সারা দেশের মানুষ কোচিং বাণিজ্যের লাগামহীন প্রসারে অতিষ্ঠ। সর্বত্র কোচিং বাণিজ্যে লাগাম টানার আলোচনা। অথচ শিক্ষা আইন, ২০২০-এ বাণিজ্যিক কোচিং চলমান রাখার বিধান থাকছে বলে পত্রিকান্তে প্রকাশ পেয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষা আইন প্রণয়নের কথা। ২০১১ সালে শিক্ষা আইন প্রণয়নের প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ২০১২ সালে প্রথম খসড়া প্রণয়ন করে তা ২০১৩ সালে জনমত যাচাইয়ের জন্য প্রকাশ করে মন্ত্রণালয়। আপসকামিতা শিক্ষা আইনকে চূড়ান্ত করতে দিল না। এরই মধ্যে মন্ত্রণালয় তিনবার খসড়া পরিবর্তন করে এবং দুজন সচিবকে পরামর্শক নিয়োগ দিয়ে খসড়া আইনটি চূড়ান্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, এ বছরই শিক্ষা আইন চূড়ান্ত হবে। যদি বাণিজ্যিক কোচিং চলমান রাখা হয় এবং সঙ্গে যদি নোট-গাইড বই ব্যবহার এ আইনের আওতায় এসে যায়, তবে আশা করা যায় আর কোনো বাধা থাকবে না। এমন শিক্ষা আইন ১০ বছরের প্রচেষ্টায় চূড়ান্ত হবে—এটা এখন নিশ্চিত।
দেশের সব শিক্ষার্থী আর অভিভাবকের কাছে কোচিং, টিউশন এবং প্রাইভেট এখন গোদের ওপর বিষফোঁড়া। অভিভাবকরা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সন্তানদের নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন পরিবেশ পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না গিয়ে কোচিং ক্লাসে আগ্রহী হতে বাধ্য হচ্ছে। শিক্ষকরাও সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রাইভেট পড়িয়ে চলেছেন। কখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যান এবং কখন ফিরে আসেন, তা বোঝা যায় না। এ পরিস্থিতি একদিনে সৃষ্টি হয়নি। ফাঁকি দিয়ে ফাঁক পূরণ করে গোঁজামিলের মিলন সেতু তৈরি করতে গিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থায় বর্তমান পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষকদের কোচিং নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা তৈরি করে বাণিজ্যকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়েছে বলে সাধারণ মানুষ মনে করে। আগে যা নিষিদ্ধ ছিল, লজ্জার কাজ ছিল, তা নীতিমালার কল্যাণে প্রকাশ্যে আনতে বাধা রইল না। সুযোগসন্ধানী সুবিধাবাদীরা সোৎসাহে নিজেদের রাজত্ব তৈরি করে নিল।
শিক্ষা আইন প্রণয়নে দীর্ঘসূত্রতায় সাধারণ মানুষের কাছে একটি বিষয় স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান, মন্ত্রণালয় গোষ্ঠীস্বার্থের কাছে আবারো পরাজিত হতে চলেছে। এর আগে পরিবহন আইন করার সময় একই পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছিল। দীর্ঘ সময় ধরে স্বার্থবাজ মানুষের সঙ্গে টানাপড়েন চলার পর নতিস্বীকার করে আইন প্রণয়ন করা হয়। এখানেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। যতক্ষণ না পর্যন্ত বাণিজ্যিক কোচিংয়ের পক্ষে শিক্ষা আইনে ধারা সংযুক্ত করা হয়েছে, আইনটি ততদিন ঝুলে ছিল। অনেকদিন আগে পত্রিকায় পড়েছিলাম দেশে সে সময়ে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার কোচিং বাণিজ্য চলমান ছিল। এতদিনে তা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে তা গবেষণার বিষয়। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের কোচিং বাণিজ্যে যদি এমন বিশাল অর্থের লেনদেন হয়, তবে সারা দেশে চলমান প্রাথমিক শিক্ষা কোচিংয়ে লেনদেনকৃত অর্থের বিশালত্বও কম নয়। সারা দেশের সব পর্যায়ের কোচিংকে যদি হিসাবের মধ্যে আনা হয়, তবে তার বিশালত্ব বিবেচনা করে শিক্ষা আইন কোচিংকে স্বীকৃতি দেবে—এটাই স্বাভাবিক।
শিক্ষা আইন চূড়ান্ত করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সচিব পর্যায়ের দুজন সাবেক কর্মকর্তাকে পরামর্শক নিয়োগ করেছে। বিষয়টি শিক্ষা আইন, কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কাউকে দায়িত্ব দেয়া হলো না। দায়িত্ব দেয়া হয়েছে প্রশাসন ক্যাডারের ব্যক্তিদের। সর্বরোগের মহৌষধের খোঁজে একের মধ্যে বহু পাওয়ার প্রচেষ্টা। এতে সংবিধান, শিক্ষানীতি, শিক্ষা আইন, শিক্ষা ব্যবস্থা, দেশ ও জনগণের চাহিদার সমন্বয় হচ্ছে এমন দাবি করা যাবে না। কেবল গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষার প্রবণতা প্রবল হচ্ছে। শিক্ষাবৈষম্য সৃষ্টির হাতিয়ারে পরিণত হচ্ছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষার হারে উন্নতি হলেও শিক্ষার গুণগত মান, শিক্ষার সঙ্গে কৃষি-শিল্প খাতের যোগাযোগ হচ্ছে না। সর্বোপরি জ্ঞান ব্যবস্থাপনা দেশের উন্নয়ন কৌশলে স্থান করে নিতে পারছে না কোনোভাবেই। বিষয় বিশেষজ্ঞদের অবজ্ঞা করার ফল সাধারণ জনগণের ওপর বিশাল প্রভাব ফেললেও তা বিবেচ্য হচ্ছে না। দেশের উন্নয়নের সুফল মুষ্টিমেয় ৪-৫ শতাংশ মানুষ ভোগ করছে, বিপরীতে ৯৫-৯৬ শতাংশ মানুষ বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে।
দেশের শিক্ষাবিদদের পাস কাটিয়ে রাজনীতি আর প্রশাসনের দ্বৈতরথে আরোহণের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের বোর্ড নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের ফলে শিক্ষার্থীরা আজ পরীক্ষামুখী হয়ে উঠেছে। এতে শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবইনির্ভর না হয়ে নোট-গাইডনির্ভর হয়ে পরীক্ষার জন্য যতটুকু প্রয়োজন, ঠিক ততটুকুর মধ্যে পড়াশোনা সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে। এখানে শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের পাশে সহায়ক হিসেবে দাঁড়িয়েছে কোচিং-প্রাইভেট। শিক্ষা পণ্য হয়ে গেছে। কোচিং বাণিজ্যের পাশাপাশি নোট-গাইড বাণিজ্য অবারিত হয়ে গেছে। দেশে যে যেভাবে পারে নিজেদের বাণিজ্য প্রসারে নিবেদিত। এখন যে বিশাল বাণিজ্যের ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে সাধারণ মানুষকে শিক্ষা আইন মুক্তি দিতে সক্ষম—এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। গোষ্ঠীস্বার্থে মুক্তি আসবে না, এটাই স্বাভাবিক।
দেশের শিক্ষার্থীরা জ্ঞানমুখী, শ্রেণীকক্ষ শিক্ষার্থীর শিক্ষার মূল ক্ষেত্র, শিক্ষার্থীদের পথপ্রদর্শক শিক্ষক হলে, তবেই শিক্ষার্থীরা নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধে ভালো-মন্দের পার্থক্য অনুধাবন করে সঠিক পথে চলতে সক্ষম হতো। কিন্তু এ চাওয়ার সঙ্গে আমাদের শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের চাওয়ার মিল আছে কিনা, সে বিষয়ে সাধারণ মানুষের সন্দেহ থেকেই যায়। শিক্ষার উন্নয়নে সরকার প্রতিদিন নতুন কিছু না কিছু করছে বা করবে বলেই চলেছে। কিন্তু এ কর্মযজ্ঞে শিক্ষা ব্যবস্থার মূল নিয়ামক শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের জ্ঞানমুখী করার উদ্যোগ যেমন উপেক্ষিত হয়েছে, ঠিক তেমনিভাবেই শিক্ষকদের অধিকারসহ যথাযথ মর্যাদা দেয়ার উদ্যোগও উপেক্ষিত রয়ে গেছে। দেশে বিভিন্ন সময় পেশাজীবীদের কোনো না কোনো গোষ্ঠীর চরিত্র হননের যে প্রক্রিয়া চলে আসছে, এখন তা শিক্ষকসমাজের ওপর চলমান। শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা তলানিতে ঠেকেছে। পদোন্নতির সীমাবদ্ধতার সঙ্গে প্রায় দশক ধরে পৃথক বেতন কাঠামোর মুলা তাদের সামনে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। অথচ শিক্ষকদের কাছে দেশ ও জাতির প্রত্যাশা আকাশছোঁয়া।
