বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগ - দৈনিকশিক্ষা

বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগ

প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন |

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই পশ্চিম অংশ পূর্ব অংশের বাঙালিদের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানে এবং মানুষকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে শোষণ শুরু করে, যা স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের আগ পর্যন্ত চলতে থাকে। ফলশ্রুতিতে বাঙালিদের মনে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকে এবং বাঙালিরা এই অবিচারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু করে। এ সকল আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকতেন সমাজের সর্বস্তরের বুদ্ধিজীবীরা। তাঁরা সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বাঙালিদের বাঙালি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করতেন। তাঁদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফলেই জনগণ ধীরে ধীরে নিজেদের দাবি ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে থাকে, যা পরবর্তীতে রাজনৈতিক আন্দোলনের দিকে ধাবিত হয়।

বাঙালিদের এই জাগরণে এদেশের লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, সকল পর্যায়ের শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, চলচ্চিত্র ও নাটকের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সমাজসেবী ও সংস্কৃতিসেবীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালিদের দমিয়ে রাখার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের যে কোন হীন চক্রান্তের বিরুদ্ধে তাঁরা বারবার সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে জনসাধারনকে অনুপ্রেরণা ও সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। এজন্য বুদ্ধিজীবীগণ শুরু থেকেই পাকিস্তানের শাসকদের রোষানলে পড়েন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু থেকেই পাকিস্তানী বাহিনী বাছাই করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে থাকে। এছাড়া যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পাকিস্তানের পরাজয় যখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে, তখন বাঙালি জাতিকে শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবে দুর্বল এবং মেধাশন্য করার লক্ষ্যে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি করে তাঁদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। 


১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে সরকার গঠনের অধিকার অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক সরকার বাঙালির হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে কোনভাবেই রাজি ছিল না। যদিও ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের তারিখ নির্ধারিত ছিল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো সামরিক বাহিনীর অফিসারদের নিয়ে ষড়যন্ত্রের নীল নক্শা বুনতে শুরু করে। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১ মার্চ  তারা কোন কারণ ছাড়াই ৩ তারিখের নির্ধারিত অধিবেশন বাতিল  করে। এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। সারাদেশে বিক্ষোভের বিস্ফোরণ হয়। ঢাকা মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়। বঙ্গবন্ধু সারাদেশে ৫ দিনের হরতাল এবং অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। তাঁর আহ্বানে গোটা পূর্ব পাকিস্তান কার্যত অচল হয়ে পড়ে। সামরিক সরকার কারফিউ জারি করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। ৫ দিন হরতালশেষে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন।

টেক্সাসে বসবাসরত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত নথি সংগ্রাহক মাহবুবুর রহমান জালাল বলেন, “বিভিন্ন সূত্র ও দলিল থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রমাণিত হয় যে, ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যা ছিল অন্য কেউ তাঁর হয়ে ঘোষণা দেয়ার অনেক পূর্বে। ২৫ মার্চে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক ভেঙে গেলে ইয়াহিয়া গোপনে ইসলামাবাদে ফিরে যান এবং গণহত্যা চালানোর পর পাকিস্তানি সেনারা সেই রাতেই বঙ্গবন্ধুসহ তার পাঁচ বিশ্বস্ত সহকারীকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা লিখে যান। মূল ঘোষণার অনুবাদ নিম্নরূপ : "এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক"।

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট নামে ধবংসযজ্ঞ শুরু করে। দেশ বরেণ্য বুদ্ধিজীবীসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য শিক্ষককে ২৫ মার্চের রাতেই হত্যা করা হয়। পরিকল্পিত গণহত্যার মুখে সারাদেশে শুরু হয়ে যায় প্রতিরোধ যুদ্ধ। এদেশের স্বাধীনতাকামী সাধারণ মানুষ দেশকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর কব্জা থেকে স্বাধীন করতে কয়েক মাসের মধ্যে গড়ে তোলে মুক্তিবাহিনী। এ সময় প্রায় জীবন বাচাঁনোর জন্য কয়েক কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় গ্রহন করে। ভারত সরকার মুক্তিবাহিনীর সদস্যদেরকে প্রশিক্ষণসহ প্রায় ৯৫ হাজার আধুনিক সমরাস্ত্র প্রদান করে। এই বাহিনী সম্মুখ ও গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ চালিয়ে সারাদেশে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন প্রায় নয় মাস বাংলাদেশ ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর একান্ত প্রচেষ্টায় অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সাহায্য লাভ করে।  

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরের ৪ তারিখ হতে ঢাকায় নতুন করে কারফিউ জারি করা হয়। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের প্রশিক্ষিত আধা-সামরিক বাহিনী আল-বদর এবং আল-শামস বাহিনী স্বাধীনতাকামী বুদ্ধিজীবীদের একটি তালিকা তৈরি করে। ধারণা করা হয় পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে এ কাজের মূল পরিকল্পনাকারী ছিল মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। স্বাধীনতার পর ধ্বংসপ্রাপ্ত বঙ্গভবন থেকে প্রাপ্ত তার স্বহস্তে লিখিত ডায়েরী থেকে অনেক নিহত ও জীবিত বুদ্ধিজীবীর নাম পাওয়া যায়। এছাড়া আইয়ুব শাসন আমলের তথ্য সচিব আলতাফ গওহরের এক সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় যে, ফরমান আলীর তালিকায় তার বন্ধু কবি সানাউল হকের নাম ছিল।

আলতাফ গওহরের অনুরোধক্রমে রাও ফরমান আলী তার ডায়েরীর তালিকা থেকে সানাউল হকের নাম কেটে দেন। এছাড়া আলবদরদের জন্য গাড়ীর ব্যবস্থা তিনিই করেছিলেন বলে তার ডায়েরীতে একটি নোট পাওয়া যায়। তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ও পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যার ব্যাপক অংশটি সম্পন্ন করতে শুরু করে যুদ্ধ শেষ হবার মাত্র কয়েক দিন আগে। ডিসেম্বরে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী তাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী বুঝতে পেরে ১০ হতে ১৪ ডিসেম্বর সময়ের মধ্যে পরিকল্পনার মূল অংশ বাস্তবায়ন করে। চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীদের পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসরেরা জোরপূর্বক অপহরণ করে নিয়ে যায় এবং তাঁদের ওপর নির্মম-নিষ্ঠুর নির্যাতন ও নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। তাঁদের চোখে কাপড় বেঁধে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, রাজারবাগসহ অন্যান্য আরো অনেক স্থানে অবস্থিত নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে সেখানে তাঁদের উপর বীভৎস নির্যাতন চালায়। ১৪ ডিসেম্বরের হত্যাকা- ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম বর্বরোচিত ঘটনা, যা বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী মানুষকে স্তম্ভিত করেছিল। 

পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের পর ঢাকার মিরপুর, রায়ের বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবীদের লাশ ফেলে রাখে। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পরপরই নিকট আত্মীয়রা মিরপুর ও রাজারবাগ বধ্যভূমিতে স্বজনের লাশ খুঁজে পায়। পাকিস্তান বাহিনী দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পৈশাচিকভাবে নির্যাতন করেছিল, লাশজুড়ে ছিল আঘাতের চিহ্ন, চোখ, হাত-পা বাঁধা, কারো কারো শরীরে একাধিক গুলি, অনেককে ধাঁরালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে হত্যা করা হয় । লাশের ক্ষত চিহ্নের কারণে অনেকেই তাঁদের প্রিয়জনের মৃতদেহ শনাক্ত করতে পারেননি। ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত অসংখ্য স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে প্রাণ হারান।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসর কর্তৃক শহীদ হওয়া বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব (দর্শনশাস্ত্র), ড. মুনির চৌধুরী (বাংলা সাহিত্য), ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (বাংলা সাহিত্য), ড. আনোয়ার পাশা (বাংলা সাহিত্য), ড. আবুল খায়ের (ইতিহাস), ডঃ জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরদা (ইংরেজি সাহিত্য), ড. সিরাজুল হক খান (শিক্ষা), ড.  এ এন এম ফাইজুল মাহী (শিক্ষা), হুমায়ুন কবীর (ইংরেজি সাহিত্য), রাশিদুল হাসান (ইংরেজি সাহিত্য), সাজিদুল হাসান (পদার্থবিদ্যা), ফজলুর রহমান খান (মৃত্তিকা বিজ্ঞান), এন এম মনিরুজ্জামান (পরিসংখ্যান), এ মুকতাদির (ভূ-বিদ্যা), শরাফত আলী (গণিত), এ আর কে খাদেম (পদার্থবিদ্যা), অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য (ফলিত পদার্থবিদ্যা), এম এ সাদেক (শিক্ষা), এম সাদত আলী (শিক্ষা), সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য (ইতিহাস), গিয়াসউদ্দিন আহমদ (ইতিহাস), রাশীদুল হাসান (ইংরেজি), এম মর্তুজা (চিকিৎসক)। 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. হাবিবুর রহমান (গণিত বিভাগ), ড. শ্রী সুখারঞ্জন সমাদ্দার (সংস্কৃত), মীর আবদুল কাইউম (মনোবিজ্ঞান)। চিকিৎসক, অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি (হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ), অধ্যাপক ডা আলিম চৌধুরী (চক্ষু বিশেষজ্ঞ), অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দীন আহমেদ, অধ্যাপক ডা. আব্দুল আলিম চৌধুরী, ডা. হুমায়ুন কবীর, ডা. আজহারুল হক, ডা. সোলায়মান খান, ডা. আয়েশা নাদেরা চৌধুরী, ডা. কসির উদ্দিন তালুকদার, ডা. মনসুর আলী, ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা, ডা. মফিজউদ্দীন খান, ডা. জাহাঙ্গীর, ডা. নুরুল ইমাম,ডা. এস কে লালা, ডা. হেমচন্দ্র বসাক, ডা. ওবায়দুল হক, ডা. আসাদুল হক, ডা. মোসাব্বের আহমেদ, ডা. আজহারুল হক (সহকারী সার্জন), ডা. মোহাম্মদ শফী (দন্ত চিকিৎসক)। অন্যান্য : শহীদুল্লাহ কায়সার (সাংবাদিক),  নিজামুদ্দীন আহমেদ (সাংবাদিক), সেলিনা পারভীন (সাংবাদিক), সিরাজুদ্দীন হোসেন (সাংবাদিক), আ ন ম গোলাম মোস্তফা (সাংবাদিক), আলতাফ মাহমুদ (গীতিকার ও সুরকার), ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (রাজনীতিবিদ), রণদা প্রসাদ সাহা (সমাজসেবক এবং দানবীর), যোগেশ চন্দ্র ঘোষ (শিক্ষাবিদ, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক), জহির রায়হান (লেখক, চলচ্চিত্রকার),  মেহেরুন্নেসা (কবি), ড. আবুল কালাম আজাদ (শিক্ষাবিদ, গণিতজ্ঞ), নজমুল হক সরকার (আইনজীবী),  নূতন চন্দ্র সিংহ (সমাজসেবক, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক)।

২৫শে মার্চের কালোরাত্রি থেকেই ঘাতক-দালালরা বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ শুরু করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুর, ফজলুর রহমান খান, গোবিন্দ চন্দ্র দেবসহ আরো অনেকেই এই কালো রাত্রিতেই শহিদ হন। শুধু ঢাকা কেন সমস্ত পূর্ব পাকিস্তান জুড়েই চলছিল এই হত্যা প্রক্রিয়া। সিলেটে চিকিৎসারত অবস্থায় হত্যা করা হয় ডাক্তার শামসুদ্দিন আহমদকে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরো নয় মাসই সুপরিকল্পিতভাবে একের পর এক বুদ্ধিজীবী হত্যা চলতে থাকে। পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের ঠিক দুই দিন আগে ১৪ ডিসেম্বরের বীভৎস-নারকীয়-পাশবিক হত্যাকা-ের কোন তুলনাই হয় না। একসাথে এত বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনা এর আগে আর কোথাও ঘটেনি। ১৯৭১ এর ১৪ই ডিসেম্বর হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর স্বাধীনতা বিরোধী চক্র এদেশের বুদ্ধিজীবী, জ্ঞানী-গুণী ও মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের বিভিন্নস্থান থেকে ধরে এনে হত্যা করে। এই পরিকল্পিত গণহত্যাটি বাংলাদেশের ইতিহাসে বুদ্ধিজীবী হত্যাকা- নামে পরিচিত, যা আমাদের জাতীয় জীবনে নজিরবিহীন নৃশংসতা এবং এক ভয়ংকর নীলনকশা বাস্তবায়নের একটি প্রামাণ্য দলিল।

পাকিস্তানি আগ্রাসী বাহিনী প্রতারণামূলকভাবে একটি জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধকে বিদ্রোহ বলে অভিহিত করে তাদের সীমাহীন অপরাধগুলোকে লঘু করার চেষ্টা করে। এই যুদ্ধকে আন্তর্জাতিক সংঘর্ষে রূপদানের হীন প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ডিসেম্বরের ৩ তারিখে ভারতে বিমান হামলা করে ভারতকে এই যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলে। ডিসেম্বরের শুরুতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণের মুখে পর্যদুস্ত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ৯৩,০০০ হাজার পাকিস্তান সৈন্য আকস্মিকভাবে যুদ্ধ বিরতির বদলে আত্মসমর্পণের দলিল সই করে, যা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্ববৃহৎ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান । এসময় পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষ থেকে দলিলে সই করেন আমির আবদুল্লাাহ খান নিয়াজি। এরই মাধ্যমে নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের অবসান হয়।  প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙালি জাতির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। 


স্বাধীনতার ২৬ বছর পর ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনায় রমনা থানায় প্রথম মামলা দায়ের করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমেই পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ২০০২ খ্রিস্টাব্দে বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলার চূড়ান্ত প্রস্তাবনা দেয়।  দায়ের করা বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলাটি কীভাবে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইনে দায়ের করা যায়, সে ব্যপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের লিখিত প্রস্তাবনা চেয়েছিল। রমনা থানায় দায়ের করা বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলার বাদী ফরিদা বানু । তিনি এজাহারে বলেছেন, তার ভাই গিয়াস উদ্দিন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সিনিয়র লেকচারার ও মুহসীন হলের হাউস টিউটর ছিলেন। ১৪ ডিসেম্বর সকালে ঘাতকরা মুহসীন হল সংলগ্ন বাসায়গিয়ে তাকে না পেয়ে হলের দিকে যায়। হলের সামনে তাকে পেয়ে দারোয়ান আবদুর রহিমের গামছা নিয়ে চোখ বেঁধে ইপিআরটিসির একটি মাইক্রোবাস যোগে নিয়ে যায়। এরপর তিনি আর ফিরে আসেননি।

ঘাতকরা অন্যান্য হাউস টিউটরের বাসায়ও যায়। পরে তারা জানতে পারেন গিয়াস উদ্দিন আহমেদ ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে ড. মো. মুর্তজা, ড. আবুল খায়ের, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক সিরাজুল হক ও ড. সন্তোষ ভট্টাচার্যসহ আরো অনেককে ধরে নিয়ে গেছে আলবদররা। শহিদ বুদ্ধিজীবী মো. মুর্তজার ও সিরাজুল হকের ছেলে এনামুল হক অপহরণকারীদের দু’জনকে চিনতে পারেন। তারা হলেন চৌধুরী মাইনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান। দু’জনই তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তাদের মধ্যে আশরাফুজ্জামান তৎকালীন অবজারভার পত্রিকায় সাংবাদিকতা করতেন। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ৪ জানুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে তিনি তার আত্মীয় ড. মুর্তজা, ড. আবুল খায়ের ও ড. সন্তোষ ভট্টাচার্যসহ অনেক বুদ্ধিজীবীর গলিত লাশ দেখতে পান। ৫ জানুয়ারি মিরপুরের বর্তমান শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের কাছে গিয়ে তার ভাই গিয়াসউদ্দিন আহমেদের গলিত লাশ খুজে পান। লুঙ্গি ও জামা দেখে ভাইয়ের লাশ শনাক্ত করেন। বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি লন্ডনে ও নিউইয়র্ক প্রবাসী। তাদের দেশে ফিরিয়ে আনারও কোনো উদ্যোগ আজও নেওয়া হয়নি।
 

যুদ্ধের পুরো সময় জুড়ে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হলেও ১৪ ডিসেম্বরের মতো একসাথে এত বুদ্ধিজীবীকে অন্য কোন তারিখে হত্যা করা হয়নি, এজন্যই এই দিনটিকে “শহীদ বুদ্ধীজীবী দিবস” রূপে পালন করা হয়। বুদ্ধিজীবী হত্যার স্মরণে বাংলাদেশের ঢাকায় বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ স্থাপন করা হয়েছে। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশের যে সকল বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে তাঁদের স্মরণে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। এটি ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত। প্রতি বৎসর এই দিনটিতে আমরা আমাদের অকাল-প্রয়াত শ্রেষ্ঠ সন্তানদের আবেগাপ্লুত হয়ে স্মরণ করলেও স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরেও সেসব ঘাতক দালালের উপযুক্ত বিচার করতে পারিনি।

মানব জাতির মর্যাদা, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও ন্যায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের সকলেরই বিচার হওয়া উচিত। এজন্য প্রয়োজন স্থিতিশীল সরকার, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং জনগণের দৃঢ়অঙ্গিকার। ঘাতক দালাল চক্র এবং এদের দ্বারা মগজ ধোলাইকৃত উত্তরসূরিরা এদেশের আনাচে-কানাচে এখনও প্রবলভাবে সক্রিয় এবং তাঁরা স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রগতির পথ রুদ্ধ করে রাখার প্রচেষ্টায় লিপ্ত। বিনা অপরাধে এদেশের স্বাধীনতাকামী লক্ষ লক্ষ মানুষ ও বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের হাতে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র উপহার দিয়ে গেছে এসব ঘটনার সবিস্তার বর্ণনা এবং সাক্ষ্য প্রমাণ মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজম্মের সামনে হাজির করা জরুরি।

 

লেখক: পরিচালক (গবেষণা ও তথ্যায়ন), জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম), শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা

স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0045061111450195