বিজয় দিবসে কিছু অপ্রিয় কথা - দৈনিকশিক্ষা

বিজয় দিবসে কিছু অপ্রিয় কথা

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

আজ ১৬ ডিসেম্বর। বাঙালির মহান বিজয় দিবস। জাতির ইতিহাসে একটি সোনালী দিন। রক্তাক্ত ইতিহাসের স্বর্ণালী অধ্যায়। জাতির সুর্য সন্তানদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় স্মরণ করার দিন। গোটা জাতির সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের বিনম্র শ্রদ্ধা ও লাল সালাম জানিয়ে আজকের লেখাটি শুরু করছি। যারা  মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন কিংবা এ পর্যন্ত পরকালগামী হয়েছেন, তাদের আত্মার চির শান্তি কামনা করি। যারা আজো বেঁচে আছেন, পরম করুণাময়ের কাছে কায়মনো বাক্যে তাদের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু চাই। নিজের জীবন যৌবন হারিয়ে তারা এখন বয়সের ভারে রোগে শোকে কষ্টের জীবন অতিক্রম করছেন। মানব জীবনে বার্ধক্য একটি বড় অভিশাপ। আজ আর আমাদের জীবিত কোন মুক্তিযোদ্ধার বয়স ষাট বছরের কম নয়। দেশের সর্বকনিষ্ঠ যে মুক্তিযোদ্ধাটি বেঁচে আছেন তার বয়স ও ষাট বছরের বেশী। তারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাদের ঋণ পুরো জাতি মিলে কখনো শোধ করা যাবেনা। শোধ করার কোন উপায় নেই। 

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধটি দেখার সৌভাগ্য অনেকের মত আমার ও হয়েছিল। এটি জীবনের সেরা তৃপ্তি। কিন্তু, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার মত বয়স ছিলনা বলে মুক্তিযোদ্ধা হতে পারিনি। সেই কষ্ট সারা জীবন বয়ে বেড়াচ্ছি। মৃত্যুর পরেও হয়ত সেই কষ্ট তাড়া করবে। তবে মনের ভেতর এ নিয়ে দু'টো তৃপ্তি আছে। এক. মুক্তিযোদ্ধাদের মনে প্রাণে ভালবাসতে শিখেছি। সে ভালবাসা অফুরাণ ও অকৃত্রিম। যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন সে ভালবাসা নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। দুই. যেসব রাজাকার ও আলবদর পশ্চিমাদের একান্ত দোসর হয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ বিরোধিতা করেছিল তাদের মনে প্রাণে ঘৃণা করতে শিখেছি। দিন যত যাচ্ছে সে ঘৃণা বেড়ে চলেছে। মরার পরও যেন এভাবে এদের ঘৃণা করতে পারি সে শক্তিটুকু পরম করুণাময়ের কাছে করজোড়ে প্রার্থনা করি। প্রতিটি বিজয় দিবসে এ আমার শ্রেষ্ঠ মোনাজাত।

মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের ৪৭ বছর পর জাতি প্রকৃত অর্থে কতটুকু বিজয়ের স্বাদ গ্রহণ করতে পেরেছে, সে প্রশ্নটি সঙ্গত কারণে সামনে চলে আসে। কত অমুক্তিযোদ্ধা ব্যক্তি ভুঁয়া মুক্তিযোদ্ধা সেজে সরকারি ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা ভোগ করে থাকে। আবার অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন যারা আজ পর্যন্ত সুযোগ সুবিধা দুরে থাক নিজের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতিটুকুও আদায় করতে পারেননি। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আর প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার হিসেবটি কখন, কীভাবে জানা যাবে-সে কথাটি কেউ বলে দিতে পারেনা। আমাদের জীবিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা খুব দ্রুত কমে যাচ্ছে। আর বিশ বছর পর আমরা হয়ত কোন জীবিত মুক্তিযোদ্ধা খুঁজেই পাবনা। মুক্তিযুদ্ধের অনেক ইতিহাস তখন চাপা পড়ে যাবে। বিশেষ করে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশের নারী সমাজের অবদানটি সঠিকভাবে আজ পর্যন্ত ফুটিয়ে তোলা যায়নি। পুরুষ শাসিত সমাজে নারীর অবদান বড় করে দেখার মানসিকতা বরাবরই আমাদের হীন।

আজ থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে সে মানসিকতা যে আরো কত হীনমন্য ছিল সে তো সহজেই অনুমেয়। তাই মুক্তিযুদ্ধকালীন নারীদের গৌরবময় ইতিহাস খুঁজে খুঁজে বের করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধে নারীর ইতিহাস পৃথক করে লিপিবদ্ধ করা প্রয়োজন। কতজন তারামন বিবি ও কাঁকন বিবি আমাদের আছেন সে হিসেব কারো কাছে নেই। তারা কতইনা কষ্টে তাদের জীবন অতিবাহিত করেন। তাদের কতজনের বাড়ি ঘর নেই, কতজনে ভিক্ষে করে খায়, কতজনে রোগে-শোকে জর্জরিত সে খবরটুকুও রাখার গরজ কারো নেই। মুক্তিযুদ্ধের এতগুলো বছর ও মুক্তিযুদ্ধের নানা ইস্যুতে আমরা এখনো দ্বিধা-বিভক্ত। স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে আজো বিতর্কে জড়িয়ে আছি। মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতার মহান ঘোষক কে- সে নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। যিনি পাঠ করেছেন তিনি পাঠক। তিনি ঘোষক হন কিভাবে? ঘোষক আর পাঠকের মধ্যকার পার্থক্যটুকু আজ পর্যন্ত আমরা বুঝে উঠতে না পারলে কে আমাদের বুঝিয়ে দেবে? আমাদের জাতির জনক প্রশ্নে আজও বিভক্তি ও বিতর্ক রয়ে গেছে। দুনিয়ার কোথাও তা নেই, আমাদের প্রতিবেশি ভারত কিংবা পাকিস্তানেও জাতির পিতা নিয়ে কোন বিতর্ক কোনদিন শুনিনি।

পাকিস্তানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আর ভারতে মহাত্মা গান্ধী তাদের অবিসংবাদিত জাতির পিতা। আমাদের এখানে এ বিষয়ে বিসংবাদ কেন? এর একটিমাত্র কারণ আমি খুঁজে পাই। সেটি হলো, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান রাজাকার, আল বদর ও আল শামসদের এদেশের মানুষ হিসেবে সাধারণ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। সেই সাধারণ ক্ষমায় পার পেয়ে গিয়ে এরা নিজেদের খুঁটি শক্ত করে গেড়ে বসে। এদেরই মদদে পরে সপরিবারে নিহত হন বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ পুরুষ শেখ মুজিব। এরপর থেকেই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু হয় রাজাকারদের পুনর্বাসন কার্যক্রম। দুঃখজনক হলেও নির্লজ্জ সত্য এই যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যারাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছে তারাই নিজেদের স্বার্থে রাজাকারদের পুনর্বাসনের কাজটি বেশী গুরুত্ব দিয়ে করেছে। শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে রাজাকার পুনর্বাসনের কাজে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার চরম ধৃষ্টতা দেখানো হয়। সেই থেকে আমাদের স্বাধীনতার ঘোষক ও জাতির জনক ইস্যুতে বাঙালি দ্বিধা-বিভক্ত জাতি। এখানেই তারা থেমে থাকেনি। খোদ জাতীয়তা নিয়ে ও বিতর্ক সৃষ্ঠি করেছে। বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করে দেবার প্রয়াস অব্যাহত আছে। আর তা আমাদের স্বাধীনতা ও বিজয়ের বড় কলংক ছাড়া আর কিছু নয়। দুনিয়ার কোথাও কোন দেশে স্বাধীনতা বিরোধী কিংবা তাদের দোসররা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছে বলে জানা নেই। আমাদের দেশে সে ঘৃণ্য কাজটি একবার নয়, কয়েকবারই হয়েছে।

আরেকটি বিষয় খেয়াল করা কেবল আবশ্যক নয়, অপরিহার্যও বটে। আমাদের স্বাধীনতার স্বাদ ও বিজয়ের সুফল সাধারণ জনগণ অপেক্ষা সমাজের কথিত উঁচু শ্রেণি বেশি ভোগ করে আসছে। কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামে  সাধারণ জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ তাদের চেয়ে বেশী ছিল। আমাদের চারদিকে ভাল করে তাকালে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একেবারে সাধারণ পরিবারের অশিক্ষিত কিংবা অর্ধ-শিক্ষিত লোকেরা যেভাবে মুক্তিযুদ্ধে স্বতঃস্ফুর্ত ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, একটু ধনী, স্বচ্ছল কিংবা কথিত বড় লোকেরা সেভাবে মুক্তিযুদ্ধে আগ্রহ দেখায়নি। আজ কিন্তু বিজয়ের স্বাদ ও স্বাধীনতার সুফল মুলতঃ তাদেরই ঘরে। বিজয় দিবসের শুভক্ষণে এর চেয়ে কষ্টের আর কী আছে? কোথাও কোথাও বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে কোন ক্ষমতাধর রাজাকারকে যখন মঞ্চে প্রধান অতিথি কিংবা বিশেষ অতিথি হিসেবে বসতে দেখি আর হত দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধা লাঠি ভর দিয়ে গিয়ে বেঞ্চে বসে কিংবা ঠায় দাঁড়িয়ে তার বক্তৃতা শুনতে বাধ্য হয় তখন স্বাধীনতা ও বিজয় কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়- সে ভাবনায় পড়ে যাই। এসব যতদিন দূর করা না যাবে ততদিন স্বাধীনতা ও বিজয় দু'টোই অর্থহী ন হয়ে থাকবে। কেবল বিজয় দিবস উদযাপন যথার্থ কোন কাজ নয়।
 

লেখক: অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট ও দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।

মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি - dainik shiksha মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! - dainik shiksha খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ - dainik shiksha এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে - dainik shiksha মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা - dainik shiksha মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! - dainik shiksha মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.00394606590271