অনেক আগে এক আড্ডায় এক শিক্ষকের স্বপ্ন শুনেছিলাম। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে যেসব কার্যক্রম চলমান, তাতে স্বপ্নের প্রাসঙ্গিকতা বিন্দুমাত্র নষ্ট হয়নি। আমাদের স্বাস্থ্যসেবা যে দীর্ঘ পথপরিক্রমার পর আজকের জায়গায় পৌঁছেছে, ঠিক একই ধারাবাহিকতায় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সেই একই পথে চলেছে। একসময় আমাদের চিকিৎসকরা নিজ বাড়িতে বসেই চিকিৎসা করতেন এবং খুব কঠিন কিছু প্রয়োজন মনে করলে রোগীর বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা করতেন। সেখান থেকে ধীরে ধীরে গঞ্জে একা বসা, তারপর দিন যত পার হয়েছে, তত নতুন নতুন প্রক্রিয়ার উন্নতি ঘটেছে। চেম্বার থেকে নার্সিংহোম এবং সেখান থেকে বেসরকারি হাসপাতাল। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় বাণিজ্য হয়ে পড়েছে সীমাহীন। শিক্ষার ক্ষেত্রেও সেই একই প্রক্রিয়া চলমান। সরকার বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে বিশেষজ্ঞ তৈরি করায় উদ্যোগী। এ উদ্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এখন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিশেষজ্ঞ তৈরি করে সেবার নামে বাণিজ্যের ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে। আমাদের শিক্ষকরা গুরুগৃহ থেকে ধীরে ধীরে কোচিং সেন্টারে এনে তুলেছেন শিক্ষার্থীদের। বাকি আছে বিশেষজ্ঞ হিসেবে সাইন ঝুলিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য অপেক্ষা করা। অভিভাবকরা সিরিয়াল করে নির্দিষ্ট সময়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসবেন বিশেষজ্ঞদের কাছে রচনা লিখতে, জ্যামিতি করতে, আকবরের জীবনী লিখতে, পদার্থবিদ্যার আলো সম্পর্কে জানতে, সরল অংক শিখতে, নদীর ইতিহাস জানতে, ইংরেজি অনুবাদ করতে, ভাবসম্প্রসারণ করতে ইত্যাদি। একেকজন একেক বিষয়ের বিশেষজ্ঞ। অভিজ্ঞতা আর চাহিদা অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের পরিবর্তনশীল ফি দিয়ে শিক্ষার্থীরা এদের কাছ থেকে নিজেদের সমস্যার সমাধান করে নিতে পারবে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে যে পথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তাতে শিক্ষকের স্বপ্নপূরণে বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে না। আর তার আগেই সরকারের বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায় রসায়ন বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা বিশ্ববিদ্যালয়, সমাজবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়, ইতিহাস বিশ্ববিদ্যালয়, হিসাববিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি পেয়ে যেতে পারে দেশের জনগণ। এ অবস্থায় বলতে দ্বিধা নেই, স্বপ্নের পথে উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হিসেবে নতুন করে শিক্ষা আইনকে আবির্ভূত করার প্রয়োজন কী? সংবিধান আছে বলে মানতে হয়, শিক্ষানীতি আছে বলে মানতে হয় এমনটি হলে শিক্ষা আইন করে আবার একটা বেড়ি সৃষ্টির প্রয়োজনই বা কী? বিধিবিধান তৈরি করে নতুনভাবে জনগণকে কথা বলার সুযোগ করে দিতে হবে কেন? শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা প্রতিনিয়ত শিক্ষার উন্নয়নে নতুন নতুনভাবে যে স্বপ্নদর্শন ও বাস্তবায়ন করে চলেছেন বাধাহীনভাবে, তা তো থেমে থাকছে না। আইন না থাকলেই নোট, গাইড, কোচিংয়ের এক শক্ত সিন্ডিকেটের ব্যবসায়িক ক্ষতির কাছে মন্ত্রণালয় যে নতশির হয়ে আছে, তা নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় না!
পরিশেষে বলতে চাই, শিক্ষা সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সূচকই শুধু নয়, প্রতিটি নাগরিকের অধিকার। শিক্ষা আইন শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই শিক্ষা আইন প্রণয়নে কোনো গোঁজামিল নয়। সময়ের প্রয়োজনে যেকোনো বিষয়েরই যৌক্তিক পরিমার্জন করতে হয়। সে ভাবনাকে আমলে নিয়ে সবার অংশগ্রহণে দেশ ও জাতির কল্যাণ বিবেচনায় আলোচনা-পর্যালোচনা করেই শিক্ষা আইন প্রণয়ন করা হোক। গোষ্ঠীস্বার্থ বিসর্জন দিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে করণীয় নির্ধারণ হোক। স্বপ্নে পাওয়া উন্নয়ন বন্ধ হোক।
লেখক : এম আর খায়রুল উমাম, প্রাবন্ধিক; সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি)।