প্রতিবছর শোনা যায় আগামী বছর গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এ বছরও একই আশ্বাস পাওয়া যাচ্ছে। মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনায় উপাচার্যরা একমত হয়েছেন, ইউজিসির সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে এবং এ বিষয়ে কিছু অগ্রগতি হয়েছে বলেও শোনা যাচ্ছে।
গত ১২ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের ঘোষণা অনুযায়ী দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হচ্ছে ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার মধ্য দিয়ে। তিন মাসের বেশি সময় ধরে ৩১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলবে এ ভর্তি পরীক্ষা। সময়সূচি অনুযায়ী ঢাকায় অবস্থিত চারটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহীতে অবস্থিত দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার তারিখে সমন্বয় দেখা গেলেও অন্যগুলোতে তেমন কোনো সমন্বয় দেখা যাচ্ছে না। বিশ্লেষণে দেখা যায়, একজন শিক্ষার্থীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ মাত্র চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রায় এক মাস ঢাকায় অবস্থান করতে হবে। নতুবা ফাঁকে ফাঁকে বাসায় যেতে হবে। তবে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার তারিখ পাশাপাশি হওয়ায় এক ভ্রমণে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারবে শিক্ষার্থীরা।
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (২৬ ও ২৭ অক্টোবর), নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (২৬ থেকে ২৮ অক্টোবর), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (২৭ থেকে ৩০ অক্টোবর) ও খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা (২৭ অক্টোবর) প্রায় একই সময়ে নির্ধারিত হওয়ায় বিজ্ঞানের একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে যেকোনো একটিতে ছাড়া অন্যগুলোতে অংশগ্রহণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এ’ ইউনিটের (বিজ্ঞান) পরীক্ষা ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হলে এবং চট্টগ্রামে অবস্থিত অন্য বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ নভেম্বর পরীক্ষা দিতে চাইলে একজন শিক্ষার্থীকে সেখানে অতিরিক্ত পাঁচ দিন অপেক্ষা করতে হবে নতুবা বাসায় ফিরে আবার চট্টগ্রামে আসতে হবে। এরপর ২৪ নভেম্বর চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে চাইলে তৃতীয়বারের মতো চট্টগ্রামে আসতে হবে।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ‘এ’ ইউনিটের (বিজ্ঞান) পরীক্ষা ৯ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হলে একই দিন বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, তেজগাঁও, ঢাকার পরীক্ষা থাকায় প্রার্থী যেকোনো একটির পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে। পরদিন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে চাইলে তাকে ২১০ কিলোমিটার পথ ভ্রমণ করতে হবে। তবে পরদিন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল কাছাকাছি হওয়ায় পথ অনেকটাই সহজ হবে।
২২ থেকে ২৬ নভেম্বর মাত্র পাঁচ দিনে সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে (যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর ও হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর) ভর্তি পরীক্ষা থাকায় একজন শিক্ষার্থীকে মোট এক হাজার ৭৬৭ কিলোমিটার অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন ৩৫৩.৪ কিলোমিটার বা ১০ ঘণ্টার রাস্তা ভ্রমণ করতে হবে। এভাবে পরীক্ষার্থীদের এক জেলা থেকে আরেক জেলায়, এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে এলোমেলোভাবে ছুটতে হবে।
অক্টোবর মাসে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে বিজ্ঞানের একজন শিক্ষার্থীকে প্রায় এক হাজার ৫১২ কিলোমিটার অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন প্রায় ১৫১ কিলোমিটার পথ ভ্রমণ করতে হবে। নভেম্বরে ১৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে প্রায় তিন হাজার ৮২০ কিলোমিটার বা গড়ে প্রায় ২২৫ কিলোমিটার পথ ভ্রমণ করতে হবে এবং ডিসেম্বরে মাত্র চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে একজন পরীক্ষার্থীকে গড়ে প্রায় ২১২ কিলোমিটার রাস্তা ভ্রমণ করতে হবে। এভাবে একজন শিক্ষার্থীকে সর্বোচ্চ ৩১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে হলে প্রায় তিন মাসে পরীক্ষার মাঝে মাত্র চারবার বাড়ি ফেরাসহ প্রায় ছয় হাজার ৯০০ কিলোমিটার পথ ভ্রমণ করতে হবে, যা গতবারের তুলনায় ৭৮ কিলোমিটার এবং এক মাস বেশি।
