নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন বলেছেন, উন্নয়নের জন্য দায়িত্বশীলতা দরকার। জবাবদিহিতার বদলে যদি সবাই দায়িত্বশীল হয়, তবে সর্বক্ষেত্রে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড়ো ধরনের জাগরণ চলছে। এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপকভাবে সংযুক্ত। কর্মসংস্থান ও যোগাযোগ অবকাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। এ উন্নয়ন ভারত কিংবা পাকিস্তানসহ প্রতিবেশী অন্য কোনো দেশে হয়নি। এমনকি বাংলাদেশ যতদিন পাকিস্তানের অধীনে ছিল, তখনো এরকম উন্নয়ন হয়নি।
সোমবার (৯ মার্চ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী অডিটোরিয়ামে আয়োজিত এক পাঠচক্রে স্কাইপি যোগে তিনি এসব কথা বলেন। গতকাল ‘সমৃদ্ধি ও ন্যায্য সমাজের সন্ধানে অমর্ত্য সেন’ শীর্ষক পাঠচক্রটির উদ্বোধন করা হয়। এর আয়োজন করে বাংলার পাঠশালা।
বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, ঢাকার মানিকগঞ্জের বাবারবাড়ি থেকে বিক্রমপুরে মামারবাড়ি যেতে দুই দিন সময়ের প্রয়োজন হতো। এখন দুই ঘণ্টাও লাগে না।
পাঠচক্রে সভাপতিত্ব করেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান। বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইদুজ্জামান। অনুষ্ঠানের মূল বক্তা ছিলেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
অনুষ্ঠানে সশরীরে উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য সতর্কতার কারণে অমর্ত্য সেন আসেননি। বলেন, বাংলাদেশ আমার খুবই প্রিয় দেশ। এবার আসতে না পেরে আমি দুঃখিত। আমি বাংলাদেশে অবশ্যই আসব।
তিনি বলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের পর এনজিওগুলো নারী উন্নয়নে কাজ করেছে। তাদের কর্মসূচির ফলেই সাধারণ মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বেড়েছে। তবে এসব বিষয়ে আরও চিন্তার প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে জবাবদিহিতা এবং কর্তব্যবোধের বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতির আলোচনায় এ বিষয় খুব একটা নেই। ইংল্যান্ডের মতো নিয়ম মেনে চলা, জবাবদিহিতা এবং কর্তব্যবোধ অন্য কোনো দেশে হবে না তা মেনে নিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশে এটা খুব সামান্যই দেখা যায়—যা কষ্টদায়ক। অথচ একসময় এদেশে একে অন্যকে সাহায্য করাই ছিল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।
বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় ড. মসিউর রহমান বলেন, যেসব সেবা জনগণকে সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়ার কথা সেগুলো দিচ্ছে বেসরকারি খাত। শিক্ষা ও চিকিত্সার ক্ষেত্রে এসব কথা জোর দিয়ে বলা যায়। এর কারণ, সরকারের সেবা পর্যাপ্ত নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানসম্মতও নয়। যারা অর্থ দিয়ে মানসম্পন্ন সেবা কিনতে পারছে তারা তা কিনছে।
মূল বক্তব্য উপস্থাপন করতে গিয়ে অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, পূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশে কখনো দুর্ভিক্ষ হয় না। শুধু গণতন্ত্র নয়, গণতন্ত্রের ভিতরে যে স্বাধীন গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের যে সক্রিয় ভূমিকা এই সুযোগ আছে বলেই চরম খাদ্যাভাবের সংস্কারগুলো তুলে ধরে সরকারের প্রতি বাধ্যবাধকতার সৃষ্টি করার সুযোগ গণতন্ত্রেই আছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি রংপুর অঞ্চলের মৌসুমি দারিদ্র্যের কথা বলেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কিছুদিন আগে পর্যন্ত রংপুর অঞ্চলে মৌসুমি দারিদ্র্যের বিষয়টি স্বীকার করত না, কিন্তু গণমাধ্যম যখন কথা বলতে শুরু করল তখন সরকারের টনক নড়ল এবং সরকার বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নিতে বাধ্য হয়েছিল।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে মানুষ তার আবিষ্কৃত বিজ্ঞানভিত্তিক যন্ত্রপাতির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। যোগাযোগের ক্ষেত্রেও আসছে অভিনব পদ্ধতি। কিন্তু মানব উন্নয়নে বাংলাদেশের উন্নতি দৃশ্যমান নয়, ফলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিও প্রত্যাশা অনুযায়ী হচ্ছে না। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশের অভাবে জবাবদিহিতারও অভাব রয়েছে।
অমর্ত্য সেনের ওপর বছরব্যাপী ১২টি ক্লাস ও ৪টি লোকবক্তৃতার গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেন পাঠচক্রের আহ্বায়ক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান ওসমানী। অনুষ্ঠানে তরুণদের বাংলা ভাষায় অমর্ত্য সেনের চিন্তার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার গুরুত্ব তুলে ধরেন বাঙলার পাঠশালা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আহমেদ জাভেদ।