বিজয় : ইতিবৃত্ত ও মর্মার্থ - দৈনিকশিক্ষা

বিজয় : ইতিবৃত্ত ও মর্মার্থ

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

১৯৪৬-এর এপ্রিল মাসে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ লাহোরের উর্দু পত্রিকা ‘চাত্তান’-এর সাংবাদিক সুরেশ কাশ্মীরিকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। ওই সাক্ষাৎকারের একটি পর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, জিন্নাহ বাঙালির ইতিহাস জানেন না; বাঙালিরা বেশিদিন বিদেশি শাসন পছন্দ করে না। কাজেই তারা পাকিস্তানের সঙ্গে একসময় থাকবে না। বাঙালি থাকেনি; ১৯৭১-এ বাঙালি স্বাধীন হয়েছিল। সোমবার (১৬ ডিসেম্বর)কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, তবে ১৯৪৭-এ পাকিস্তানের সঙ্গে জোড় বাঁধা হলেও বাঙালির স্বতন্ত্র ও স্বাধীন হওয়ার প্রক্রিয়া সূচিত হয় ১৯৪৭ থেকেই। সে বছর আগস্ট মাসে পাকিস্তান হয়ে গেলে তখনই কলকাতার বেকার হোস্টেলের ২৪ নম্বর কক্ষে কিছু সতীর্থকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ওই মাউরাদের সাথে বেশিদিন থাকা যাবে না।’ বাঙালি বেশিদিন পাকিস্তানের সঙ্গে থাকেনি; ছিল ২৪ বছর চার মাস তিন দিন। ১৯৫৩-তে শেরেবাংলা বললেন, ‘Leave East Pakistan to work out its own destiny.’ ১৯৫৭-তে মওলানা ভাসানী ন্যাপ গঠন করার সময় পাকিস্তানকে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে বললেন, ‘আসসালামু আলায়কুম।’ ১৯৬১-তে এক গোপন বৈঠকে বঙ্গবন্ধু কমরেড মণি সিংহ এবং কমরেড খোকা রায়কে জানিয়েছিলেন, বাঙালির স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি কোনো আপস করবেন না। ১৯৬৬-তে ছয় দফার সারার্থ নিয়ে ধূম্রজাল তৈরি হলে এক প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু ন্যাপ (মস্কো) নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদকে বলেছিলেন, ‘আরে মিয়া, বুজলা না। দফা তো একটাই, ঘুরাইয়া কইলাম।’ এই দফা যে স্বাধীনতার দফা, তা সেদিন প্রশ্নকর্তা বুঝতে অপারগ হননি। ষাট দশকের সূচনা থেকে গোপনে প্রয়াস চালানো ছাত্রনেতাদের অন্যতম বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন আব্দুুর রাজ্জাক অনুযোগ করেছিলেন, ছয় দফায় কেন স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হলো। বঙ্গবন্ধুর উত্তর ছিল, ‘তোমাদের ওপারে যাওয়ার সাঁঁকো তৈরি করে দিলাম।’ আব্দুর রাজ্জাক এমন উত্তরের নিহিতার্থ বুঝেছিলেন। বিবিসিতে কর্মরত সৈয়দ শামসুল হকের প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য ছিল—‘আমার দফা তিনটা। কত নেছ, কত দেবা, কবে যাবা।’ স্বাধীনতার প্রণোদনা তৈরি হচ্ছিল এভাবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে।

১৯৭০-এর নির্বাচনের প্রাক্কালে পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খান আইনি কাঠামো আদেশ (Legal Framework Order) জারি করে ছয় দফার আলোকে সংবিধান পরিবর্তনের পথ রুদ্ধ করে দিলেন। এমন পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা নির্বাচন নিয়ে হতাশ হয়ে পড়লে বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় বক্তব্য ছিল, ‘নির্বাচন হয়ে গেলে আমি এলএফও টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলব। আমার লক্ষ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা।’

১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় সত্ত্বেও দলটি ক্ষমতা বঞ্চিত হলো; শুরু হলো উত্তাল মার্চ ১৯৭১। ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনা এলো—‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ শুধু স্বাধীনতা নয়, মুক্তির কথাও বলা হলো; স্বাধীনতার আগে ছিল মুক্তির কথা। মুক্তির কথা বলা হয়েছিল তিনবার; স্বাধীনতার কথা একবার। পরোক্ষ ও সাংকেতিক হলেও এই ভাষণই ছিল স্বাধীনতার যথার্থ ঘোষণা। মার্চের ১৬ থেকে ২৪ চলছিল প্রহসনের আলোচনা, যার আড়ালে ইয়াহিয়াচক্র গণহত্যার নীলনকশা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ চূড়ান্ত করেছিল। ২৫শে মার্চ দিবাগত রাত ১টা ১০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হন; তার আগে বাণীবদ্ধ করা স্বাধীনতার সরাসরি ঘোষণায় তিনি বললেন, ‘সম্ভবত এটাই আমার শেষ বার্তা—আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’ এভাবেই মাওলানা আজাদের ভবিষ্যদ্বাণী ফলতে শুরু করল। তিনি শত্রুর শেষ না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে বললেন। শুরু হলো বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন দেশকে শত্রুমুক্ত করার উদ্দেশ্যে।

