গাইড বই থেকে হুবহু তুলে দেয়া হয়েছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের এসএসসির বাংলা প্রথম পত্রের প্রশ্ন। এ বিষয়ে দৈনিক শিক্ষাডটকমে প্রতিবেদন দেখে বিষয়টি তদন্ত জড়িতদের চিহ্নিত করার নির্দেশ দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। একই সাথে তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা জানাতে ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবুল খায়ের দৈনিক শিক্ষাডটকমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, গাইড বই থেকে হুবহু প্রশ্ন তুলের দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এই সমস্যা সমাধানে সরকার শতভাগ তৎপর থাকবে এবং ষোল আনাই সমস্যা এড়াতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। ২০১৮ সালের প্রশ্নপত্র পুনরাবৃত্তি সম্পর্কেও কথা বলেন শিক্ষামন্ত্রী। তিনি বলেন, প্রতিবছর নিয়মিত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অনিয়মিতরাও পরীক্ষা দেন। মন্ত্রণালয়ের কঠোর নির্দেশনা আছে, নিয়মিত-অনিয়মিত শিক্ষার্থীদের ভিন্ন কক্ষে পরীক্ষা নিতে হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কেন্দ্র সচিব এই নির্দেশনা অনুসরণ করেননি বলেই এ বিভ্রাট হয়েছে বলে যুক্তি দেন মন্ত্রী। আরো বলেন, প্রশ্ন তৈরিতে ভালো শিক্ষকের অভাব আছে। ভবিষ্যতে সেটি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে বলে আশা করেন ডা. দীপু মনি।
এদিকে গাইড বই থেকে হুবহু তুলে দেয়ার ঘটনা তদন্ত শুরু হয়েছে বলে দৈনিক শিক্ষাডটকমকে নিশ্চিত করেছেন ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এস এম আমিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, গাইড বই থেকে এসএসসির পরীক্ষায় প্রশ্নতুলে দেয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিষয়টি তদন্তে একটি টিম গঠন করা হয়েছে। টিম জড়িতদের খুঁজে বের করতে কাজ করছে।এছাড়া ভুল প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেয়ায় অভিযুক্তদের শাস্তি দেয়া হবে। নতুন ও পুরাতন সিলেবাসের পরীক্ষার্থীদের আলাদা কক্ষে বসানোর নির্দেশ দেয়া হলেও তা মানছেন না কতিপয় কেন্দ্র সচিব। ফলে বারবার এমন ঘটনা ঘটছে।
গতকাল সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) বাংলা প্রথম পত্র পরীক্ষায় বেশ কয়েকটি প্রশ্ন গাইড বই থেকে হুবহু তুলে দেয়া হয়েছে। মোট ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় ৭০ নম্বরের সৃজনশীল। আর ত্রিশ নম্বরের এমসিকিউ। সৃজনশীল প্রশ্নের মধ্যে ৪০ নম্বরই হুবহু বাজারি গাইড বই থেকে কমন পড়েছে। অথবা অন্যভাবে বলা যায়, ৪০ নম্বরের প্রশ্ন তিন/চার বছর আগের অন্য শিক্ষা বোর্ডের প্রশ্নের সাথে প্রায় মিল। অথচ পুরনো প্রশ্ন না দেয়ার বিধান রয়েছে। উদ্দীপক অংশের কোনো কিছুই মেলার কথা নয়। এছাড়া এমসিকিউ অংশের কয়েকটি প্রশ্নের রয়েছে একাধিক উত্তর। ভুল প্রশ্নও রয়েছে। এতে বিভ্রান্ত হয়েছে পরীক্ষার্থীরা। তারা ক্ষতিগ্রস্থ। শিক্ষা বিষয়ক দেশের একমাত্র ডিজিটাল পত্রিকা দৈনিক শিক্ষার অনুসন্ধানে এ তথ্য জানা যায়।
এর আগে গতকাল ৩ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বাংলা প্রথম পত্রটিতে কুমিল্লা ও সিলেট বোর্ডের ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের একটি উদ্দীপক ও সংশ্লিষ্ট প্রশ্ন হুবহু এ বছরের ৯নং প্রশ্ন হিসেবে সেট করা হয়েছে। উপন্যাস অংশের সাথে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের বাংলা প্রথম পত্রের উপন্যাস অংশের ৮নং প্রশ্নটি এবছরের উপন্যাস অংশের ১০ নং প্রশ্ন হিসেবে সেট করা হয়েছে। যেখানে শুধু ক নং প্রশ্নটি পরিবর্তন করা হয়েছে। যেটা কাম্য নয়। এ প্রশ্নগুলো বিগত কয়েক বছর ধরে টেস্ট পেপার ও গাইড বইতে ছিল।
