আমি গত ২৯.০৫.২০১৯ তারিখে প্রকাশিত ‘আমাদের দুর্বল মেরুদণ্ড এবং বিদেশি শিক্ষক’ শীর্ষক লেখায় উল্লেখ করেছিলাম, বিদেশ থেকে শিক্ষক এনে ভালো শিক্ষকের অভাব পূরণের ইচ্ছা একটি মহতী উদ্যোগ। এ নিয়ে শুধু লেখালেখিই নয়, জাতীয় সংসদেও হয়েছে ব্যাপক আলোচনা।
তবে মানুষের মনে এখনও রয়েছে অনেক প্রশ্ন- ১. কেন হঠাৎ মনে হল, দেশে ভালো শিক্ষকের অভাব? ২. দেশে কি সত্যিকার অর্থেই শিক্ষক হওয়ার মতো লোকের অভাব? ৩. আমরা এতদিন কাদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছি? ৪. বিদেশি শিক্ষক এনে কাদের পড়ানো বা শিখানো হবে? ৫. ভালো বিদেশি শিক্ষক কেন আসবে এবং কারা এদের নিয়োগ দিবে? ৬. কতদিন আমরা এই অষ্টাদশ শতাব্দীর মতো অবস্থায় থাকব? বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধনটি লিখেছেন ড. এম এল আর সরকার।
কেন হঠাৎ মনে হল, দেশে ভালো শিক্ষকের অভাব
সুশিক্ষিত জাতি তৈরির জন্য প্রয়োজন দক্ষ শিক্ষক। ভালো শিক্ষকের কোনো বিকল্প নেই। দেশে ভালো শিক্ষকের যে অভাব রয়েছে, তা সবাই জানে। জানত না শুধু সরকার ও নীতিনির্ধারকরা।
যদি জানত, তাহলে কি স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর পর অষ্টাদশ শতাব্দীর উদাহরণ টেনে বিদেশ থেকে শিক্ষক আনার চিন্তা করতে হতো? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুর সেই উক্তি ‘সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই’ কথা কি আপনার মনে আছে? তিনি কি সোনার মানুষ পেয়েছিলেন? না, তিনি পাননি!
কিছু অমানুষের জন্য আমাদের স্বাধীনতার স্থপতি ভালো মানুষ তৈরির সময় পাননি। তার অকাল মৃত্যুর পর দেশে যা কিছু হয়েছে, তা হচ্ছে ক্ষমতার রাজনীতির পালাবদল মাত্র। প্রায় সব সরকারই চেষ্টা করেছে, কী করে ক্ষমতায় থাকা যায়। ফ
লে সবাই তোষণ করেছে ক্ষমতাবানদের। কিন্তু কী করলে এবং কীভাবে একটি সুশিক্ষিত জাতি গড়ে উঠবে, সে চিন্তা তারা করেনি বা করার সময় পায়নি; যা করেছে তা হচ্ছে, শুধু লোক দেখানো একটি প্রয়াস।
প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ যে, তিনি দেরিতে হলেও সমস্যাটি বুঝেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, হুট করে কেন এমন সিদ্ধান্ত? শিক্ষা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এটি কোনো রাস্তা, ব্রিজ কিংবা স্কুলঘর নির্মাণের ঘোষণার মতো বিষয় নয়। সমস্যা কোথায়, কেন এই সমস্যা হল, কী করলে এর সমাধান হবে- এসব জানার জন্য দেশের শিক্ষাবিদদের সঙ্গে খোলামনে আলোচনা করা অতীব জরুরি।
সাধারণ শিক্ষকদের কথা বাদই দিলাম; দেশে এখনও কিছু ভালো শিক্ষক আছেন, যারা দেশের ও আপনার ভালোই চায়। তাদের সঙ্গে বিস্তারিত পর্যালোচনা করার পরই যদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিতেন, তাহলেই সম্ভবত জাতি উপকৃত হতো এবং প্রকৃতপক্ষে কী হতে যাচ্ছে, তা সবাই বুঝতে পারত।
দেশে কি সত্যিকার অর্থেই শিক্ষক হওয়ার মতো লোকের অভাব আছে?
এটি অনস্বীকার্য যে, দেশে দক্ষ শিক্ষকের অভাব রয়েছে। কিন্তু শিক্ষক হওয়ার মতো যোগ্য লোকের অভাব রয়েছে, এ কথা মেনে নেয়া হবে সত্যের অপলাপ মাত্র। সত্যিই যদি যোগ্য লোকের অভাব থাকে, তাহলে গত বিসিএস পরীক্ষায় প্রায় ৪ লাখ শিক্ষিত বেকার আবেদন করল কীভাবে!
প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে, দেশে অনেক যোগ্য লোক আছে। এ লোকগুলো দিনের পর দিন ভালো চাকরির আশায় বেকার অবস্থায় দিন যাপন করছে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হল, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এই যোগ্য লোকগুলো পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে (বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছাড়া) বেছে নিচ্ছেন না। প্রাইমারি বা হাইস্কুলের কথা বাদই দিলাম। বর্তমানে অবস্থা এমন যে, যোগ্য ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায়ও আসতে চাচ্ছেন না।
কিছুদিন আগেই দেখলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাইক্রোবায়োলজিতে সম্ভবত প্রথম স্থান অধিকারী একজন ছাত্র বিসিএস পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে এবং এখন সম্ভবত চাকরিও করছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মাইক্রোবায়োলজির অত্যন্ত ভালো একজন ছাত্র প্রশাসনিক কাজে আসছে কেন? শুধু তাই না; অনেক ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এবং কৃষিবিদও এই কাজ করে নিজের পেশা ছেড়ে দিচ্ছে। কিন্তু কেন? কারণ হচ্ছে, শিক্ষকতা পেশার প্রত্যেকটি স্তরে জড়িত লোকেরা নানাভাবে বঞ্চিত।
সরকারের অন্য সেক্টরে নিয়োজিতদের তুলনায় শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা এবং মর্যাদার তফাৎ আকাশ-পাতাল। এককথায়, শিক্ষকতাকে মুখে বলা হয় মহতী; কিন্তু অবস্থা করা হয়েছে খয়রাতি। এ নিয়ে লেখালেখি হয়েছে অনেক। কিন্তু ফলাফল শূন্য!
আমরা এতদিন কাদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছি?
আমাদের বিভিন্ন স্তরের নিয়োজিত শিক্ষকদের যোগ্যতা নিয়ে লেখা খুবই জটিল। আমি পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষ। আজ থেকে ৩৫-৪৭ বছর আগে দেখেছি, আমার শ্রদ্ধেয় প্রাইমারি, হাইস্কুল এবং কলেজে শিক্ষকদের। তারা ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ এবং তাদের ধ্যান-জ্ঞানই ছিল ছাত্রদের মঙ্গল চিন্তা।
সেই সময় বিএসসি পাস করা ছিল কঠিন এবং এমএসসি পাস করা ছিল একটি অভাবনীয় ব্যাপার। হাইস্কুলগুলোয় বিএসসি পাস শিক্ষকের কদর ছিল খুবই বেশি।
কিন্তু সেই দিন আর নেই। আমার হাইস্কুল জীবন শেষ হওয়ার আগেই দেখলাম শুরু হল এসএসসি, এইচএসসি এবং ডিগ্রি পর্যায়ে নকলের মহোৎসব। বেশকিছু আগে এই নকল উৎসব বন্ধ হওয়ার পর শুরু হয়েছে বাছ-বিচারহীন নম্বর দেয়ার পালা।
এর সঙ্গে যুক্ত হল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ডিগ্রি দেয়ার প্রতিযোগিতা। ফলাফল অসংখ্য ডিগ্রিধারী; যাদের চাকরি পাওয়ার শেষ ভরসা হচ্ছে মূলত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
কিছুদিন আগে পর্যন্তও দেশের অধিকাংশ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে মূলত ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে। এখনও অবস্থা একই, তবে নিয়োগ পরীক্ষায় পাস করতে হচ্ছে মাত্র। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অনেককে আজও ঘুষ দিয়েই শিক্ষক হতে হচ্ছে/হয়েছে।
হাতেগোনা কয়েকটি সরকারি হাইস্কুল এবং কলেজ বেশকিছু দিন পর্যন্ত ভালোভাবেই টিকে ছিল। কিন্তু সরকারিকরণসহ নানা কারণে, বিশেষ করে সমাজের অন্যের দেখাদেখি অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধার লোভে ‘সঙ্গদোষে লোহা ভাসার মতো’ ভালো শিক্ষকরাও গা ছেড়ে দিয়েছে।
বর্তমানে অবস্থা এমন যে, ভালোর সঙ্গে মন্দ মেশাতে মেশাতে আস্তে আস্তে ভালো-মন্দ সব একাকার হয়ে গেছে।
প্রাইমারি স্কুলের কথা বাদই দিলাম। কিন্তু হাইস্কুল এবং কলেজে ইংরেজি, অঙ্ক, রসায়ন, পদার্থ আইটিসহ অনেক বিষয় পড়ানোর মতো ভালো শিক্ষকের যে কী অভাব, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। বাবা-মায়েরা সত্যিই অসহায়।
শহরের শিক্ষার্থীদের ভরসা হচ্ছে কোচিং সেন্টার। কিন্তু গ্রামের শিক্ষার্থীদের কোনো উপায় নেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা হচ্ছে আরও শোচনীয়। অনার্স এবং মাস্টার্স পড়ানোর মতো ভালো শিক্ষকের কথা বাদই দিলাম; এখানে না আছে পর্যাপ্ত শিক্ষক, না আছে ক্লাসরুম। আছে শুধু ছাত্র আর ছাত্র এবং টাকা আয়ের জন্য ফি আর ফি।
বিদেশি শিক্ষক এনে কাদের পড়ানো বা শিখানো হবে?
