বিশ্ববিদ্যালয় পালানো শিক্ষকরা - Dainikshiksha

বিশ্ববিদ্যালয় পালানো শিক্ষকরা

আমিরুল মোমেনীন মানিক |

এক.

‘আজ আমাদের ছুটি রে ভাই, আজ আমাদের ছুটি/ মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি।’ ছোট্টকালে খুব জনপ্রিয় ছিল এ ছড়াটা। যাই হোক সেই দুরন্তবেলায় ছুটি মানে আমাদের কাছে অন্যরকম অসাধারণ এক আনন্দের ব্যাপার ছিল। দুধ-চিতই পিঠা খাওয়ার চেয়ে কম আনন্দের না। যেদিন থেকে স্কুলে ছুটি হতো, মনে হতো তীব্র গরমে এক পশলা বৃষ্টি নেমে এলো। স্কুল পেরিয়ে হাইস্কুল। তারপর কলেজ। ধীরে ধীরে ছুটি নিয়ে যে অনুভূতি, তার পারদ নিচে নামতে থাকল।

দুই.
বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ছুটিটাকে উৎপাত মনে হতো। সাংস্কৃতিক তৎপরতায় এতটা ব্যস্ত ছিলাম যে, ছুটি এলেই সব কাজে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ছেদ পড়ত। অনেক ছুটিতে বাড়ি যাই নি। ক্যাম্পাসে থেকে গেছি। তখন অবশ্য দারুণ স্বপ্নেরা ভোঁ ভোঁ করত মস্তিষ্কে। কিসের ছুটি, কাজ করো, কাজ-অনুভূতিটা ছিল এ রকম। কিন্তু ক্লাসে গিয়ে মাঝে মাঝে ‘ছ্যাঁকা’ খেতে হতো। দু’একদিন পর পর শুনতাম- অমুক স্যার দেশের বাইরে আছেন অথবা গবেষণায় রত অথবা জরুরি পাণ্ডিত্য অর্জনের কাজে ব্যস্ত আছেন, তাই ক্লাস হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা হচ্ছেন লর্ডের মতো। বিপুল ক্ষমতার মালিক। একজন শিক্ষক ইচ্ছে করলে কোনো ছাত্রকে ফার্স্ট ক্লাস মার্ক দিতে পারেন, চাইলে ওই ছাত্রকে আবার ফেলও করাতে পারেন। তাই মুখে কুলুপ দেয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। ভাইভা-ভোসি পরীক্ষায় শিক্ষকরা স্বমহিমায় আবির্ভূত হন। কারো প্রতি আক্রোশ থাকলে তার পুরো প্রতিশোধ নেয়ার ওটাই মোক্ষম সুযোগ।

তাই কোনো শিক্ষক দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ছুটিতে থাকলেও কারো করার কিছু নেই। সবাই প্রতিবাদহীন। নচিকেতার গানটার মতো...কোন এক উল্টো রাজা উল্টো বুঝলি প্রজার দেশে/ চলে সব উল্টো পথে উল্টো রথে উল্টো বেশে/ সোজা পথ পড়ে পায়ে সোজা পথে কেউ চলে না/ বাঁকা পথে জ্যাম হরদম/ জমজমাট ভিড় কমে না।

তিন.
পুরনো চাল না কি ভাতে বাড়ে। তাই পুরনো পত্রিকা থেকে উদাহরণ টানতে চাই। ২০০৮ সালের ১ জুন প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদ সবার নজরে আনছি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের সভা : শিক্ষককে অপসারণ, গবেষণা না করলে টাকা ফেরত দিতে ১৩ জনকে সতর্ক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি’র বরাত দিয়ে করা খবরটা হলো এরকম: ছুটি শেষে কর্মস্থলে যোগদান না করায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক হাজেরা বেগমকে সহকারী অধ্যাপক পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে অর্থ নিয়ে গবেষণা শেষ করতে না পারায় ১৩ জন শিক্ষককে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে গবেষণা শেষ করতে না পারলে নিয়মানুযায়ী এসব শিক্ষককে অর্থ ফেরত দিতে হবে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে বেআইনিভাবে দেশের বাইরে অবস্থান করার কারণে ৩৫০ জন শিক্ষক চাকরি হারিয়েছেন।

আর স্বাধীনতার পর একই কারণে শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১২৩ জন শিক্ষক চাকরিচ্যুত হয়েছেন। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাছুটিতে আছেন প্রায় ৪০০ শিক্ষক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দ্বিতীয় অবস্থানে। ১৯৯১ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত অবৈধভাবে ছুটি নিয়ে বিদেশে অবস্থানের কারণে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৪ জনকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই কারণে সাতজনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক ড. সৈয়দা ফাহলিজা বেগম ছুটি নিয়ে লন্ডনে যান। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে ফিরতে না পারায় তাকে অব্যহতি দিয়েছে জাবি কর্তৃপক্ষ। শিক্ষাছুটিতে যাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৫ জন শিক্ষকের কোনো হদিস নেই। তারা কে কোথায় আছেন কেউই জানে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেও তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। তাদের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাওনা আছে ১ কোটি ৪৩ লাখ ২৫ হাজার ৯৯১ টাকা। 

চার.
সেলুকাস! মানুষ গড়ার কিছু সংখ্যক মুখোশধারী কারিগর আজ নিজেরাই হিংস্র প্রাণীতে পরিণত হচ্ছেন। শিয়ালের কাছে কুমিরছানার শিক্ষা অর্জনের সেই গল্প তো সবাই জানেন। সেই ঘটনার যেন আধুনিক পুনরাবৃত্তি। তবে সৌভাগ্যের কথা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো অনেক নীতিবান শিক্ষক আছেন। তাদের কল্যাণেই দু-চারজন প্রকৃত মানুষ পাচ্ছে এই জাতি।

লেখক পরিচিতি: প্রধান বার্তা সম্পাদক, চেঞ্জ টিভি. প্রেস এবং টক-শো
উপস্থাপক, এশিয়ান টিভি।

সূত্র: মানবজমিন

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0067880153656006