বিশেষ কায়দায় হত্যা করতে হবে, যেন আত্মহত্যা বলে চালানো যায় - Dainikshiksha

জবানবন্দি (১) সিরাজ-উদ-দৌলাবিশেষ কায়দায় হত্যা করতে হবে, যেন আত্মহত্যা বলে চালানো যায়

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

নুসরাত জাহান রাফি এক প্রতিবাদী সত্তার নাম। আগুনে পুড়িয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ফেনীর এই মাদরাসাছাত্রীকে। এটি সাধারণ কোনো হত্যা নয়। ১২ আসামির জবানবন্দিতে বেরিয়ে এসেছে লোমহর্ষক নানা তথ্য। সেই সব নিয়েই শুরু হলো ধারাবাহিক আয়োজন-

'নুসরাত জাহান রাফিকে হত্যার হুকুম দিয়ে ভুল করেছি। এভাবে হুকুম দেওয়া ঠিক হয়নি। আমি অনুতপ্ত। সত্য জবানবন্দি দিলাম।' ফেনীর সোনাগাজীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাত হত্যা মামলায় আদালতে ১৬৪ ধারা ও পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দির এভাবেই উপসংহার টানেন অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা। সোমবার (১৭ জুন) সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন সাহাদাত হোসেন পরশ।

এ মামলায় দায়ের করা চার্জশিটে তিনি এক নম্বর আসামি। জেলখানায় বসেই ওই হত্যার পরিকল্পনা থেকে শুরু থেকে যেভাবে অনুসারীদের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করিয়েছেন, তা ছিল লোমহর্ষক। অধ্যক্ষের মতো মর্যাদাপূর্ণ একটি আসনে বসে তার প্রতিষ্ঠানের এক ছাত্রীকে পুড়িয়ে হত্যা করে আত্মহত্যার যে নীলনকশা সিরাজ করেছিলেন, জাতির বিবেককে নাড়া দিয়েছে তা। নুসরাতকে টার্গেট করার কারণ হিসেবে অধ্যক্ষ সিরাজ বলেন, 'নুসরাত আমাদের সম্মিলিত স্বার্থের সামনে এসে গিয়েছিল। তাই হত্যার এই ছক।'

দেশব্যাপী চাঞ্চল্য তৈরি করা নুসরাত হত্যা মামলায় অধ্যক্ষ সিরাজের জবানবন্দির হুবহু কপি সংগ্রহ করেছে। তা বিশ্নেষণ করলে দেখা যায়- সোনাগাজীর ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসা ঘিরে নোংরা রাজনীতির খেলা চলে আসছিল দীর্ঘদিন। মাদরাসার প্রভাববলয়ের কেন্দ্রে থাকতে মরিয়া ছিলেন অধ্যক্ষ। নিজের গদি ঠিক রাখতে তাই স্থানীয় ক্ষমতাসীন নেতা, প্রভাবশালী ব্যক্তি, থানা ও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের লোকজনের সঙ্গে অনৈতিক সখ্য গড়ে তোলেন তিনি। 

সিরাজের হৃদয় ছিল পাথরের মতো কঠিন। হত্যার নির্দেশ দিয়ে কারাগারের চার দেয়ালের ভেতরে বসে এক সহযোগীকে বলেছিলেন, 'নুসরাত ও তার পরিবারকে ভালোভাবে চাপ দিতে হবে। যদি এতে কাজ না হয়, তাহলে পরিকল্পনা করে হত্যা করতে হবে তাকে। বিশেষ কায়দায় করতে হবে তা, যেন আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। যদি তারা ভালো মনে করে, প্রয়োজনে পুড়িয়ে হত্যা করতে হবে। এ বিষয়ে সোনাগাজী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন ও কাউন্সিলর মাকসুদ তাদের যে কোনো সহায়তা করবেন। টাকা-পয়সা প্রয়োজন হলে তাদের মাধ্যমে পাওয়া যাবে। থানা ও প্রশাসন ম্যানেজ করবেন রুহুল আমিন ও মাকসুদ।' এমন ঘৃণ্য ও বর্বরোচিত হত্যা মিশনের পরিকল্পনা বাতলে দিতে এতটুকু কুণ্ঠাবোধ হয়নি সিরাজের। 

নুসরাত হত্যা মামলায় সিরাজসহ ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেছে মামলার তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তাদের সবার মৃত্যুদণ্ড চেয়েছে তারা। আসামিদের মধ্যে ১২ জন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন আদালতে। আর সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন সাতজন। সকলের জবানবন্দির হুবহু তথ্য সংগ্রহ করেছে। সেখানে কারা কীভাবে নৃশংস এ ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জালের মতো ভূমিকা রেখেছেন, আদ্যোপান্ত রয়েছে তার।

সিরাজ-উদ-দৌলা তার জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন- ২০০১ সালে মাদরাসার অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন তিনি। দীর্ঘ ১৯ বছর মাদরাসায় দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। মাদরাসায় প্রভাব বিস্তার করতে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তার প্রভাববলয়ের লোক তৈরি করা হয়। তাদের নিয়ে  মাদরাসায় যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া ও তা বাস্তবায়ন করতেন। এভাবে স্থানীয় প্রভাব বাড়ে তার।

মাদরাসার ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণ করতে কিছু ছাত্রের সঙ্গেও গভীর সম্পর্ক তৈরি করেন তিনি। তাদের মধ্যে ছিলেন ছাত্রলীগের সভাপতি শাহাদাত হোসেন শামীম, ছাত্রদলের সভাপতি নূর উদ্দিন, হাফেজ আব্দুল কাদের, জাবেদ, জুবায়ের, এমরান, রানা ও শরিফ। বিভিন্ন সময় তাদের সহযোগিতা করতেন অধ্যক্ষ সিরাজ। পরীক্ষার ফি ও বেতন মওকুফ করে দেওয়া হতো তাদের। এমনকি পরীক্ষায় বিশেষ সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি ওদের পছন্দ অনুযায়ী ছাত্রছাত্রীও ভর্তি করা হতো। এসব থেকে কমিশন পেতেন তারা। 

নুসরাতের ঘটনার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে সিরাজ বলেছিলেন- ২৭ মার্চ সকালে মাদরাসার পিয়ন নুরুল আমিনের মাধ্যমে নুসরাতকে তার কক্ষে ডেকে আনা হয়। খবর পেয়ে নুসরাতের সঙ্গে আরও তিনজন ছাত্রী কক্ষের সামনে যান। সিরাজের কাছে তথ্য ছিল- নুসরাত অন্য ছেলের সঙ্গে 'সম্পর্ক' চালিয়ে যাচ্ছেন। এ জন্য সম্পর্ক ছিন্নের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে হবে তাকে।

ডেকে আনার পর শুধু নুসরাতকে কক্ষে ঢুকতে দেওয়া হয়। অন্য তিন ছাত্রী কক্ষের বাইরে ছিলেন। ওই পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে সিরাজ বলেন, 'কক্ষে কিছু কথা হওয়ার পর নুসরাত পড়ে যায়। এরপর আমি পেছন থেকে তার কোমরে দুই হাত দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করি তাকে। সে বসে থাকে। তারপর নুরুল আমিনকে ডাকি। পরে নুসরাত তার বান্ধবীদের সঙ্গে চলে যায়।' 

নুসরাতের পরিবার ঘটনা জানার পর কী প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় সেটা জানিয়ে জবানবন্দিতে সিরাজ জানান, ২৭ মার্চ দুপুরে নুসরাতের মা, ছোট ভাই, কমিশনার মাদরাসায় আসেন। এরপর সিরাজকে মারার চেষ্টা করেন নুসরাতের মা। একপর্যায়ে সিরাজও তাদের হুমকি দেন। সেখানে নূর উদ্দিনও উপস্থিত ছিলেন। পরে শাহাদাত হোসেন শামীমও আসেন। অবস্থা বেগতিক দেখে সোনাগাজীর আওয়ামী লীগ সভাপতি রুহুল আমিনকে ফোন করেন সিরাজ। রুহুল আমিন থানা থেকে এসআই ইকবালকে পাঠান। ইকবাল নুসরাতকে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এরপর সিরাজকে থানায় নিয়ে যান। সেখানে মামলা রেকর্ড করেন। সেই মামলায় গ্রেফতার হন তিনি। 

হত্যা মিশনে অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে নিজের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা জানিয়ে অধ্যক্ষ জবানবন্দিতে বলেন, শামীম ও নূর উদ্দিন তার খুব ঘনিষ্ঠ ছাত্র ছিল। তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আলাপ হতো তার। মাদরাসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ-সংক্রান্ত কোনো বিষয় বললে তারা তা করতেন। পরীক্ষার সময় ছাত্রছাত্রী ভর্তি থেকে শুরু করে পরীক্ষা রেজিস্ট্রেশন, ফরম পূরণসহ সব কাজের ভাগ পেতেন তারা। শুধু সরকারি ফি জমা করে বাকি টাকা তারা ভাগ করে নিতেন। এ ছাড়া কয়েকজন ছাত্রীর সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক তৈরি হয় সিরাজের। তাদের মধ্যে কামরুন নাহার মনি রয়েছেন। সিরাজের চেষ্টায় মনির বিয়ে হয়। এতে মনিকে সহযোগিতা করেন তিনি। তার বাবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক আছে সিরাজের।

সিরাজ জবানবন্দিতে আরও জানান, ২৮ মার্চ তার অনুরোধে কাউন্সিলর মাকসুদ ও রুহুল আমিনের তত্ত্বাবধানে মানববন্ধন করা হয়। শামীম, নূর উদ্দিন, কাদেরসহ অন্যরা জোর করে মাদরাসার শিক্ষার্থীদের মানববন্ধনে হাজির করেন। ওই দিন আদালতের মাধ্যমে জেলে পাঠানো হয় সিরাজকে। ২৯ মার্চ সিরাজের স্ত্রী ফেরদৌস আরা ও ছেলে আদনান প্রথম জেলখানায় দেখা করতে যান তার সঙ্গে। পরে সিরাজের স্ত্রী, শাশুড়ি, তিন বোন ও শ্যালক রাজু ও তার স্ত্রী তানিয়া তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে কারাগারে যান। জেলখানায় ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটি ভক্ত গ্রুপও দেখা করে সিরাজের সঙ্গে। তাদের মধ্যে শামীম, নূর উদ্দিন, জাবেদ, রানা ও আব্দুল কাদেরও ছিলেন। জেলখানায় এই গ্রুপের সঙ্গে তার মামলা ও জামিন নিয়ে কথা হয়। আলাপ হয় নুসরাতের পরিবারকে আপস করতে বাধ্য করা ও মামলা প্রত্যাহারের জন্য কী করছে তা নিয়ে। সিরাজের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন ও মানববন্ধন চালিয়ে যেতে নির্দেশ দেন তিনি। এ সময় শামীম ও নূর উদ্দিনসহ কারাগারে সাক্ষাৎ করতে যাওয়া অন্যদের বকাবকি করেন সিরাজ। কিছু একটা চিন্তা করে দ্রুত তাকে জানাতে নির্দেশ দেন। রুহুল আমিন ও কাউন্সিলর মাকসুদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখার কথাও জানান তিনি। 

নুসরাত হত্যা মামলার এ প্রধান পরিকল্পনাকারীর জবানবন্দিতে উঠে আসে- মাদরাসার শিক্ষকদের মধ্যে মাওলানা মোহাম্মদ হোসেন, আবুল কাশেম, সহকারী শিক্ষক বেলায়েত হোসেন, হাছান আহাম্মদ মোহাম্মদ ইসমাইল, প্রভাষক সেলিম ও অফিস সহকারী সিরাজুল হক অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করতে কারাগারে যান। মাদরাসার বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন তিনি তাদের সঙ্গে। ৩ এপ্রিল শামীম, নূর উদ্দিন, আব্দুল কাদের, জাবেদ, এমরান, রানাসহ আরও কয়েকজন কারাগারে আবার সিরাজের সঙ্গে দেখা করতে যান। ওই সময় কারাগারে একজন জেল প্রহরী কিছু দূরে দাঁড়ানো ছিলেন। তার নাম জানা ছিল না সিরাজের। সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সঙ্গে কিছু সময় কথা বলেন সিরাজ। তাদের কাছে আন্দোলন, জামিন ও মানববন্ধনের ব্যাপারে জানতে চান অধ্যক্ষ। তারা বলেন, 'এত তাড়াতাড়ি কিছু হবে না।' তারপর নুসরাত ও তার পরিবারের ব্যাপারে তারা কী করেছেন তা জানতে চান। এভাবে কিছুক্ষণ কথা বলার পর শামীম ও নূর উদ্দিনের সঙ্গে একান্তে কিছু কথা বলেন অধ্যক্ষ। অন্যরা তখন একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শামীম ও নূর উদ্দিনকে সিরাজ বলেন, 'সর্বশক্তি দিয়ে বিষয়টি দেখতে হবে। নুসরাতের হত্যার পরিকল্পনা খুব ভালোভাবে করতে হবে।' 

এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ - dainik shiksha এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.007375955581665