হ্যাঁ, বিদেশ থেকে ভালো শিক্ষক আসবে; ভালো কথা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষকরা এসে কাদের পড়াবে? আমাদের ভালো শিক্ষকের বেশি প্রয়োজন হচ্ছে প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক স্তরে। এ তিনটি স্তরে, বিশেষ করে মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক স্তরেই শিক্ষার্থীদের ভিত শক্ত করে গড়ে ওঠা প্রয়োজন।
কিন্তু আমাদের এই ভিত তৈরির কারখানা ও কারিগররা অত্যন্ত দুর্বল। ফলে তৈরি হচ্ছে দুর্বল ভিত, যা সরবরাহ করা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। এ দুর্বল ভিতের ওপরই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তৈরি করতে হচ্ছে জাতির শক্তিশালী মেরুদণ্ড।
কথা হচ্ছে, সরকার কি আসলেই বিদেশি শিক্ষক এনে মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক স্তরের ভালো শিক্ষককের অভাব পূরণ করতে চায়? আমাদের দেশে শুধু হাইস্কুল আছে প্রায় ২৫ হাজার। ধরি, ৫ হাজার স্কুলে ভালো শিক্ষক আছে এবং বাকি ২০ হাজার স্কুলের জন্য ভালো শিক্ষক প্রয়োজন।
একবার ভাবুন তো, সরকারের কি এত বিশাল বরাদ্দ আছে? ধরলাম, ২০ হাজার শিক্ষক এনে প্রত্যেক মাধ্যমিক স্কুলে একজন করে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হল। আসলেই কি এতে কোনো উন্নতি হবে? যদি হয়, তবে এই যে প্রায় ২৬ হাজার বেসরকারি বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করা হচ্ছে, সেগুলোয় ভালো শিক্ষকের কী ব্যবস্থা হবে?
তবে অনেকের ধারণা, সম্ভবত সরকার বিশ্বব্যাংকের শর্তের কারণে বিদেশি শিক্ষক নিয়োগ দিতে চাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। বিশ্বব্যাংক ইতিমধ্যে Higher Education Quality Enhancement Project (HEQEP)-এর মাধ্যমে ঋণ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো এবং একাডেমিক কারিকুলাম উন্নয়নে।
বুঝতেই পারছেন, বিশ্বব্যাংক সুদের পাশাপাশি তাদের কিছু লোক নিয়োগের মাধ্যমে লাভের ব্যবস্থাটাও পাকাপোক্ত করতে চায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষক দেয়ার প্রচেষ্টা অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু কারও নির্দেশনায় ঋণের টাকায় এ রকম নিয়োগ কোনোভাবেই কাম্য নয়।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ভালো শিক্ষক আছেন এবং শিক্ষক হওয়ার মতো অনেক মেধাবী ছাত্রছাত্রীও আছে। তবে শিক্ষক নির্বাচন পদ্ধতিতে আছে ত্রুটি (আশা করছি এ নিয়ে খুব দ্রুতই লিখব)।
ভালো বিদেশি শিক্ষক কেন আসবে এবং কারা তাদের নিয়োগ দেবে?
আমরা চাই ভালো বিদেশি শিক্ষক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেন একজন ভালো শিক্ষক তার কর্মক্ষেত্র, আত্মীয়স্বজন এবং দেশের মায়া ত্যাগ করে এ দেশে আসবে? যদি আসে, আমরা কি তাদেরও আমাদের স্কুল বা কলেজের শিক্ষকের মতো বেতন দেব?
নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক এনে তাকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো বেতন দেব? যদি তাদের বেশি বেতন দিই, তা হলে কেন আমাদের শিক্ষকরা একই কাজ করে কম বেতন নেবে?
আমাদেরও অনেক ভালো শিক্ষক আছেন এবং অনেক শিক্ষক বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ বেতনে চাকরি করে দেশে এসেছেন। যদি তারা দেখেন, তাদেরই এক বিদেশি বন্ধু এ দেশে এসে তিনগুণ বেশি বেতন পাচ্ছে, সেটি কি তাদের জন্য খুব সুখকর হবে?
অধিকন্তু বিদেশি শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়েও রয়েছে অনেক প্রশ্ন। কে সম্পন্ন করবে এই নিয়োগ? কে নির্ধারণ করবে বিদেশি শিক্ষকদের যোগ্যতা? আমরা কি এশিয়া, নাকি ইউরোপ, নাকি অস্ট্রেলিয়া, নাকি উত্তর আমেরিকা বা কানাডা থেকে শিক্ষক আনব?
