বাঙালির বাবুগিরি: লেঃ কর্নেল কাজী শরীফ উদ্দিন - দৈনিকশিক্ষা

বাঙালির বাবুগিরি: লেঃ কর্নেল কাজী শরীফ উদ্দিন

লেঃ কর্নেল কাজী শরীফ উদ্দিন, পদাতিক |

বাস্তবতার নিরিখে জীবনটা দুর্বিষহ কঠিন। জীবনের এই রূঢ় বাস্তবতা থেকে মুক্তি পেতে জ্ঞানের আলোয় অবগাহন করতে হবে, শিক্ষায় নিজেকে হতে হবে আলোকিত। জ্ঞানের মশাল জ্বালিয়ে সমাজ থেকে দূর করতে হবে সকল তমিস্রা। আলোকিত মানুষই অবদান রাখতে পারে নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, সর্বোপরি জগৎ সংসারের জন্য। ওরাই মূর্খ যাদের দম্ভ বংশকৌলিন্য নিয়ে, অহংকার যাদের আভিজাত্য নিয়ে। এরা নিজেদের শিক্ষিত দাবি করলেও প্রকৃত শিক্ষা থেকে এরা বঞ্চিত। মিথ্যা আভিজাত্যের সঙ্গে এদের বসবাস। মিথ্যা দম্ভই এদেরকে সর্বস্বান্ত করেছে। অহংকারই এদের উত্তরাধিকার। এরা অতীত ঐতিহ্য হাতড়ে মরে। নবাবী স্টাইলে জীবনকে চালাতে গিয়ে এরা সর্বস্ব হারিয়ে ফেলে। উন্নতির পরিবর্তে ক্রমাবনতি এদের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়।

এরা স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন, এদের মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটেনি বলে এরা জবরদস্তিপ্রিয়, সংকীর্ণমনা। এসকল সংকীর্ণমনা,  স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে মুক্তির উপায় খুঁজে বের করতে হবে, তা না হলে মিথ্যা আভিজাত্য তাদের পথের ভিখারী করতে কুণ্ঠিত হবে না। অবস্থাদৃষ্টে এমন নজির অপ্রতুলও নয়। প্রকৃত শিক্ষাই পারে এদের মিথ্যা আভিজাত্যের দম্ভকে ধূলিসাৎ করে কল্যাণের পথে অগ্রবর্তী করতে। বংশমর্যাদা বা তথাকথিত আভিজাত্য কোন মানুষের গৌরবের বিষয় হতে পারে না। নিজের কাজ নিজে করার মধ্যে অগৌরবের কিছু নেই। কর্মই মানুষকে মহীয়ান করে। মহামানবরা তো তাঁদের কর্ম দিয়েই মহামানব হয়েছেন; বংশমর্যাদা দিয়ে নয়। কর্ম যতই ছোট হোক, তাকে সম্মানের সাথে দেখতে হবে। যারা কর্মকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে তারা নির্ঘাত নীচ। হীনম্মন্যতায় ভোগার কারণেই তাঁদের এই নিচুতা।

এ সকল নীচ ও হীনমন্য মুনষ্যকে সামনের দিকে এগিয়ে না নিতে পারলে জাতির উন্নতির আশা কোথায়? এরা তো জাতিরই অংশ। জাতির কোন অংশকে বাদ দিয়ে একটি জাতির সামগ্রিক উন্নতির কি আশা করা যায়? অতএব এদেরকে সামনের দিকে, উন্নতির দিকে এগিয়ে নিতে প্রেরণা যোগাতে হবে। আর সে প্রেরণা যোগাতে পারে প্রকৃত বা আদর্শ শিক্ষা। এটি মানুষের মেধা-মনন, চিন্তা শক্তি, বিবেক-বুদ্ধি ও কাজ করার ক্ষমতাকে ধ্বংস করে। জাতি হিসেবে আমাদের পিছিয়ে পড়ার একটি অন্যতম কারণ শ্রমজীবী মানুষকে চরমভাবে অবহেলা করা। শ্রমজীবী মানুষের মূল্যায়নই হতে পারে জাতির উন্নতির মূল ভিত্তি। বর্তমান সময়ে আভিজাত্যর দোহাই তুলে সমাজের তথাকথিত স্থূলবুদ্ধির মানুষ নিষ্কর্মা হয়ে বাবু বনে যেতে মরিয়া। হাল ফ্যাশনের আভিজাত্য ধরে রাখতে তারা পৈত্রিকসূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ বিক্রি দিতে পিছপা হয় না। কাজকে ঘৃণা করার কারণে তারা সর্বস্ব হারায় এমনকি ভিটে-বাড়ি পর্যন্ত। পরিণামে এদের জীবন হয়ে উঠে দুঃখ-দুর্দশার সূতিকাগার।

আমার জন্ম গ্রামবাংলার এক নিভৃত পল্লীতে, সেখানেই আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে। স্বচক্ষে দেখেছি কত মানুষের উত্থান-পতন। এককালের ধনী মানুষকে দেখেছি শেষ জীবনে ভিক্ষা করতে। সম্ভ্রান্ত বড়লোক বাবার অশিক্ষিত ছেলেকে দেখেছি রিক্সা চালাতে, এমনকি দিনমজুর হতে। অথচ যৌবনে তারা ছিল পৈত্রিকসূত্রে সম্পদশালী। নবাব আমাদের গ্রামেরই একজন সম্ভ্রান্ত বড়লোক বাবার সন্তান। তার আভিজাত্যের দেমাগ এতই বেশি যে অহংকারে পা যেন মাটিতে পড়ে না। সে একটা সাবান একবারই ব্যবহার করত, একবার ব্যবহার করে হয় সাবানটা অন্যকে দিয়ে দিত নতুবা পুকুরে ফেলে দিত। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে লোকটিকে দেখেছি ভিক্ষা করতে। এটা তার অজ্ঞতা এবং বাবুগিরির পরিণতি।

আমাদের সমাজে কিছু লোক রয়েছে যাদের বাবুগরিরির স্বভাব রয়েছে। তাদের স্বভাব হচ্ছে- “ঘরে নাই নোন, ফইকরার পকপকি শোন”। এরা আয়-রোজগার কিছু করে না, কিন্তু স্টাইলটা ধরে রাখা চাই। বাবরি চুল, ইস্ত্রি জামা, দামি জুতা আরো কত কী! বাবুগিরি করতে গিয়ে তারা সব সম্পত্তি নষ্ট করে ফেলে। জীবনের শেষে তারা হয় দিনমজুর কিংবা ভিক্ষুক। ড. মাযহারুল ইসলাম একটি কলামে আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, ‘আমাদের পাশের দেশের পশ্চিমবঙ্গের লোকজন হাটে, যত ট্রামে চলাফেরা করে, জীবিকায় যত পরিশ্রম করে, যত মিতব্যয়ী, আমরা গরিব দেশের মানুষ হয়েও সে সবের ধারেকাছে নেই। আমাদের দেশের লোকজন এতই সাহেব তারা ইংরেজদেরকেও হার মানিয়েছে। বাবুগিরিতে কথায় কথায় রিক্সা চাপে, একটা হালকা বোঝা বাসায় নেয়ার জন্য আধপেটা খেয়েও কাজের লোক খোঁজে। নিজের আত্মসম্মানের ভয়ে আমরা বেকার ও উপোস থাকতে রাজি কিন্তু কোন ছোট কাজ করতে রাজি নই।

প্রখ্যাত লেখক ও একুশ গানের রচয়িতা আব্দুল গাফফার চৌধুরী তাঁর ‘সুন্দর হে সুন্দর’ প্রবন্ধে লিখেন ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর টাকার জন্য কুলিগিরি করেননি, ভদ্রলোকদের মুখে চপেটাঘাত করার জন্য কুলিগিরি করতেন।’ চরমপত্র-খ্যাত  লেখক এমআর আখতার মুকুল বেকার জীবনে চুরি ব্যতীত এমন কোন কাজ নেই যা তিনি করেননি। পল্লীকবি জসীম উদ্দীন কলকাতা গিয়ে হকারগিরি অর্থাৎ পত্রিকা বিক্রি করতেন। কিন্তু আজকাল আমরা সামান্য লেখাপড়া করে সাহেব হয়ে যাই। আমাদের যুব সমাজকে ঘোড়া রোগ পেয়ে বসেছে। ঠুনকো আভিজাত্যবোধ, সংকোচ, লজ্জা, অহংকার, দেমাগ, বাবুগিরি, অন্তঃসারশূন্য ভদ্রলোকি এসব আমাদের চিন্তা-চেতনায় প্রশ্রয় পেয়েছে, আমরা লেফাফাদুরস্ত হয়ে গেছি। যা আমাদের দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