আরও পড়ুন :
একটা বাংলা প্রশ্ন করতে পারে না, শিক্ষা বোর্ড চালায় কীভাবে : ড. জাফর ইকবাল
গাইড থেকে হুবহু প্রশ্নে এসএসসির বাংলা পরীক্ষা, আছে ভুলও
আবারো ভুল প্রশ্নে এসএসসি পরীক্ষা, শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের বিক্ষোভ
হুবহু বাজারি গাইডের প্রশ্ন এসএসসি পরীক্ষায়, তদন্ত শুরু
ঢাকা বোর্ড ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ৮নং প্রশ্ন ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ৮ নং প্রশ্ন হিসেবে সেট করা হয়েছে। যদিও এখানে নাম ও ক নং প্রশ্নটি যদিও সামান্য পরিবর্তন করা হয়েছে।
বরিশাল বোর্ড ২০১৭ এর ২নং প্রশ্ন ঢাকা বোর্ড ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ৩নং প্রশ্ন হিসেবে সেট করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে শুধু চরিত্রের নাম শিউলীর বদলে পারুল করা হয়েছে।
এছাড়া এমসিকিউ অংশের প্রশ্ন নং ১৯, ২১, ২৩, ২৫, ২৯ ও ৩০-এর একাধিক উত্তর। পরীক্ষার্থীরা দৈনিক শিক্ষাডটকমের কাছে অভিযোগ করে বলেছেন, উত্তরগুলো কনফিউজিং। একটাই সঠিক উত্তর থাকার কথা থাকলেও কোনো কোনোটিতে তিনটি পর্যন্ত সঠিক উত্তর রয়েছে।
প্রতিটি বোর্ডে আলাদা প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা হয়। এর আগে সব সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে একপ্রশ্নপত্রে পরীক্ষা হতো।
সৃজনশীল পদ্ধতির উদ্দেশ্যই হচ্ছে শিক্ষার্থীদের সৃষ্টিশীলতা বাড়ানো এবং মুখস্থবিদ্যা ও গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরতা কমানো। এ কারণে পাঠ্য বইয়ে প্রশ্ন দেয়া থাকে না। যে নমুনা প্রশ্ন থাকে তাও তুলে দেয়া যায় না। প্রশ্ন উদ্ভাবন করতে হয়। এ কারণে এক পরীক্ষার প্রশ্ন আগের কোনো পরীক্ষার প্রশ্নের সঙ্গে মিলবে না। কোনো গাইড থেকেও প্রশ্ন কমন পড়বে না। কিন্তু বারবারই এমন ঘটনা ঘটছে।
যদিও গতরাতে গাইড বই থেকে হুবহু তুলে দেয়া প্রশ্নপত্রের এ বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে দৈনিক শিক্ষাডটকমকে গতানুগতিক জবাব দেন। কেউ কেউ বলেন, না এটা হতে পারে না। একটু হলেও পরিবর্তন আছে। আবার কয়েকজন বলেছেন, কারা এই প্রশ্ন করেছে তাদেরকে খুঁজে বের করে শাস্তি দেয়া হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে জিপিএ ফাইভ বিক্রি, পরীক্ষক ও প্রধান পরীক্ষক, প্রশ্নকর্তা, প্রশ্ন সেটার ও মডারেটর এবং টাকার বিনিময়ে একাডেমিক স্বীকৃতি, পাঠদান অনুমতি, কমিটি অনুমোদন ইত্যাদি অভিযোগ শিক্ষা বোর্ডগুলোর বিরুদ্ধে। কিন্তু সব অভিযোগেরই সেট করা উত্তর।
গাইড বই থেকে প্রশ্ন তুলে দেয়ার ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের জেএসসি পরীক্ষায়ও গাইড বই থেকে হুবহু প্রশ্ন তুলে দিয়ে জেএসসি পরীক্ষার বাংলা প্রথম পত্রের প্রশ্ন করা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষায় যেখানে বাজারী প্রশ্ন কিংবা গাইড বই থেকে প্রশ্ন করা নিষিদ্ধ, সেখানে বোর্ডের প্রশ্ন গাইড বইয়ের সঙ্গে হুবহু মিলে গেলে শিক্ষা প্রশাসনে তোলপাড় শুরু হয়। ওই প্রশ্নটি কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে তৈরি হয়েছিল বলে জানা যায়। তৎকালীণ কুমিল্লা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ শাখায় কর্মরত বিসিএস সাধারণ শিকা ক্যাডার কর্মকর্তাকে সম্প্রতি বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান করা হয়েছে। এই চেয়ারম্যান নিজে আরবি পড়তে, বলতে ও লিখতে পারেন না।
এর আগে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড এইচএসসির ইংরেজি প্রশ্নপত্র ও এসএসসির পদার্থ বিজ্ঞানের ইংরেজি ভার্সনের প্রশ্নপত্র হুবহু গাইড বই দেখে তৈরি করলে দেশব্যাপী হইচই শুরু হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব ও এস এস মাহমুদকে দিয়ে কমিটি তৈরি করা হলেও সেই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। কারণ ওই প্রশ্নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত সরকারি কলেজের কয়েকজন শিক্ষক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কয়েকজন কর্মকর্তা। এছাড়া তদন্ত ধামাচাপা দিতে মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেন তো ছিলই। সেই সময়ে ঢাকা বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা শ্রীকান্ত চন্দ্র চন্দ ও শাহেদুল খবীর চৌধুরী বর্তমানে যথাক্রমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সরকারি কলেজ শাখা উপসচিব ও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের কলেজ ও প্রশাসন শাখার পরিচালক।
বছরের পর বছর ধরে প্রশ্নফাঁসের তথ্য চেপে রাখা সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ নোট ও গাইড বইয়ের ব্যবহার ও গাইড বই থেকে প্রশ্ন তুলে দেয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। সর্বশেষ তিনি ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ সেপ্টেম্বর বিকেলে কুমিল্লা জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে এক মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, ‘গাইড বই থেকে প্রশ্ন করলে চাকরি থাকবে না, এমপিও বন্ধ হয়ে যাব।’ কিন্তু গাইড বই থেকে প্রশ্ন তুলে দেয়ার সময় কুমিল্লা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক শাখায় থাকা বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের সেই কর্মকর্তা বর্তমানে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান। আর যারা প্রশ্ন তৈরি ও মডারেশন করেছেন তাদের কাউকে খুঁজে বের করেনি মন্ত্রণালয়।
দৈনিক শিক্ষার অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে গাইড বই থেকে রাজশাহী বোর্ডের প্রশ্ন প্রণয়নের অভিযোগে এমপিও বাতিল করার উদ্যোগ নেয়া হয় দুইজন বেসরকারি কলেজ শিক্ষকের। তারা হলেন সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার আরআইএম ডিগ্রি কলেজের ফিন্যান্স বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক শাহ প্রবীর মিত্র এবং একই জেলার চৌহালী উপজেলার চৌহালী ডিগ্রি কলেজের ফিন্যান্সের প্রভাষক মমতাজ বেগম।
প্রভাষক মমতাজ বেগম এবং শাহ প্রবীর মিত্র উভয়ের বিরুদ্ধেই দায়িত্বে অবহেলা করে গাইড বই থেকে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের প্রশ্নপত্র প্রণয়নের অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই নভেম্বরের এক পত্রে এমন কাণ্ডের জন্য অভিযুক্ত দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে? দৈনিক শিক্ষার এমন প্রশ্নের জবাবে কোনও তথ্যই দিতে পারেনি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের কোনও কর্মকর্তা।