বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অস্থিতিশীল করা হয় কার স্বার্থে? - দৈনিকশিক্ষা

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অস্থিতিশীল করা হয় কার স্বার্থে?

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু |

আমরা জানি, বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে উচ্চশিক্ষা প্রদান করাসহ বিভিন্ন ধরনের গবেষণামূলক কাজকর্ম করা হয়ে থাকে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করাসহ সহশিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডে নিজেদের সম্পৃক্ত করে যোগ্য করে গড়ে তোলে। বিষয়ভিত্তিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়কে নানাভাবে ভাগ করা গেলেও সাধারণভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। যথা—পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। আর এই বিশ্ববিদ্যালয় নামক বিদ্যাপীঠে যারা পড়তে আসে, তাদের শিক্ষার্থী বলা হয়ে থাকে। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানচর্চা ও সহশিক্ষামূলক কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা।

কিন্তু শিক্ষার্থীরা যদি (যদিও সব শিক্ষার্থী নয়) বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞান-গবেষণাচর্চার পরিবর্তে ধ্বংসাত্মক রাজনীতি, পকেট ভরা নিয়ে ব্যস্ত থাকে; হাতে বই-খাতা আর কলমের পরিবর্তে লাঠিসোঁটা আর অস্ত্র নিয়ে মারামারি-ফাটাফাটি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠে, তবে অবশ্যই তা দেশ ও জাতির জন্য দুঃখজনক। আর এই দুঃখজনকের বিষয়টির পাল্লা ভারী দেখা যায় দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে। গত ২৩ জানুয়ারি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব সহিংস ঘটনা ঘটল, তা অবশ্যই এ দেশ-জাতির জন্য লজ্জাজনক একটি বিষয়। এ ধরনের ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কেউ আশা করেন না। ওই দিন ছাত্রী নিপীড়নে অভিযুক্ত ছাত্রলীগের নেতাদের বহিষ্কারের দাবিসহ চার দফা দাবিতে প্রশাসনিক ভবনে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের পিটিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানকে ‘উদ্ধার’ করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় অন্তত ৪০ জন আহত হয়। শুধু তা-ই নয়, ওই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে ঘেরাও করে দরজা ও অফিস ভাঙচুর, অশালীন ভাষায় উপাচার্যকে গালাগাল ও তাঁর দিকে তেড়ে যাওয়া হয়, যা আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ।

যদিও এসব ঘটনার জন্য ছাত্রলীগ ও বাম ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা পরস্পরকে দায়ী করেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে ভাঙচুর, বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদের ক্ষতিসাধন ও শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে অশালীন আচরণ করাসহ উপাচার্যকে শারীরিকভাবে নির্যাতনের চেষ্টা করে, তারা আর যা-ই হোক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হতে পারে না। কারণ ছাত্রের যেসব বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার, এসব বিষয় কোনোভাবেই ছাত্রের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পড়ে না। এ ক্ষেত্রে সরকারসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভালোভাবে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন যে ছাত্র নামক এসব সন্ত্রাসী দেশি-বিদেশি কোনো চক্র বা বিশেষ কোনো মহলের নীলনকশা বা ষড়যন্ত্র অনুযায়ী ষড়যন্ত্রকারীদের এজেন্ডা বা মিশন বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে কি না। নাকি আসন্ন নির্বাচনের আগে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে এসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে? এসব প্রশ্নের পাশাপাশি আরেকটি প্রশ্ন সবার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে, আর তা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমনের দায়িত্ব কোনো ছাত্রসংগঠনের হতে পারে কি না? আন্দোলনের নামে কেউ যদি বাড়াবাড়ি করে, তবে তা মোকাবেলার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত নিয়ম-রীতি রয়েছে।

কিন্তু শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমনের দায়িত্ব কোনো ছাত্রসংগঠনের নিজের হাতে তুলে নেওয়াটা কাম্য হতে পারে না। আর এটি করতে গিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর যদি হামলা ও নির্যাতন চালানো হয়, তবে তা একটি স্বাধীন, গণতান্ত্রিক ও সভ্য দেশে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সবারই স্মরণ রাখা প্রয়োজন, আন্দোলনের নামে অশোভন আচরণ যেমন কাম্য নয়, তেমনি আন্দোলন দমনের নামে সহিংসতাও মেনে নেওয়া যায় না। শিক্ষার্থীদের ন্যায্য কোনো দাবি থাকলে তা অবশ্যই শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক উপায়ে সমাধান করা সম্ভব। বলার অপেক্ষা রাখে না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সংঘটিত এসব সহিংস ও ন্যক্কারজনক ঘটনায় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড তথা দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ নামক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেজ বা ভাবমূর্তি দেশি ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নানাভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। পাশাপাশি এ ধরনের ঘটনার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়টির দীর্ঘদিনের নানা অর্জন আজ যেন ম্লান হতে চলেছে।

শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, দেশের উচ্চশিক্ষার প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই অনেক আগে থেকেই ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসীরা অব্যাহতভাবে সন্ত্রাস, হত্যা, হামলা, ভাঙচুর, দখলদারি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, গ্রুপিং বা অভ্যন্তরীণ কোন্দল, আধিপত্য বিস্তার, নিয়োগ, ভর্তি ও সিট বাণিজ্যসহ নানা ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক মেধাবী ছাত্রের হতাহতের ঘটনাসহ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মোটা অঙ্কের টাকার সরকারি সম্পদ বিনষ্ট করার খবর আজ আর কারো অজানা নয়। রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করেও এসব সন্ত্রাসী বারবার রেহাই পেয়ে যাচ্ছে এবং শেষ পর্যন্ত নানা ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে আবার লিপ্ত হয়ে পড়ছে। আর এসব ঘটনার ফলে একদিকে যেমন দেশ ও জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে, অপরদিকে শিক্ষাঙ্গনগুলোতে বারবার মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে লেখাপড়ার সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক পরিবেশ। সৃষ্টি হচ্ছে সেশনজট, শিক্ষার্থীদের পেছনে তাদের অভিভাবকদের ব্যয় করতে হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যারা ঘটাচ্ছে, তারা কি অপ্রতিরোধ্য? এদের কি সামলানো সম্ভব নয়? যদি সামলানো সম্ভব হয়, তাহলে তাদের সামলানোর দায়িত্ব কার? রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করেও ‘ছাত্র’ নামধারী সন্ত্রাসীরা বারবার রেহাই পেয়ে যাচ্ছে। ছাত্র নামধারী এসব সন্ত্রাসীর অপকর্মের জন্য দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অধ্যয়নরত হাজার হাজার সাধারণ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন আজ অনিশ্চিত পথের দিকে ধাবিত হচ্ছে। লেখাপড়া করার পরিবর্তে ক্যাম্পাসে কখন সংঘর্ষ বাধে—তাদের এই শঙ্কায় থাকতে হচ্ছে। পাশাপাশি বহন করতে হচ্ছে সেশনজটের বোঝা। সর্বোপরি বিঘ্নিত হচ্ছে লেখাপড়ার সুষ্ঠু পরিবেশ। নষ্ট হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুল টাকার সম্পদ।

এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ধারাবাহিক ও চলমান এসব অস্থিরতা কিসের আলামত বহন করে এবং এর পেছনে স্বার্থ কী? শিক্ষাঙ্গনের এসব অস্থিরতার মাধ্যমে দেশ-জাতিকে মেধা ও নেতৃত্বশূন্য করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেশি-বিদেশি কোনো অশুভ চক্রের যোগসূত্রতা রয়েছে কি না তা সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ সবাইকে ভালোভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। পাশাপাশি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অস্থিরতা বন্ধ করতে তথা ছাত্ররাজনীতির ব্যাপারে দেশের রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে তাদের নিজেদের স্বার্থেই সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক সদস্য।

 

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ ও ‘বিশ্ব বই দিবস’ - dainik shiksha স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ ও ‘বিশ্ব বই দিবস’ শিক্ষার মান পতনে ডক্টরেট লেখা বন্ধ জার্মান পাসপোর্টে - dainik shiksha শিক্ষার মান পতনে ডক্টরেট লেখা বন্ধ জার্মান পাসপোর্টে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.022820949554443