বিশুদ্ধ ইতিহাসের উপস্থাপক যতীন সরকার - Dainikshiksha

বিশুদ্ধ ইতিহাসের উপস্থাপক যতীন সরকার

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

‘জীবন ও স্মৃতিনির্ভর, আত্মজীবনীমূলক রচনার’ বিশিষ্টতা হলো, এটা একাধিক প্রেক্ষণবিন্দুঘিরে আবর্তিত হয়; এজাতীয় রচনায় ব্যক্তি-জীবনচিত্র এবং ইতিহাস পাশাপাশি থাকে, থাকে সাহিত্য-ব্যঞ্জনার অনুরণন, ‘সমাজ ও শ্রেণিচরিত্রের স্বরূপ’ এবং ব্যক্তি মনস্তত্ত্বের বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণও। বস্তুত এ রকম রত্নগর্ভা গ্রন্থ বাংলা সাহিত্যে বিরলপ্রায়। সেই বিরল ধারারই ব্যতিক্রমধর্মী, অনবদ্য দুটি গ্রন্থ অধ্যাপক যতীন সরকারের লেখা ‘পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন’ এবং ‘পাকিস্তানের ভূত দর্শন’। এই দুই গ্রন্থে যতীন সরকার শুধু যেন লেখক নন, তিনি ত্রিকালদর্শী নিরাবেগ ঋষি, ব্রিটিশশাসিত পূর্ববঙ্গ, পাকিস্তানশাসিত পূর্ব বাংলা এবং স্বাধীন বাংলাদেশ—এই তিন পর্যায়ের, তিন কালের মহাসাক্ষী হিসেবে ইতিহাস বর্ণনায় প্রবৃত্ত হয়েছেন। যতীন সরকারের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৮ আগস্ট নেত্রকোনা জেলার চন্দপাড়া গ্রামে। রোববার (১৮ আগস্ট) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন বিধান মিত্র।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় তাঁর বয়স ছিল ১১ বছর মাত্র। এ বয়সের কোনো বালকের পক্ষে রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচ অনুভব করতে পারা—বিষয়টা কঠিন বৈকি। কিন্তু যতীন সরকার তাঁর নিজেরই অভিমত, তিনি ছিলেন ‘অকালপক্ব’ এবং বাচাল—তাই নিতান্ত শিশু বয়সেই তিনি দার্শনিক (দর্শন করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত মানুষ) হয়ে উঠেছিলেন। কলকাতা থেকে প্রকাশিত অর্ধসাপ্তাহিক আনন্দবাজার, সাপ্তাহিক মোহাম্মদী, দৈনিক যুগান্তর, সাপ্তাহিক দেশ ইত্যাদি পত্রিকার নিয়মিত পাঠক ছিলেন তিনি এবং ওই সব পত্রিকা পড়েই সমকালীন রাজনীতির গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছিলেন।

১৯৫৪ সালের নির্বাচন, আইয়ুবের সামরিক শাসন, পাক-ভারত যুদ্ধ, ছয় দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং নির্বাচনোত্তর উত্তাল-উন্মাতাল দিনের চিত্র, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, লাখ লাখ প্রাণ বিসর্জনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির মহত্তম অর্জন—‘স্বাধীনতা লাভ’ ইতিহাসের এই করুণ বা অরুণরাঙ্গা প্রতিটি ঘটনা নিতান্ত নিরাসক্ত এবং নিরাবেগ দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করেছেন যতীন সরকার। ‘পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন’ গ্রন্থে তিনি নিরপেক্ষ নির্ভারচিত্তের কথক মাত্র, বিশুদ্ধ ‘ইতিহাসের’ উপস্থাপক মাত্র। তাঁর বর্ণিত ইতিহাস—সেটা ঘটে যাওয়া ঘটনার সত্য ও বাস্তব চিত্র মাত্র। তাই তাঁর বর্ণনায় এমন অনেক অজানা তথ্য, অনেক ‘চেপে যাওয়া’ ঘটনার বিবরণ পাই, যা আমাদের প্রথাগত ইতিহাস গ্রন্থে খুঁজে পাওয়া যায় না। বস্তুত যতীন সরকারের ‘পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন’, এটা যেন এক ধরনের ঐতিহাসিক মহাকাব্য। এই গ্রন্থের লক্ষণীয় বিশেষত্ব হলো, আমাদের সব ইতিহাস যেখানে ‘নাগরিক চোখ ও বোধ’ দ্বারা পর্যালোচিত হয়েছে, সেখানে যতীন সরকার প্রান্তিক শ্রেণিগোষ্ঠী, বিশেষত কৃষক মনস্তত্ত্বের আলোকে ইতিহাস উপস্থাপন করেছেন। সে ইতিহাসে হিন্দু-মুসলমানের ভ্রাতৃবন্ধনের চিত্র যেমন আছে, তেমনি আছে তাদের সংঘাতপর্বের কথাও। একাত্তরের যুদ্ধপর্বে, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান—আমরা সবাই অভিন্ন পতাকাতলে সমবেত হয়েছিলাম।

যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা দেশকে ‘স্থিতিশীল’ অবস্থায় নিয়ে আসার জন্য ‘সময় এবং ধৈর্য’—এই দুইয়ের প্রয়োজন ছিল খুব। কিন্তু সদ্য স্বাধীন দেশের জনগণ এত কিছু বুঝতে নারাজ; তাদের মনে হাজারো প্রশ্ন, স্বাধীন দেশে জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটল কই? খাদ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা কই? দেশের সব কিছু—কতিপয় লোকই লুটেপুটে খাবে? এরই মধ্যে এলো চুয়াত্তরের সর্বপ্লাবী বন্যা এবং তজ্জনিত ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ; দেশের অস্থিতিশীল অবস্থাকে কেন্দ্র করে দুর্জনেরা তখন মুখরোচক কল্পকাহিনি তৈরি করতে লাগল। স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের সঙ্গে উঠতি যুবকদের একাংশ আঁতাত গড়ে তুলল এবং তাতে সর্বাত্মক সহযোগিতা জোগাল কতিপয় বিদেশি রাষ্ট্র। এ পর্বে দেশি-বিদেশি শক্তির যোগসাজশে ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক ও কলঙ্কিত ঘটনাটি ঘটানো হলো। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হলো। তখনকার সমাজ ও রাজনীতির কদর্য চিত্র বিশিষ্ট কবি নির্মলেন্দু গুণের উদ্ধৃতি সহযোগে উপস্থাপন করেছেন যতীন সরকার, “আমাদের গ্রামের মুসলেম উদ্দিন নামক একজন সরকারি কর্মচারী মেজর ডালিমের কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু হত্যার সংবাদটি রেডিওতে প্রচারিত হতে শুনে আনন্দে এমনই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন যে তিনি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের সড়ক ধরে তিনি খালি গায়ে, মাথায় গামছা বেঁধে দৌড়াতে শুরু করেন এবং চিৎকার করে বলতে থাকেন, ভাইসব, আর চিন্তা নাই, ‘হিন্দুর বাপ’ শেখ মুজিবর শেষ। আপনেরা সব বাইরইয়া আসেন।” বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু মানে ‘হিন্দুর বাপ’-এর মৃত্যু—কতিপয় মানুষের মধ্যে এ রকম বোধের সঞ্চার। এর মধ্যে যতীন সরকার দেখতে পেয়েছেন ‘পাকিস্তানের ভূত’ ফিরে আসার প্রতীকী চিত্র। এর পরবর্তী কয়েক বছরের ইতিহাস সত্যি সত্যি ভূতের মতো পেছনে চলার ইতিহাস। যতীন সরকারের বর্ণনায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম-মৃত্যু এবং এর ‘ভূত’ হয়ে ফিরে আসার ঘটনাবহুল ইতিহাসটুকু পড়লে বাঙালি জাতির চরিত্র ও প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের বোধে নতুন ধারণার জন্ম হবে বৈকি।

 

লেখক : গবেষক

প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0070312023162842