এ বছর কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এরই মধ্যে এমসিকিউ পদ্ধতিতে পরীক্ষা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হঠাৎ করে পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন করায় শিক্ষার্থীরা বাড়তি বিপাকে পড়েছে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভোগান্তির কথা বিবেচনা করে যেখানে অভিন্ন পদ্ধতির কথা চিন্তা করা হচ্ছে, সেখানে এভাবে একেক বিশ্ববিদ্যালয় একেকভাবে পরীক্ষা পদ্ধতি গ্রহণ করলে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি আরো বেড়ে যাবে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে গুচ্ছ বা সমন্বিত পরীক্ষাপদ্ধতি চালু করতে দেরি হলেও অন্ততপক্ষে ভর্তি পরীক্ষার তারিখে সমন্বয় করা যেত, যাতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা ভোগান্তির শিকার না হন এবং একজন শিক্ষার্থী যোগ্যতা অনুযায়ী তার পছন্দের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে বা সব বিষয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকা বিভাগের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দিয়ে ভর্তি পরীক্ষা শুরু করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ঢাকায় অবস্থিত ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার তারিখ পাশাপাশি রেখে সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করা সম্ভব। এতে দিনাজপুর থেকে একজন পরীক্ষার্থী ঢাকায় এসে এক জায়গায় থেকে ঢাকা ও আশপাশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটানা বা পর পর পরীক্ষা দিয়ে বাসায় ফিরতে পারবে অথবা অন্য বিভাগের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে। এভাবে পর্যায়ক্রমে চট্টগ্রাম বিভাগের ছয়টি, সিলেট বিভাগের দুটি, ময়মনসিংহ বিভাগের দুটি, রাজশাহী বিভাগের চারটি, রংপুর বিভাগের দুটি, খুলনা বিভাগের চারটি এবং বরিশাল বিভাগের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করা যেতে পারে। আটটি বিভাগকে আটটি বা তার কম স্লটে ভাগ করে প্রতিটি স্লটের মাঝে কমপক্ষে এক সপ্তাহ বিরতি দিয়ে ভর্তি পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করা যেতে পারে। সংশ্লিষ্ট বিভাগের উপাচার্যরা প্রথমে আলাদা বসে নিজ নিজ বিভাগের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য সম্ভাব্য তারিখ বা সময়সূচি নির্ধারণ করবেন, পরবর্তী সময়ে সব বিভাগের উপাচার্যরা একত্রে বসে একটি কেন্দ্রীয় সমন্বিত সময়সূচি নির্ধারণ করবেন। এ জন্য সদিচ্ছা ও ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে আলোচনায় বসতে হবে। এভাবে ভর্তি পরীক্ষার তারিখ সমন্বয় করা গেলে ভ্রমণ দূরত্ব ও সময় কমে আসবে, ভোগান্তি হ্রাস পাবে এবং আর্থিক ও মানসিক ক্ষতি থেকে আমাদের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা রেহাই পাবেন।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে প্রচলিত পদ্ধতিতে ভর্তিপ্রক্রিয়া চালু আছে, তাতে দেখা যায় ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের ছুটতে হয় এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে, এক জেলা থেকে আরেক জেলায়, এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে, এমনকি দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। ভর্তি পরীক্ষার তারিখ একই দিনে হলে বিপাকে পড়ে শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার তারিখ পর পর থাকায় বেশি দূরত্বের কারণে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা অনেক শিক্ষার্থীর পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। অনেক সময় কোনো শিক্ষার্থী এই জটিলতা বা পরিস্থিতির শিকার হয়ে পছন্দের বিষয়টিতে ভর্তি হতে পারে না; এমন বিষয়ে ভর্তি হতে বাধ্য হয়, যা সে পড়তে চায়নি। এর ফলে হতাশা আর না পাওয়ার বেদনা নিয়ে উদ্দীপনা হারিয়ে সে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না। তাই প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে তার যোগ্যতা সাপেক্ষে সব ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া উচিত। অন্যথায় বঞ্চিত হবে মেধাবীরা, ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ ও জাতি।
লেখক : অধ্যাপক, প্যারাসাইটোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