বিশ্ব পরিমণ্ডলে আড্ডা সংস্কৃতিরই অঙ্গ - দৈনিকশিক্ষা

বিশ্ব পরিমণ্ডলে আড্ডা সংস্কৃতিরই অঙ্গ

প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন |

প্রকৃতপক্ষে বাঙালিরাই যে আড্ডার উদ্ভাবক তা কিন্তু নয়। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে অনেক উন্নত মানের আড্ডা হতো গ্রিসের রাজধানী অ্যাথেন্সে। সেখানে আড্ডার আখড়া ছিল জিমনেসিয়ামে। সে যুগে অ্যাথেন্সবাসী একই জায়গায় শরীর ও মনের ব্যায়াম করতো। ওই সব আড্ডায় আসর জমাতেন সক্রেটিস, প্ল্যাটো, অ্যারিস্টটলের মতো গুণীজন। তাঁদের আড্ডা থেকে সৃষ্টি হতো অনেক উন্নতমানের শিল্প-সাহিত্য, রাজনীতি ও অর্থনীতির তত্ত্বকথা। ইউরোপে-আমেরিকার বিজ্ঞানীরা যেমন - আইনস্টাইন, মার্কুনী, টমাস আলভা এডিসন, নিউটনের মতো বিজ্ঞানীরা আড্ডা জমাতেন নতুন নতুন আবিষ্কারের নেশায়। আড্ডা দিয়ে অবসর কাটাতে বাঙালির জুড়ি নেই। কি দেশে, কি বিদেশে, ছোট-বড় ও মাঝবয়সী নারী-পুরুষ সকলের মধ্যেই কমবেশি এই প্রবণতা দেখা যায়। পৃথিবীর অন্যান্য জাতির মধ্যেও যে আড্ডা একেবারে নেই তা বলা যায় না, তবে মূল কাজ বাদ দিয়ে নয়।

ইংরেজি শব্দ ‘গসিপ’ প্রধানত একটি নেতিবাচক শব্দ। বাঙালির আড্ডার কিছু খারাপ দিক থাকলেও একে পুরোপুরি ‘গসিপ’ এর সমার্থক বলা যায় না। আড্ডা সাধারণত একটি নির্মল ও নির্ভেজাল আনন্দের বিষয়, তবে এর ব্যতিক্রমও আছে। আড্ডা দিয়ে শুধু সময়ই কাটানো হয় তা নয়, আড্ডা থেকে অনেক সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানা যায়, শেখাও যায়। সহজ কথায় আড্ডা বলতে আমরা বুঝে থাকি, খোশ-গল্প, কথাবার্তা, গপ্প-সপ্প, ইত্যাদি। জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা থেকে শুরু করে ভ্রমণগল্প, দুঃসাহসিক অভিযান, প্রেমকাহিনী, ধর্ম-কর্ম, রাজনীতি, সমসাময়িক প্রসঙ্গ, সমাজ, সামাজিক নিয়ম-কানুন, শিক্ষা ও সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য এর যে কোনো কিছুই হতে পারে আড্ডার উপাদান। গুরুতর বা হালকা বিষয় সবই আলোচিত হতে পারে আড্ডার আসরে। কেউ কেউ আবার রাশভারী কথাকে হালকাভাবে রসিয়ে রসিয়ে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করতে পারেন। এ প্রসঙ্গে উদাহরণস্বরূপ কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর কথা না বললেই নয়। এমনও লোক আছেন যাঁরা একাধারে একের পর এক কৌতুক এবং চুট্কি বলে আড্ডাকে জমিয়ে রাখতে পারঙ্গম। যদি কেউ প্রশ্ন করেন, ‘আড্ডা কোথায় হয়?’ উত্তরে বলতে পারি, কোথায় হয় না আড্ডা? আড্ডার জন্য কোনো নির্দিষ্ট স্থান দরকার পড়ে না। আড্ডা বসতে পারে যে কোনো জায়গায় - খোলা আকাশের নিচে খেলার মাঠে, পুকুরঘাটে, নদীর ধারে, লেকের পাড়ে, কিংবা পার্কে, গাছের ছায়ায়, বসার বেঞ্চে, শিক্ষার্থীদের জন্য হতে পারে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন ইতাদি। আবার আড্ডা হতে পারে ঘরের ড্রয়িং রুমে, ছাঁদের নিচে চার দেয়ালের ভেতর, অফিসের কমন রুমে বা খাওয়ার টেবিলে, হোটেলের লবিতে, রেস্টুরেন্টে, চায়ের দোকানে, কফিশপে ইত্যাদি স্থানে।

বাঙালির মধ্যে আড্ডা পছন্দ করে না এমন লোক খুব কমই আছে। সামাজিক, রাজনৈতিক, পেশাগত, এমনকি ধর্মীয় কারণেও এক জায়গায় জড় হলে আমরা কোনো এক ফাঁকে আড্ডা জমাতে চাই। সুযোগ পেলে আমরা আড্ডার আসর বসাবই বসাব। যে সমাবেশে একেবারেই আড্ডা হয় না, তাকে অনেকের কাছে নিতান্তই নিরস ও নিরামিষ মনে হয়। দাওয়াত কিংবা পার্টিতে গল্প-সল্প না হলে আড্ডা বিলাসী মানুষের কাছে মনে হয় যেন পার্টিই হল না। অনুষ্ঠানে সাধারণত তিনটি পর্ব থাকে - দেখা-সাক্ষাৎ, খাওয়া-দাওয়া, গল্পগুজব ও আড্ডা। কারো কাছে দেখা সাক্ষাৎটাই মুখ্য, কেউ আবার নিতান্তই ভোজন বিলাসী, তবে বেশিরভাগ বাঙালির কাছে এ তিন পর্বের মধ্যে শেষেরটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য। নির্ভেজাল আড্ডার খাতিরে বাঙালিরা দশ-বিশ মাইল দূরে বন্ধুবান্ধব বা পরিচিত জনের বাড়িতে উৎসাহ সহকারে প্রায়ই যায়, এক কাপ চা বা কফি খায়, রাজা উজির মারার গল্প করে, প্রাণ খুলে হাসে এবং তারপর নিজ আলয়ে ফিরে আসে। বিদেশ বিভূঁইয়ে যেখানে বাঙালি বসতি আছে দুরত্ব যতই হউক ড্রাইভ করে যেতে আড্ডা-প্রিয় বাঙালিরা আপত্তি করে না।

আজকাল প্রযুক্তির প্রসারের ফলে ‘ই-মেইল’, ‘ফেস বুক’ হোয়াটসঅ্যাপ এবং টুইটারের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিসরে আড্ডার গণ্ডি সম্প্রসারিত হয়েছে। ইন্টারনেটে বাঙালির আড্ডার অনেকগুলো সাইট রয়েছে। কারো উৎসাহ থাকলে ওইসব সাইটে গিয়ে যখন তখন আড্ডা জমানো যায়। পাঠকদের সুবিধার জন্য আমি কয়েকটি সাইটের কথা বলছি - ‘আমাদের আড্ডা’, ‘বাংলা আড্ডাঘর’, ‘বাংলা আড্ডা’, ‘বাংলা গল্প বাংলা আড্ডা’, ‘আড্ডাবাজের বাংলাব্লগ’, ‘দেশি আড্ডা’, ‘বেঙ্গলি আড্ডা’, ‘বাংলা আড্ডা’, ইত্যাদি। এছাড়া ইউটিউবে আছে ‘আড্ডা বাংলা ফ্রেন্ডস’ লিঙ্ক ইত্যাদি। এ সব আড্ডায় এমন কোনো বিষয় নেই যা আলোচনায় উঠে আসে না। আড্ডা শুধু উপভোগ করার জন্যই নয়, সময় সময় অনেক কিছু জানতে ও শিখতে পারা যায়।

প্রাচ্যের কথা বলতে পারব না, তবে পাশ্চাত্য জগতেও আডডা হয়। আবার ইউরোপ এবং আমেরিকার লোকজন বাঙালির মতন আড্ডা দেয় না, দিতে চায়ও না। কারণ তারা কথাবার্তার ব্যাপারে খুবই ফর্মাল, কনজার্ভেটিভ এবং বলতে গেলে অতিরিক্ত সাবধান। অপরিচিত অথবা অল্প পরিচিত লোকজনের সাথে দেখা হলে তারা ‘সফট টক’ করে। ‘হার্ড টকে’ যায় না’। ‘সফট টক’ বলতে বোঝায় সেসব আলাপ আলোচনা যেখানে তর্ক-বিতর্কের সম্ভাবনা থাকে না। পক্ষান্তরে ‘হার্ড টক’ অবধারিতভাবে বিতর্কের জন্ম দেয়। সে সকল দেশের লোকজন নতুন কারো সাথে অন্য কিছু ছাড়া, ‘সফট টক’- মানে খেলাধুলা, দিনের আবহাওয়া, ইত্যাদি নিয়ে কথা বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এতে কথাও হল, আবার তিক্ততা সৃষ্টিরও কোনো ঝুঁকি থাকল না। ইউরোপ-আমেরিকার লোকজন বরাবরই কারো ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করে না। তারা ধর্মবিশ্বাস ও তার চর্চা এবং রাজনৈতিক মতামত বা মতাদর্শ ইত্যাদি ইস্যুকেও মানুষের একান্তই ব্যক্তিগত বিষয় মনে করে। এ ছাড়া মানুষের বিয়ে-সাদী, ছেলেমেয়ে, পেশা, আয়-ব্যয়, আর্থিক অবস্থা, গাড়ি-বাড়ি কিনলে তার দাম ইত্যাদি কখনোই জানতে চায় না’। পশ্চিমারা মৃত্যু, কাপড়-চোপড়, সাজগোজ, বেশ-ভূষা ইত্যাদি নিয়েও কথা বলে না। অনেক সময় অনেক নারী-পুরুষ গায়ে ট্যাটু করে, অদ্ভূত রকমের জামাকাপড় পরে এতে করে কেউ কিছুই বলতে চায় না। কোনো কোনো পুরুষ হাতে বালা, কানে দুল, গলায় মালা পরে। অনেকে মাথায় মেয়েদের মত লম্বা চুল যত্ন করে রাবার ব্যান্ড দিয়ে বেঁধে রাখে। এগুলোও সব তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। এ সব নিয়ে কেহই কোনো কথা বলে না। জাতীয় বা স্থানীয় নির্বাচনে কে কাকে ভোট দিল এটাও আলোচনার বাইরে। মোট কথা এত বিষয় আলোচনার তালিকা থেকে খারিজ হয়ে যাওয়ার কারণে বাঙালির সাথে তাল মিলিয়ে তাদের আড্ডা দেয়ার মতো পর্যাপ্ত পরিমাণ রসালো উপাদান অবশিষ্ট থাকে না, তাই তাদের আড্ডা তেমনটা জমে উঠে না। আর সে কারণেই হয়তো তারা বাঙালির মতো এত আড্ডা-প্রবণ নয়।

বাঙালির আড্ডা সব সময় যে নির্ভেজাল এবং নির্মল থাকে এমন কিন্তু নয়। আড্ডা দিতে গিয়ে এবং আড্ডায় রঙ লাগাতে গিয়ে বাঙালি অহ্রহ্ ঝামেলার মধ্যেও পড়ে। অনেক সময় কৌতুক করতে গিয়ে অনেক আড্ডাবাজ নিজের অজান্তেই বন্ধুবান্ধব কিংবা আত্মীয়-স্বজনদের মনোকষ্টের কারণ হয়ে যান এবং এতে করে দীর্ঘ দিনের গভীর সম্পর্ক স্থায়ীভাবে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া বিশেষ করে ধর্ম এবং রাজনীতি বিষয়ে আড্ডা দিতে গিয়ে অনেকেই অহ্রহ্ বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ে যান। এ রকম অবস্থায় উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়, কথা কাটাকাটি, ঝগড়া-ফ্যাসাদ, গালাগালি, হাতাহাতি এমনকি মারামারিও হয়। সেজন্য আড্ডার যেমন ভালো দিক আছে তেমনি আছে খারাপ দিকও। আড্ডার আসরে কথা বলতে এবং কথা শুনতে অনেকেরই ভাল লাগে। কারণ আড্ডায় থাকে উত্তেজনা এবং এর মাধ্যমে  ব্যথা-বেদনা বা টেনশন ভুলে কিছুক্ষণের জন্য হাসিঠাট্টার মাধ্যমে মজে থাকা সম্ভব। আড্ডায় মাদকতার স্বাদ পাওয়া যায়, শরীরে না হলেও মানুষের মনে নেশা ধরায়, তবে এখানে একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন, আড্ডা কিন্তু একেবারেই ঝুঁকিমুক্ত নয়। আড্ডায় বিভোর হয়ে পড়লে যে কোনো দুর্বল মুহূর্তে একটি বেফাঁস কথা আড্ডাবাজের মুখ থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। আর তেমনটি ঘটলে বের হওয়া মুখের কথা ফিরিয়ে আনা যায় না। ক্ষতি যা হওয়ার তা মুহূর্তেই হয়ে যায়। তাই আড্ডাপ্রিয় বাঙালিদের বলছি, আড্ডা ছাড়া থাকতে না পারলে আড্ডার প্রয়োজনীয়তা উপলব্দি করুন, তবে বুঝেসুঝে করুন, ধীরে করুন, জিহ্বার ওপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ রাখুন, কথা বলুন - সাবধানে, খুব সাবধানে। আর, ‘ভাল কিছু বলার না থাকলে নীরব থাকুন।

প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন : পরিচালক (প্রশিক্ষণ ও বাস্তবায়ন), জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম), শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা।

প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.003652811050415