 দেশকে শত্রুমুক্ত করার প্রক্রিয়া ছিল আট মাস ২১ দিনের মুক্তিযুদ্ধ, যা ছিল বিশ্বের সংক্ষিপ্ততম মুক্তি বা স্বাধীনতাযুদ্ধ। অসম যুদ্ধ (asymmetric war) হিসেবেও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল ব্যতিক্রমী। পেশাদার ও পরিপূর্ণ অস্ত্রসজ্জিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিপরীতে আমাদের মুক্তিযোদ্ধার বেশির ভাগই ছিলেন তৃণমূলের আমজনতা, যাঁরা জীবনে প্রথম অস্ত্র হাতে তুলেছিলেন। কিন্তু এই অসম যুদ্ধে দুর্বলতর পক্ষের বিজয় হয়েছিল, যার নানাবিধ কৌশলগত (strategic) ব্যাখ্যা থাকতে পারে; কিন্তু আমি মনস্তাত্ত্বিক দিকটির ওপর বেশি গুরুত্বারোপ করছি। ইতালীয় যুদ্ধ মনস্তত্ত্ববিদ ফ্রাংকো ফোরনারি (Franco Fornari) বলেন, মা এবং মাতৃসম মাতৃভূমির জন্য মানুষ সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে। এই ত্যাগের মানসিকতা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ছিল; কিন্তু যা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ছিল না। তারা ছিল ভাড়াটে সৈন্যের মতো; আর বাংলাদেশের মাটি তাদের কাছে মাতৃসম মাতৃভূমি হতে পারেনি কখনো। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যয়দীপ্ত মন-মানসিকতার রূপায়ণ করেছিলেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল। ১৯৪০-এর ১৩ মে তিনি কমন্সসভায় বলেছিলেন, ‘Victory at all costs. Victory in spite of all terror, victory however long and hard the road may be; for without victory there is no survival.’ চার্চিল যেন ’৭১-এ আমাদের মনের কথা বলেছেন, তুলে ধরেছেন ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনকে। অন্যদিকে বিজয় গর্বিত মুক্তিযোদ্ধাদের মানসিকতার বর্ণনা আছে ইংল্যান্ড বিজয়ী উইলিয়াম দ্য কনকয়েররের জবানিতে : ‘By the splendour of God I have taken possession of my realm; The earth of England is in my two hands.’ ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের দুই হাতে ছিল বাংলাদেশ।

১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর ছিল বিজয়ের দিন, শত্রুমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের দিন। কিন্তু এই বিজয় ছিল খণ্ডিত, শুধু সামরিক মাত্র; সর্বাত্মক বিজয় মানে যে মুক্তি তা তো তখনো অধরা। সেই কারণে বলি মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছিল ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর; আর মুক্তির যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯৭১-এর ১৭ ডিসেম্বর থেকেই, যা আজও চলমান। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলেও মুক্তির যুদ্ধ চলতে হবে তত দিন, যত দিন না বঙ্গবন্ধুর উক্তি অনুযায়ী (১০ জানুয়ারি ১৯৭২) ‘বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বসবাস করবে, খেয়ে-পরে সুখে থাকবে।’ ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনের সেক্টর ছিল ১১টি; এখন মুক্তির যুদ্ধে সেক্টর অগুনতি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্দিষ্ট সংখ্যা ছিল; এখন মুক্তির যুদ্ধে যোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ছাড়া সারা দেশের সব মানুষ। ১৯৭১-এ শত্রু চিহ্নিত ছিল; এখন শত্রু ঘরে-বাইরে—সবখানে। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ ছিল কঠিন চ্যালেঞ্জ; এখন মুক্তির যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ কঠিনতর। ব্যাষ্টিক-সামষ্টিক পর্যায়ে চ্যালেঞ্জ অনুযায়ী  response হলে না কী মানবিক সৃজন-প্রয়াসের স্ফুর্তি ঘটে, জীবন ও জগৎ সমৃদ্ধ হয়। এমন কথা ইংরেজ ইতিহাসবিদ আর্নল্ড টয়েনবির (Arnold Toynbee), যা তিনি বলেছেন তাঁর Challenge and Response তত্ত্বে।

বাংলাদেশের বাঙালি স্বাধীন, তবে মুক্ত নয়। বিদেশির শৃঙ্খল থেকে স্বাধীন হলেও আমরা এখনো পরাধীন সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, অশিক্ষা-কুশিক্ষা ও বৈষম্যের কাছে। এ দেশে এখনো সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হলো না। সুতরাং ১৯৭১-এর বিজয়কে সম্পূর্ণ করতে হলে এখনো অনেক বিজয়ের প্রয়োজন আছে।

বাঙালি শুধু যে লড়াকু তা নয়, তারা স্বাধীনতাপ্রিয়ও; তা তো মাওলানা আজাদ নির্দেশ করেছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ ফরাসিদের স্বাধীনতাপ্রিয়তা নিয়ে কথা বললেও, বাঙালি নিয়ে এমন কোনো কিছু বলেননি। তাঁর বিবেচনায় স্বাধীনতা ফরাসিদের জাতিগত বৈশিষ্ট্য : ‘সেই স্বাধীনতার ওপর কেউ হাত দিয়েছে তো অমনি সমস্ত জাতি উন্মাদবৎ প্রতিঘাত করবে। কেউ কারো চেপে বসে হুকুম চালাতে পারে না, এটাই ফরাসি চরিত্রের মূলমন্ত্র।’ মনে হয় স্বামী বিবেকানন্দ বাঙালির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও অভিন্ন মন্তব্য করতে পারতেন।

ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন : বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)।

দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0039558410644531