প্রদান করা হয়। এই পদ্ধতিতে শিক্ষক শিশুদের কার্যাকলাপের প্রতি পূর্ণ মনোযোগ রাখেন। তিনি প্রতিটি শিশুর ক্ষেত্রে বোঝার চেষ্টা করেন কোন শিশুর কোন সেক্টরে আগ্রহ রয়েছে এবং সে অনুযায়ী শিশুদের পরবর্তী শিক্ষার গাইডলাইন প্রদান করা হয়। শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব হচেছ শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক বিন্যাস করে মন্টেসরি ক্লাসরুমের ডিজাইন করা যেখানে শিশুদের পূর্ণ স্বাধীনতার ব্যবহার, যোগ্যতা অর্জন ও ব্যক্তিত্ব বিকাশের প্রতি নজর দেওয়া হয়। এখানে শিশুদের পছন্দমত পাঠ ও পাঠের পরিধি নির্বাচন, ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও দায়িত্ব গ্রহণের স্বাধীনতা প্রদান করা হয়।
আমাদের দেশের শিশুদের বিদ্যালয়গুলো কেমন? শিশুশিক্ষা থেকে শুরু করে সর্বোচচ পর্যায়ে সবস্তরের শিক্ষাই এখন আনন্দহীন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আনন্দলাভের জন্য প্রয়োজনীয় পরিসরের মারাত্মক অভাব। খোলা জায়গা নেই, খেলার মাঠ নেই, গ্রন্থাগার নেই, সাংস্কৃতিক কাজকর্ম প্রায় অনুপস্থিত। শিক্ষার্থীদের জন্য নিজেদের গৃহে আনন্দ নেই, আনন্দ নেই বিদ্যালয়েও। ওদিকে ছুটির ঘণ্টা বাজতে না বাজতেই তাদেরকে ছুটতে হয় কোচিং সেন্টারে। করতে হয় একটির পর একটি হোমওয়ার্ক, মনে এটা ধারণ করে যে হোমওয়ার্ক না নিয়ে গেলে ক্লাসে শারীরিক কিংবা মানসিক শাস্তি, সবার সামনে কটুক্তি শোনা, শিক্ষকের অস্বাভাববিক ও ভয়ংকর মুখমন্ডল দর্শন। এগুলো সবই নিরানন্দ, অনিরাপদ অবস্থা। অথচ পাঠ্যবইয়ের বাইরে সৃজনশীল, আনন্দদায়ক বই পাঠ করে দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার বিকল্প নেই।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষায় যে ঘাটতি রয়ে গেছে এবং সৃষ্টি হচেছ তা পূরণ করতে পারে অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, শিশুকিশোর সংগঠন, লাইব্রেরি, খেলাধুলা, শিশু কিশোর সাহিত্য পত্রিকা। শিশু কিশোরদের রূপকথার গল্প পড়তে দিতে হবে যাতে তাদের চিন্তা চেতনা ও কল্পনার জগত প্রসারিত হয়। সর্বোপরি শিক্ষকের উদার মন, প্রশস্ত হাসি, সহানুভূতিমূলক আচরণ। এগুলো বিদ্যালয়কে নিরাপদ স্থানে রুপান্তরিত করতে সহায়তা করে।
শিক্ষণীয় বিষয়বস্তু আয়ত্ত ও অনুধাবন করার জন্য আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে উপযুক্ত পরিবেশ অর্থাৎ দেহ ও মনের বিকাশের পরিবেশ অক্ষুন্ন রাখা প্রয়োজন। শিক্ষা একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। একজন ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক, নৈতিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশই পরিপূর্ণ শিক্ষা।শুধু পাঠ্যপুস্তকের শিক্ষা একজন মানুষকে পরিপূ্র্ণ মানুষ করতে পারেনা-এটি আমরা মুখেই বলে আসছি কিন্তু কার্যকর করছি না। যেসব শিক্ষার্থীরা খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করবে, বক্তৃতা, উপস্থাপনায় ভাল করবে তাদেরকে উৎসাহিত করতে হবে, আর্থিক সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে। অথচ কি ভয়ংকর ও দু:খজনক পরিস্থিতি তারা প্রত্যক্ষ করছে, তারাই সহিংসতার শিকার হচেছ। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিদিন গড়ে একটি শিশু খুন হয়েছে আমাদের দেশে। এই সংখ্যা ৩৫২। গত কয়েক বছরের তুলনায় ২০১৭ খ্রিস্টাব্দটি ছিল শিশুদের জন্য ভয়ংকর।
বাসায় যত সমস্যাই হোক না কেন শ্রেণিকক্ষে ঢোকার সাথে সাথে বাসার বিষয়গুলো ভুলে যেতে হবে একজন শিক্ষককে। চমৎকার হাসি দিয়ে শিক্ষার্থীদের বলতে হবে, ”তোমরা কেমন আছ? আজকের সকাল তোমাদের কাছে কেমন লাগছে?” কথায়, বার্তায়, প্রকাশ ভঙ্গির মাধ্যমে, দেহভঙ্গিমার মাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে যে, ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের সান্নিধ্যে এসে একজন শিক্ষক আনন্দিত, উৎফুল্ল। কোনভাবেই মুখ কুচকানো, ভ্রুকুচকানো যাবে না। হাসতেই হবে। মজার মজার কথা বলে তাদের হাসাতে হবে, নিজে হাসতে হবে।শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তত করে ধীরে ধীরে পড়াশুনার দিকে এগোতে হবে। এজন্য প্রয়োজন ডেডিকেশন, নিষ্ঠা, সততা, পরিশ্রম এবং মোটিভেশন। সব শিক্ষার্থীদের নাম ধরে ডাকা, শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত সমস্যাবলী জানার আগ্রহ, কৌতূহল ও সময় দেওয়া বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের নিকট বিদ্যালয়কে নিরাপদ করার কথা বলে। শ্রেণিকক্ষ ও বিদ্যালয় আঙ্গিনা শিশুদের এবং শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে নিরাপদ স্থান বলে তাদের কাছে প্রমাণ করতে হবে, তাহলেই তারা বিদ্যালয়কে আকর্ষণীয় স্থান মনে করবে, সবকিছু ফেলে ছুটে আসবে বিদ্যালয়ে।
লেখক: শিক্ষা গবেষক ও বিশেষজ্ঞ, বর্তমানে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত।