বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সংক্ষেপে বাকৃবি এবং ইংরেজিতে Bangladesh Agricultural University (BAU) নামটি বাংলাদেশে তো বটেই সারা বিশ্বে অত্যন্ত সুপরিচিত। বাকৃবির যে কোন ফ্যাকাল্টি থেকে পাস করলে সবাই কৃষিবিদ নামে পরিচিত হতে পারেন। আর আমরা যারা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র বা অ্যালামনাই তারা সবসময়েই এ প্রতিষ্ঠানটির গর্বে গর্বিত হই। আমাদের গর্বিত হওয়ার কি কি কারণ রয়েছে তাও এখানে আমি অলোচনা করার চেষ্টা করব।
তৎকালীন পূর্ববাংলার নেতৃত্বের দাবির প্রেক্ষিতে পাকিস্তানি শোষক সরকারও কৃষিপ্রধান এ বঙ্গে কৃষিতে উচ্চশিক্ষার জন্য পূর্ব পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নামে এ প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু তখন প্রতিষ্ঠা করেই খালাস। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির প্রতি এতটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশটি স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষির গুরুত্ব অনুধাবন করেন। কারণ তিনি ছিলেন মাটি ও মানুষের নেতা। তিনি বুঝতেন কৃষির উন্নতি ছাড়া এ দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন অসম্ভব। তখন থেকেই তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়টিকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেন।
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কেই শুধু গুরুত্ব দিয়ে শেষ করেননি। তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন এ প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা নিয়ে বের হওয়া কৃষিবিদদেরকেও। কৃষিবিদরা লেখাপড়া করে দেশের জন্য অবদান রাখতেন ঠিকই কিন্তু তখন তাদের সামাজিক মর্যাদা ছিল না। তাদের চাকরিতেও দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীতে ফেলা হতো, আর নাগরিক হিসেবেও সেভাবেই অবমূল্যায়ন করা হতো। কিন্তু এ সমস্যা কি আর বেশিদিন চলতে পারে! কেন না জাতির জনক যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। তিনি তো আপামর জনসাধারণের নেতা। যেহেতু বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ, এদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে কৃষি ছাড়া বিকল্প নেই। আর সেটি করতে হলে উচ্চতর কৃষিতে শিক্ষিত কৃষিবিদদের মর্যাদা দিতে হবে।
১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের ১৩ ফেব্রয়ারি আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। তৎকালীন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (বাকসু) ও প্রশাসনের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে আয়োজিত এবং সিনিয়র কৃষিবিদ, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষার্থীসহ সব স্তরের মানুষের সামনে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে এসে এক অনুষ্ঠানে সগৌরবে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের পাশাপাশি এদেশের মাটি ও মানুষের সঙ্গে কাজ করা কৃষিবিদদের সরকারি চাকরিতে প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা পাওয়ার বিষয়টি। তারপর এ মর্যাদা নিয়েও বিভিন্ন সময়ে অপরাজনীতি হয়েছে। চেষ্টা করা হয়েছে আবারও দ্বিতীয় শ্রেণীতে নামিয়ে দেয়ারও। কিন্তু এ পর্যন্ত সব ষড়যন্ত্রই নস্যাৎ করে দিয়েছে। আর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ কৃষিবিদরা দেশ ও জাতিকে শুধু দিয়েই চলেছেন।
গর্বিত কৃষিবিদরা বঙ্গবন্ধু ঘোষিত সেই মর্যাদাকর দিনটিকে স্মরণ করে রাখার জন্য বিগত কয়েক বছর থেকে প্রতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারিকে কৃষিবিদ দিবস হিসেবে পালন করে আসছেন। আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কৃষিবিদ দিবসটি এখন শুধু একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়। এ দিবসটিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজধানী ঢাকার কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (কেআইবি), কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোসহ সারা দেশ এবং বহির্বিশ্বে বসবাসকারি কৃষিবিদরাও পালন করছেন। কেআইবি কর্তৃক ২০১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে কৃষিতে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ৮টি ক্যাটাগরিতে প্রতিবছর কেআইবি কৃষি পদক প্রদান করা হয়। উক্ত মর্যাদাকর পদকটি রীতি অনুযায়ী প্রতিবছরের ১৩ ফেব্রুয়ারিতে কৃষিবিদ দিবসের আলোচনা সভায় মহামান্য রাষ্ট্রপতির হাত দিয়ে তা পদক প্রাপ্তদের তুলে দেয়া হয়। শুধু তাই নয় দিবসটির গুরুত্ব বিবেচনায় এখন দাবি উঠেছে একে জাতীয় দিবস ঘোষণা করে জাতীয়ভাবে পালনের। আশা করি তাও হয়তো সম্ভব হবে অচিরেই।
এসব স্বীকৃতি ও সম্মানের জন্যই দেশ ও জাতির প্রতি কর্তব্য পালনে দায়বদ্ধ ও কৃতজ্ঞ কৃষিবিদরা নিরলসভাবে দেশের কল্যাণে কাজ করে চলেছেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা কৃষিবিদরা আজ শুধু যে কৃষি বা তার সাবসেক্টর গুলোই কাজ করে সফলতা অর্জন করতে সমর্থ হচ্ছে তাই নয়। দক্ষ কৃষিবিদরা ছড়িয়ে পড়েছেন বহুমুখী কর্মকান্ডে। প্রত্যেকটি কাজে তারা দক্ষতার পরিচয় দিয়ে চলেছেন। কী কৃষি ফসল উৎপাদনে, কী মৎস্য উৎপাদনে, কী পশুসম্পদ উন্নয়নে, কী কৃষি যান্ত্রিকীকরণে, এমনকি কৃষি অর্থনীতিতে পলিসি ও পরিকল্পনায় অবদান রেখে চলেছে। রয়েছে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি সেক্টরে। স্থানীয়, আঞ্চলিক ও জাতীয় রাজনীতিতেও রেখে চলেছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান আমাদের বাকৃবির কৃষিবিদরা।
একসময় বাংলাদেশে কৃষি শিক্ষার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলতে শুধু ময়মনসিংহস্থ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কেই বোঝানো হতো। দেশে নব্বইয়ের দশক পর্যন্তও মাত্র ছয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। সেগুলোর মধ্যে চারটি ছিল সাধারণÑ ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং দুটি ছিল বিশেষায়িত টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়Ñ বুয়েট ও বাকৃবি। আর তখন বাকৃবির অধীনে ঢাকার শেরেবাংলা কৃষি ইনস্টিটিউট, পটুয়াখালী কৃষি কলেজ, দিনাজপুরে হাজী মোহাম্মদ দানেশ কৃষি কলেজ এবং রাজশাহী কৃষি কলেজ ইত্যাদি কলেজগুলোর একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালিত হতো। তাদের সার্টিফিকেট বাকৃবি থেকে দেয়া হতো। কিন্তু পরে শেখ হাসিনার সরকার সেসব কলেজ বা ইনস্টিটিউটকে তো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করেছেই উপরন্তু দেশের বিভিন্ন জায়গায় অঞ্চলভিত্তিক আরও বেশ কিছু কৃষি এবং কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং আরও কয়েকটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম। আর কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বাকৃবি থেকে পাস করা কৃষিবিদরা শিক্ষক, কর্মকর্তা এমনকি ভিসি, প্রোভিসি, ট্রেজারারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পেয়ে থাকেন।
বাকৃবি থেকে পাস করা কৃষিবিদরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন সম্প্রসারণ ও গবেষণায়। কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ মাৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ গম গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পশুসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট ইত্যাদি। পল্লী উন্নয়ন কার্যকমের জন্য আরও রয়েছে কুমিল্লায় বার্ড এবং বগুড়ায় আরডিএ। আর এগুলোর সমন্বয় করে থাকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল। অপরদিকে সম্প্রসারণের জন্য রয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, মৎস্য অধিদফতর, প্রাণিসম্পদ অধিদফতর, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন ইত্যাদি ছাড়াও আরও অনেক সরকারি-বেসরকারি গবেষণা ও সম্প্রসারণ প্রতিষ্ঠান।
বাকৃবি হতে বের হওয়া কৃষিবিদদের একটি বিরাট অংশ কাজ করছে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। তারা সেগুলোর মাধ্যমে দেশ ও জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। বীজ উৎপাদন, কৃষি বাজারজাতকরণ, কৃষি পণ্যের সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাণিজ্যিক কৃষি খামারকরণ, কৃষি পণ্য রফতানিকরণ ইত্যাদি কাজে কৃষিবিবদরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। তারা কৃষিকে লাভজনক করার ক্ষেত্রে কাজ করছেন।
কৃষিতে বাকৃবির কৃষিবিদদের অবদানের কথা বলতে গেলে ইতিহাসের একটু পেছনে ফিরে তাকানো দরকার। স্বাধীনতার আগে ও অব্যবহিত পরে দেশে খাদ্যশস্যের অভাবে দুভিক্ষ পর্যন্ত হয়েছে। সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে সাড়ে সাত কোটি মানুষকে খাওয়ানো যেখানে একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল। কিন্তু আজ ষোলো কোটি মানুষের দেশতো খাদ্যে শুধু ম্বয়ংসম্পন্নই নয়। এখন খাদ্য উদ্বৃত্বের দেশ বাংলাদেশ। বিদেশে এখন আমরা খাদ্য রফতানি করছি। শুধু তাই নয় বাংলাদেশ এখন ধান উৎপাদনে বিশ্ব চতুর্থ, মৎস্য উৎপাদনে চতুর্থ হওয়াসহ কৃষির প্রতিটি সেক্টর ও সাবসেক্টরগুলোতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করছে।
সময়ের ব্যবধানে কৃষিই একমাত্র পেশা যার মাধ্যমে দেশকে আজ একটি জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে। আগেই উল্লেখ করেছি, যখন দেশে সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য খাদ্য মেটানো সম্ভব ছিল না আজ সেখানে ষোলো কোটিরও বেশি মানুষ পুরো তিনবেলা পেটপুরে খেয়ে সংসারে আয় উন্নতি করছে। পাল্টে গেছে আগেকার দিনের সেই চিরচেনা গ্রামীণ চেহারা। যদি উচ্চফলনশীল জাতের ধানের আবাদ না হতো তবে দেশে চার কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদন হতো না। উন্নত কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করতে না পারলে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার মানুষ খেতে পারত না। ব্রয়লার মুরগি না হলে মানুষ মুরগির মাংস ছাড়াই প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করত। ফার্মে উন্নত মুরগি পালনের মাধ্যমে ডিম উৎপাদন করতে না পারলে ডিম নামের বস্তু খুঁজে পাওয়া যেতো না।
এখন ইলিশ ছাড়া মিঠা পানির প্রায় সব মাছেরই চাষ হয় কৃষক পর্যায়ে। সেরকম মাছের জাত ও চাষের নতুন নতুন কৌশল ও প্রযুক্তি আবিষ্কার না হলে মাছ ছাড়াই বাঙালিকে প্রাণিজ প্রোটিনের চাহিদা মেটানোর প্রয়োজন হতো। গরু-ছাগল বিজ্ঞানসম্মতভাবে মোটাতাজা করে একদিকে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যাচ্ছে অপরদিকে মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। আর্টিফিশিয়াল ইনসিমেনেশনের মাধ্যমে গরু-ছাগলের জাত উন্নয়ন ঘটিয়ে দুধের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। আর ফলের কথা যদি বলি তাহলে বলতে হয় এখন বিদেশি কোন ফল আমদানি না করলেও আমাদের দেশীয় উন্নতমানের অনেক পুষ্টিকর ও সুস্বাদু ফল রয়েছে। কাজী পেয়ারা, বাউকুল, আপেলকুল, মাল্টা, কমলা, পেয়ারা, আঙ্গুর, কলা ইত্যাদির উন্নয়ন এখন চোখে পড়ার মতো। সারা দেশে এর সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে।
যাই হোক না কেন, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে বিগত ৫৭ বছরে এর এতবেশি অর্জন যে তা অল্প পরিসরে একটি আর্টিকেলের মাধ্যমে লিখে বর্ণনা করা যাবে না। তার জন্য শত সহস্র আর্টিকেলেও এর সমাপ্তি হবে না। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাকৃবিকে অবদানের জন্য আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বাকৃবির অবদান সর্বজনবিদিত।
এটি ভাবতে সত্যিই যারপরনাই আনন্দ হয় যখন শোনা যায় আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছি এবং তা করার সুযোগ পেয়েছি সেই বিশ্ববিদ্যালয়টি জরিপে এখন দেশ সেরা। তাও আবার দেশের কোন সংস্থা কর্তৃক নয়। কারণ দেশের কোন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক এ মূল্যায়ন হলে প্রশ্ন উঠতে পারত যে সেখানে বিচারে পার্সিয়ালিটি হয়েছে। কিন্তু একটি অনলাইনভিত্তিক বিদেশি সংস্থা কর্তৃক সেই দেশ সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি দিয়েছে আমার নিজের বিশ্ববিদ্যালয়কে। সেটি আর কোনটা নয় আমাদের সবার স্বপ্নের ও গর্বের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাচীন শহর ময়মনসিংহের পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের তীর ঘেঁষে ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের ১৮ আগস্ট প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়টি।
স্বাভাবকভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী হলো ১৮ আগস্ট। কিন্তু আমরা জানি আগস্ট বাঙালির জন্য শোকের মাস। সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জনদিনটি বর্ণাঢ্যভাবে তখন পালন করার সুযোগ পায়নি কর্তৃপক্ষ। আর সেই অনুষ্ঠানটি বর্ণাঢ্য ও রঙিনভাবে পালন করার জন্য এবারের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল ৭ অক্টোবর ২০১৭ তারিখ শনিবারে। সেজন্য বর্ণিল সাজে সজ্জিত করা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থাপনাকে। এদিনে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব প্রাক্তন গর্বিত ও প্রতিষ্ঠিত ছাত্রছাত্রী বিভিন্ন পর্যায়ের অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে গর্বিত করেছিলেন বর্ণিল এ অনুষ্ঠানটিকে।
আর এবারের ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের ২২ জুলাই ঘটে ইতিহাসের আরেকটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। বাকৃবি প্রতিষ্ঠার গৌরবের ৫৭ বছর উদ্যাপনের জন্য উদ্দেশ্যে এবং গর্বিত অ্যালামনাইদের পুনর্মিলনীর সঙ্গে হাওর ও চর উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্য যখন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সবার প্রিয় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ আসার বিষয়টি একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে। তার ঠিক আগের রাতে অর্থাৎ ২১ জুলাই তারিখে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি চত্বরে স্থাপিত প্যান্ডেলটি রহস্যজনকভাবে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সেখানেও কৃষিবিদদের দৃঢতার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। একজন হাওর ভূমিপুত্র এবং গ্রামীণ সাধারণ গর্বিত কৃষকের সন্তান রাষ্ট্রপতির কৃষি ও কৃষিবিদদের প্রতি ভালোবাসা তাকে সেখানে আসা থেকে কেউ নিভৃত করতে পারেনি। অপরদিকে যে কৃষিবিদরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে মঙ্গা দূরীকরণসহ দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পন্ন করে চলেছেন তারা কি আর অগ্নিকান্ডের ভয়ে ভীত হন! ঠিকই সবার সহযোগিতায় ২২ জুলাই তারিখেই সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে অনুষ্ঠানে সফল করে আরেকবার প্রমাণ করে দিয়েছেন কৃষিবিদরা।
এর আগে কালের পরিক্রমায় ২০১২ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয়টির ৫০ বছর পূর্তি পালন করা হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিগত অর্ধশতাব্দী ধরে বাংলার মানুষকে খাইয়ে বাঁচিয়ে নিয়ে চলেছে। এক সময়ের তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ এখন খাদ্যে শুধু স্বয়ংসম্পন্নই নয়, খাদ্যে উদ্বৃত্ত একটি দেশ এখন। এর পুরো কৃতিত্ব বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের। আগেই বলেছি, বাংলাদেশের কৃষিকে গুরুত্ব দেয়ার জন্য ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু সেখানকার গ্র্যাজুয়েটদের সম্মানিত করার জন্য সরকারি চাকরিতে প্রথম শ্রেণীর মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছিলেন। আর সেজন্যই সেখানকার গ্র্যাজুয়েটরা এখন দেশে-বিদেশে সংশ্লিষ্ট কৃষি ক্ষেত্রসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পজিশনে অবদান রেখে চলেছেন।
এখন দেশে কৃষির ওপর ভিত্তি করে আরও ১০-১২টি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু সবগুলো বিশ্বদ্যিালয়ের পথিকৃৎ হলো বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এখনো দেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিসিসহ অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে নেতৃত্ব দিচ্ছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা। রয়েছে পুলিশের এবং প্রশাসনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে। রয়েছে জাতীয় পর্যায়ের মন্ত্রী-এমপিসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদে। এগুলো একদিকে যেমন বিশ্ববিদ্যালয়কে গর্বিত করে ঠিক তেমনি সেসব বরণ্যে ব্যক্তিরাও নিজের বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে গর্ববোধ করে থাকেন। কর্মের খাতিরে আমিও এখন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্ট্রারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছি। কিন্তু আমার নিজের বিশ্ববিদ্যালয় বলতে এখানো আমার প্রিয় ক্যাম্পাস বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে কখনো ভুলতে পারি না।
তবে আমি যেহেতু বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে ময়মনসিংহেরই আরেকটি উপজেলা ত্রিশালে অবস্থিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়টিও এখন আমার নিজের আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়। কারণ সেটি বিগত প্রায় ৮ বছর ধরে আমাকে ভরণপোষণসহ নানাভাবে মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়টি উচ্চশিক্ষায় দেশসেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করার কিছু সূচক রয়েছে। আর সেগুলো হলো- শিখন পদ্ধতি, বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রভাব, নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ, অর্থনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা, সাম্প্রদায়িক সন্নিবেশ অর্থাৎ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত প্রভাব বিবেচনা করে ওয়েবমেট্রিক্স নামক একটি অনলাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। পড়াশোনার মান ও গবেষণা ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার কারণে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যায়র সেরা হয়ে তাদের জরিপে র্যাংকিংয়ে পরপর দু’বার বাংলাদেশের ১ নম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা পেয়েছে।
২০০৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ওয়েবমেট্রিক্স এ জরিপের ফলাফল প্রকাশ করে আসছে। স্পেনের শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্প্যানিস জাতীয় গবেষণা কাউন্সিলের করা র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের ১৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এবং তাদের অধীনস্থ কলেজের মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে এক নম্বরে দেখানো হয়েছে। সেখানে বুয়েট দ্বিতীয় এবং ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়কে তিন নম্বরে র্যাংকিং করা হয়েছে। তবে সারা বিশ্বের তালিকায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়রে অবস্থান ২০৬১তম। কাজেই একজন কৃষিবিদ হিসেবে এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে আমি তার এ অবস্থানের জন্য গর্ববোধ করি। আমার মতো সেটার সকলেই গর্ববোধ করেন বলেই আমার বিশ্বাস।
আমি একজন কৃষি ও পরিবেশ বিষয়ক লেখক হিসেবে বাকৃবিকে সবসময়ই তার গৌরবের জায়গায় তুলে ধরি। কৃষি বিষয়ক লেখালেখির মাধ্যমেই আমি পাক্ষিক কৃষি প্রযুক্তি লেখক সম্মাননা-২০১৫, বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার-১৪২২ এবং কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (কেআইবি) কৃষি পদক-২০১৮ পেয়েছি। সুতরাং কাজ করলে স্বীকৃতি পাওয়া যায় আমিই তার প্রমাণ। কাজেই একটি বিষয় বাকৃবির সব গর্বিত কৃষিবিদকেও মনে ও বুকে ধারণ করতে হবে যে, আমরা যে যেখানেই আছি, সেখানে থেকেই বাকৃবিকে সুউচ্চে তুলে ধরতে হবে। তবে এভাবেই আগামী দিনের জন্য বাকৃবিকে গুণে ও মানে এ সফলতা ধরে রাখতে হবে। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৭ বছরের পদযাত্রা সফল হোক এ কামনাই করি।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ
সৌজন্যে: সংবাদ