কোথায় উন্নত বিশ্বের মানুষের মনমানসিকতা, কোথায় আমাদের মানসিকতা। বাঙালি সন্তানরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গর্বে তাদের পা যেন মাটি স্পর্শ করে না। অথচ কোরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাস্তায় বসে জুতা সেলাই করে। চীন-জাপানের মানুষের মধ্যে সামান্যতম ঠুনকো আভিজাত্য নেই। টাকার জন্য সৎপথে যে কোন কাজ করতে প্রস্তুত তারা। তারা সমাজতন্ত্রের একটি মন্ত্র মেনে চলে ‘সাধ্য অনুসারে শ্রম দাও, প্রয়োজন অনুসারে ভোগ কর।’ তারা পরনির্ভরতাকে ঘৃণা করে। কিন্তু আমরা বাঙালিরা ১০০ টাকা রোজগার করলে ১৫০ টাকা খরচ করি। তাই আমাদের দারিদ্র্য ঘোচে না। আয় বুঝে ব্যয় করা, অপ্রয়োজনীয় খরচ থেকে দূরে থাকা, সঞ্চয়ের মনোবৃত্তি গড়ে তোলা, কুঅভ্যাস পরিহার করার প্রবণতা দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই তৈরি হওয়া দরকার ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তা হয়নি।

আমরা কিছু পেশাকে ঘৃণা করি অভাবকে ঢেকে রাখি, ভদ্র আচরণে চুরি করি, ঋণ করে ঘি খাই, দেনার দায়ে জর্জরিত হই। শ্বশুরের ঘাড়ে চেপে হোন্ডা কিনতে কিংবা মাদকাসক্ত হতে লজ্জাবোধ করি না। বাবুগিরি বা ঠুনকো ভদ্রলোকি ত্যাগ করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কাজ করে সৎপথে জীবিকা নির্বাহ করতে চাইনা। বাবুগিরি এবং আভিজাত্যের মিথ্যা দেমাগ দেখিয়ে কেউ মহামানব হতে পারেননি, কর্ম ও পরিশ্রম ছাড়া কোন জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না। কবি নজরুল রুটির দোকানে কাজ করেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান লুঙ্গি পড়ে স্কুলে যেতেন, হিটলারের প্রথম পেশা ছিল পোস্ট কার্ড বিক্রয়। পল গঁগ্যা ছিলেন মাটি কাটার শ্রমিক। উইলিয়াম শেক্সপিয়র ছিলেন থিয়েটার হেলপার। এপিজে আব্দুল কালাম ছিলেন পত্রিকার হকার, ফিদেল ক্যাস্ট্রো এক্সট্রা চিত্রাভিনেতা, হো চী মিন হোটেলের বাবুর্চি হিসেবে কাজ করেছেন। ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভা সুতোকলের শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন। জিমি কার্টার বাদাম বিক্রি করে লেখা পড়া চালিয়েছেন। দানবীর হাজী মহসিন টুপি সেলাই করতেন। বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী গবেষণা করলে অধিকাংশের ইতিহাস এ রকমই। আমি টিউশনি করে লেখা-পড়ার খরচ চালিয়েছি, এতে আমার লজ্জা নেই, এটাই আমার অহংকার। অতএব বাঙালির বাবুগিরিকে এখনই গলা টিপে বধ করতে হবে। নইলে জাতি যে নিরাশার অতল গহ্বরে হারিয়ে যাবে।

লেঃ কর্নেল কাজী শরীফ উদ্দিন, পদাতিক: অধ্যক্ষ, সরকারি মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল এন্ড কলেজ

এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ - dainik shiksha এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0054628849029541