আমরা কি নামকরা (বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং ৫০০-এর ভেতর) বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা শিক্ষক, তাদের নিয়োগ দেব; নাকি এসব দেশের যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রিধারী (বর্তমানে বেকার) হলেই তাদের নিয়োগ দেব?
অনেকেই হয়তো ভাবছেন, কেন এত প্রশ্ন? আমি মনে করি, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার বেহাল দশার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা। এমন কোনো অনিয়ম নেই, যা আমরা করিনি বা করার চেষ্টা করিনি। ভয় হচ্ছে, কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে এখন আবার অদক্ষ বিদেশি শিক্ষক নিয়োগ দিতে যাচ্ছি কিনা!
কতদিন আমরা এই অষ্টাদশ শতাব্দীর মতো অবস্থায় থাকব?
আমরা অষ্টাদশ শতাব্দীতে নেই। আমরা বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুনামের সঙ্গে কাজ করছি। এ যুগে কোনোভাবেই কেউ এসে আমাদের শিক্ষিত করবে না। আমাদের উন্নতি আমাদেরই করতে হবে।
হ্যাঁ, আর্থিক সঙ্গতি ও পরিকল্পনা থাকলে আমরা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে নানারকম সহযোগিতামূলক সম্পর্ক স্থাপন এবং ভিজিটিং স্কলার আনতে পারি। নিঃসন্দেহে এ ধরনের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক আমাদের শিক্ষকদের মান আরও উন্নত করবে।
কিন্তু হঠাৎ করে কিছু বিদেশি শিক্ষক নিয়ে এসে ভালো শিক্ষকের অভাব পূরণের চেষ্টা কাকের পুচ্ছে ময়ূরের পেখম লাগিয়ে ঋণের অর্থের অপচয় ছাড়া কিছুই হবে না।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমস্যার (রাজনীতি এবং নিয়োগ দুর্নীতি) সমাধান সহজেই সম্ভব। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাইরে কিছু এলিট এবং কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া শিক্ষার অবস্থা খুবই শোচনীয়।
আমি বা আমার মতো বিত্তবানদের কথা বাদ দিন। সাধারণ মানুষের শত শত নয়, হাজার হাজার নয়, লাখ লাখ সন্তান উপযুক্ত শিক্ষা পাচ্ছে না ভালো শিক্ষকের অভাবে। সত্যিই আপনি আগামীকাল থেকে শিক্ষার জন্য যদি কিছু করতে চান, তবে সর্বাগ্রে হাজার হাজার বেসরকারি হাইস্কুল এবং কলেজে উপযুক্ত সম্মান এবং সম্মানীতে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে (শুধু নিয়োগ পরীক্ষায় পাস না) ভালো শিক্ষক নিয়োগের জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করুন।
উচ্চশিক্ষার নামে লাখ লাখ মাকাল ফল তৈরির কারখানার (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) শোষণ বন্ধ অথবা নিয়ন্ত্রণ করে সরকারিভাবে কারিগরি শিক্ষা প্রসারের দ্রুত ব্যবস্থা নিন।
আমাদের জনসম্পদ জনদুর্ভোগে পরিণত হয়েছে। প্রয়োজন বঙ্গবন্ধুর সোনার মানুষ। কিন্তু আমরা ভুলে গেছি, সোনার মানুষ তৈরির জন্য প্রয়োজন সোনার কারিগর। আমরা ১০ হাজার টাকা বেতন স্কেলে (যারা কোনোদিন প্রথম গ্রেডে যেতে পারবে না) প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে তাদের বলছি ভালোভাবে পড়ান।
অবশ্যই তারা পড়াবে এবং আঙুলের ছাপ দিয়ে স্কুলে উপস্থিতি দেবে, তবে কাজ হবে না। প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষকদের যদি সামাজিক ও আর্থিক মর্যাদা না থাকে এবং সমাজে তাদের যদি মাথা নিচু করে থাকতে হয়; তবে ভালো শিক্ষক কি পাওয়া যাবে?
এই শিক্ষকরা কেন এবং কীভাবে আমাদের সন্তানদের মর্যাদাবান বিচারক, কর্মকর্তা (সেনা, পুলিশ ও প্রশাসন), চিকিৎসক এবং প্রকৌশলী হওয়ার মতো যোগ্য করে গড়ে তুলবে? দুঃখজনক হচ্ছে, এই বঞ্চিত শিক্ষকদের হাতে তৈরি মর্যাদাবান নীতিনির্ধারকরাই শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বার্থ বিঘ্নিত করেন বা করছেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বিদেশি শিক্ষকদের যেসব সুবিধা দেবেন, সেই সুবিধাদিসহ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিন। ভালো শিক্ষক দেশেই পেয়ে যাবেন।
লেখক: ড. এমএলআর সরকার : অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়