শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, ধর্মনীতি, শিক্ষা ছাড়া সব কিছুই অচল। তাই যে জাতি যত শিক্ষিত; সে জাতি তত উন্নত।
শিক্ষা মানে সনদপ্রাপ্তি নয়, বরং শিক্ষা হচ্ছে মানুষের মনোজগতের কাক্সিক্ষত মানবিক উন্নয়ন সাধন। পৃথিবীর সকল দেশই শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। খরচ করছে কোটি কোটি ডলার। বাংলাদেশ সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারও শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে।
তবে আমাদের দেশে শিক্ষাব্যবস্থাকে শিশু নির্যাতনের নামান্তর বললে তেমন একটা ভুল হবে না। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে সকাল ৯টা বা সাড়ে ৯টা থেকে বিকাল ৪টা বা সাড়ে ৪টা পর্যন্ত শিশুদেরকে প্রতিষ্ঠানে আটকে রাখা হয়। অনেক প্রতিষ্ঠানে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি এবং দুপুর ১২টা থেকে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি শিক্ষার্থীদের স্কুলে থাকতে হয়। অনেক প্রতিষ্ঠানে সকল ক্লাস সকাল ৯টায় শুরু করা হয় এবং ১২টায় প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি ছুটি দিয়ে তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বিকাল সাড়ে ৪টায় ছুটি দেওয়া হয়। মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতেও শ্রেণি সময় এমনই। অথচ শিক্ষাব্যবস্থার এই দুই স্তরে (প্রাথমিক ও মাধ্যমিক) সকলের শৈশব কাটে। ৪টা বা সাড়ে ৪টায় ছুটির পরে শিশুরা বাড়ির দিকে ছুটতে থাকে। তখন তাদেরকে দেখলে মনে হয় তারা যেন চৈত্রের দুপুরের রোদে পোড়া চারা গাছের ন্যায় ঢলে পড়ছে।
কিন্তু শিক্ষা সংশ্লিষ্ট নীতি নির্ধারক বিশেষজ্ঞরা তা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ। কারণ তারা প্রতিমাসে নানা অজুহাতে রাজকোষের বিপুল পরিমাণ অর্থ তছরুপ করেন। থাকেন বিলাস বহুল বাড়িতে; চলেন বিলাস বহুল গাড়িতে। আর রাজকোষের অর্থে দেশ-বিদেশ ভ্রমণতো আছেই। তাদের সন্তানদের লেখাপড়া চলে বিদেশে, নয়তো রাজধানীর কোনো বড় বড় প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে যেখানে কারাবন্দির মতো এত দীর্ঘ সময় থাকতে হয় না। এসি গাড়িতে যাতায়াত, গাড়ি ভর্তি নাস্তা আর ৩/৪ ঘণ্টা পরে বাসায় ফিরে যাওয়া। কিন্তু গ্রামের শিশুদের সেই সকালে দু’মুঠো পানি ভাত খেয়ে সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানে অবস্থান কতটা কষ্টের তা তাদের না বোঝারই কথা।
উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ক্লাস করে না। তা নিয়ে কোনো জোরাজুরি নাই। প্রতিদিন তাদের ক্লাস থাকে না এবং বেলা ১টা বা ২টার পরে তাদের কোনো ক্লাস থাকে না, অনার্স/মাস্টার্সের শিক্ষার্থীরা আরো স্বাধীন, তাদের ক্লাস সপ্তাহে চার থেকে পাঁচটা। বইগুলোও সেমিস্টার ভিত্তিক ভাগ করা। অথচ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের ওপর চাপানো হয়েছে বিশাল বইয়ের খড়গ। প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের ওপর আরো বই চাপাতে পারলেই মনে হয় সাধ মিটতো। কারিকুলাম বিশেষজ্ঞরা বয়স ও শ্রেণি ভেদে শ্রেণির সময়, বইয়ের সংখ্যা ও বইয়ের ভলিয়ম নির্ধারণে চরম ব্যর্থতার ছাপ রেখেছেন।
আবার সৃজনশীলের আক্রমণেও শিক্ষার্থীরা দিশেহারা। কারিকুলাম বিশেষজ্ঞরা সৃজনশীলের মানে বোঝেন কি-না সন্দেহ। সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর পড়ার জন্য যদি শিক্ষার্থীদের গাইড পড়তে হয়, তবে তা কেমন সৃজনশীল? যেখানে গাইড বই পড়া নিষিদ্ধ অথচ পরীক্ষায় গাইড নির্ভর প্রশ্ন করা হয়। সরকার প্রদত্ত বইয়ের ভলিয়ম বেশ বড়; যেখান থেকে সরাসরি প্রশ্ন করলে তাও বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। অতিরিক্ত বই ও বইয়ের বড় ভলিয়মের কারণে এত দীর্ঘ সময় শ্রেণি কক্ষে শিক্ষার্থীদেরকে আটকে থাকতে হয় এবং ক্লাসের পূর্বে ও পরে প্রাইভেট পড়তে হয় ও কোচিং করতে হয়।
শিক্ষার্থীদেরকে এখন যন্ত্র মানব বানানো হয়েছে। কিন্তু অতিরিক্ত বই আর দীর্ঘ সময় ক্লাসে থেকে শিক্ষার্থীরা কী শিখছে? গত ২৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- প্রাথমিকের ৭৫% শিক্ষার্থী বইয়ের অঙ্ক বোঝে না এবং ৬৫% শিক্ষার্থী বাংলা দেখে পড়তে পারছে না। যা অতিরিক্ত ও বড় বড় ভলিয়মের বইয়ের ফলাফল।
এ ছাড়াও সারা বছর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের র্যালি আর সমাবেশের নামে মানসিক চাপে রাখা হয়। অথচ এ সকল শিশুকে বেলা ১/২টার পরে বিশ্রামের দরকার। তারপর কিছু সময় বাড়িতে লেখাপড়া, বিকেলে খেলাধুলার প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের শিশুরা তা থেকে বঞ্চিত। শিক্ষকরাও একটানা সকাল থেকে বেলা ১টা বা ২টা পর্যন্ত পাঠদানের পর পরবর্তী ক্লাসগুলোতে শতভাগ মনোযোগ দিতে পারেন না। শিক্ষকরাও এখন যন্ত্রমানব। শুধু সরকারের আইন মানছে।
শ্রেণি সময় ৯টা থেকে ১টা বা সকাল ১০টা থেকে বেলা ২টার বেশি এবং অতিরিক্ত ও বড় বড় ভলিয়মের বই চাপিয়ে দেয়া অমানবিক শিশু নির্যাতন ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ কারিকুলাম বিশেষজ্ঞদেরকে অনুরোধ করব, আপনারা মানসম্মত শিক্ষা কারিকুলাম তৈরির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিন ও তাদের বাঁচানোর উপায় খুঁজে বের করুন।
লেখক: প্রভাষক, দুমকি ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসা, দুমকি, পটুয়াখালী।
[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন]