এক সপ্তাহের ব্যবধানে আরো দুইটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমোদন দিয়াছে সরকার। এই নিয়া দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়াইল ১০১টি। হিসাব করিলে দেখা যাইবে, বর্তমান সরকারের দুই দফায়, গড়ে প্রতি বত্সর পাঁচটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পাইয়াছে। জানা গিয়াছে, আরো অন্তত ১০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চলতি বত্সরে অনুমোদন পাইতে পারে। শতাধিক আবেদনপত্রও জমা আছে। কিন্তু দেখা যাইতেছে, যত বেশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পাইতেছে ততই সেইগুলির ওপরে নিয়ন্ত্রণ কমিতেছে শিক্ষাপ্রশাসনের। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক তদবিরের কারণে ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০’ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করিতে পারিতেছে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
আবার, জনবল স্বল্পতা, আর্থিক অসঙ্গতি এবং আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) নিয়মিত পরিদর্শন করিতেও পারিতেছে না, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণে রীতিমতো হিমশিম খাইতেছে। পরিণতিতে, উচ্চশিক্ষার মান নিয়াও বারবার প্রশ্ন উঠিতেছে।উচ্চশিক্ষা যেন ফটকাবাজারের সস্তাপণ্য হইয়া উঠিয়াছে।
পত্রিকান্তরের প্রতিবেদনে দাবি করা হইয়াছে, কার্যক্রম চলিতেছে এমন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগই আইনের শর্ত মানিয়া চলিতেছে না। এখনো ৩০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আচার্যের নিয়োগকৃত উপাচার্য নাই, উপ-উপাচার্য নাই ৭০টিতে। আর কোষাধ্যক্ষ ছাড়াই চলিতেছে ৫২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। পুরাতন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাইতে সরকার ছয় দফা সময় বাঁধিয়া দিলেও এখন পর্যন্ত ৩৩টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাইতে পারেনি। ১১টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাইতে সমপ্রতি সরকারের কাছে নূতন করিয়া সময় চাহিয়াছে। সব মিলাইয়া নিয়মের মধ্যে চলিতেছে ১৫ হইতে ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়, এগুলির মান মোটামুটি ভালো। বাকিগুলির বিরুদ্ধে শিক্ষাবাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠিতেছে। ইউজিসি নিজস্ব অনুসন্ধানেও দেখিতে পাইয়াছে ৩-৩৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান একেবারেই তলানিতে। সম্প্রতি দেশের ৭০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ ও তদন্ত করিয়া প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হইয়াছিল, সেইগুলির ভিতরে ২৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে সনদ বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, অর্থ আত্মসাত্, মালিকানার দ্বন্দ্ব, কর ফাঁকি এবং জঙ্গিবাদ সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মিলিয়াছে। অথচ, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা নিতেছেন এমন ৬৩ শতাংশ শিক্ষার্থীই পড়িতেছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে। তাহারা কী শিখিতেছে তাহা নিয়া প্রশ্ন উঠিতেই পারে।আমরা নির্দ্বিধায় বলিব, শিক্ষার মানোন্নয়নে সরকার প্রতিনিয়তই কাজ করিয়া যাইতেছে। বত্সরের প্রথমদিন চার কোটি শিক্ষার্থীর কাছে ছত্রিশ কোটি বই বিনামূল্যে পৌঁছাইয়া দেওয়া একটি রেকর্ড বটে।
চলতি বত্সরে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) আড়াইশত মিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তা প্রদান করিবে শিক্ষাখাতের তথ্যপ্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য। উচ্চশিক্ষা বিস্তারে সরকারের উত্সাহকেও আমরা সবসময়ই সাধুবাদ জানাইয়া আসিয়াছি। কিন্তু আমরা উচ্চশিক্ষা দানকারী প্রতিষ্ঠানগুলির মানের প্রশ্নে নীরব থাকিতে পারিব না। আত্মস্লাঘায় না ভুগিয়া আমরা বলিব, নূতন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিলেই চলিবে না, ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি পরিচালনার মতো যথেষ্ট দক্ষ জনশক্তি আছে কিনা, তাহারা মানসম্মত শিক্ষাদান করিতে পারিবে কিনা তাহা কঠোরভাবে বিবেচনায় রাখিতে হইবে। অনিয়ম ও অসঙ্গতিগুলি দূর করিতে হইবে। একইসঙ্গে,বিশ্ববিদ্যালয়গুলি নিয়ন্ত্রণে ইউজিসির আইনিসক্ষমতা ও জনবল বৃদ্ধির দিকেও নজর দান করিতে হইবে। কেননা, ইউজিসি গঠন করা হইয়াছিল ৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কার্যক্রম দেখভাল করিতে। এখন শতাধিক বেসরকারি এবং ৪০টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ করা বাস্তবেই অসম্ভব।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক