বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোন অবস্থায় খুলতে পারে? - দৈনিকশিক্ষা

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোন অবস্থায় খুলতে পারে?

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

করোনায় বিপর্যস্ত সবকিছু। আস্তে আস্তে ‘সীমিত’ পরিসরের প্যাকেজবদ্ধ খুলছে দোকানপাট, লকডাউনের কড়াকড়ি রশিতে ছেড়ে দেওয়া ভাব। অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান তা-ও ধীরে ধীরে খুললেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কবে থেকে চালু হবে বা কী করে চালু হবে, তা নিয়ে সবার মনে প্রশ্ন, ভয়, আতঙ্ক আর মনে মনে নিজের মতো করে নিরাপত্তার প্রস্তুতি। শিক্ষার্থীদের করোনা-উত্তর সময়ে ফের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাতে অভিভাবকেরা যেমন শঙ্কিত থাকবেন, একই উদ্বেগ থাকবে শিক্ষার্থী-শিক্ষক এবং প্রশাসনিক ব্যক্তিদের মধ্যেও। এখন এত এত দুশ্চিন্তা, ঝুঁকিকে সঙ্গে নিয়ে কীভাবে চলমান রাখা যাবে শিক্ষা কার্যক্রম? এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাওয়া জরুরি। আজ সোমবার (১৮ মে) প্রথমআলো পত্রিকায় প্রকাশিত মতামত সংবাদে এই মতামতটি প্রকাশিত হয়্।

মতামতটিতে আরও বলা হয়, দুই মাস ধরে বন্ধ আছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। শুধু বাংলাদেশ নয়, বেশির ভাগ দেশেই। কিন্তু অনেক দেশই অনলাইনে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম জারি রেখেছে। আমাদের স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে টেলিভিশন এবং অনলাইনে কিছুটা কার্যক্রম রয়েছে, তবে সবার কাছে হয়তো সেটা পৌঁছাচ্ছে না। কোনো কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ও শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন দুই হাজারের বেশি কলেজ এর বাইরে আছে। ফোনে এবং আনলাইনে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছোটখাটো জরিপ চালিয়ে বোঝা গেল যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে ক্লাস চালানোর মতো অবস্থায় নেই।

এর অনেকগুলো কারণ আছে। একে তো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি এবং বেশির ভাগ শিক্ষার্থীরা বর্তমানে তাঁদের গ্রামের বাড়িতে আছেন। তাঁদের অনেকেরই স্মার্টফোন নেই কিংবা কেনার সংগতিও নেই। নেই ইন্টারনেট ডেটা কেনার মতো আর্থিক অবস্থা। অনেকের এলাকাতেই নেটওয়ার্ক সমস্যা। কারও কারও হয়তো বাড়িতে অনেক সদস্য থাকায় সেখানে নিরিবিলি জায়গা পেয়ে আনলাইনে ক্লাস করার বাস্তবতাও নেই। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত পাবলিক এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক–তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থীই অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল পরিবার থেকে আসেন এবং এই করোনার অর্থনৈতিক আঘাতে বেশ কিছু শিক্ষার্থী হয়তো আর শিক্ষাজীবনই শেষ করতে পারবেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পর্যন্ত ৫ হাজার শিক্ষার্থী অর্থনৈতিক সহযোগিতার জন্য আবেদন জানিয়েছেন। বিভিন্ন বিভাগ, শিক্ষক সমিতি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন মিলে প্রায় ২ হাজার শিক্ষার্থীর পাশে দাঁড়িয়েছে। সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই এখন আমাদের পরিকল্পনা করতে হবে আগামী দুই বছর কীভাবে চলবে?

আমরা ধরেই নিচ্ছি আমরা এক সেমিস্টার সেশনজট নিয়েই এগোবো। মানি, নানা কারনেই তৈরি হওয়া সেশনজট মোকাবিলায় বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পারদর্শিতা আছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, এই ভবিষ্যৎ অন্য সময়ের চেয়ে হবে একবারেই আলাদা। করোনা–পরবর্তী বাংলাদেশে এই বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত হবে স্বাস্থ্য সুরক্ষার নতুন নতুন শর্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জোর দিয়েই বলছে করোনা হয়তো কখনো পৃথিবী থেকে যাবে না এবং আগামী দুই বছর সামাজিক দূরত্ব বজায়ের পাশাপাশি মানতে হবে স্বাস্থ্য সুরক্ষার আরও বেশ কিছু নিয়মনীতি। এসব চিন্তা মাথায় নিয়ে করোনা–উত্তর সময়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আবার কীভাবে শুরু করবে, এটিই হয়তো এই সময়ের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। সেটি মোকাবিলায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কী ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করছে?

প্রথমটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই যদি সামনে আনি, ৪০ হাজারের ওপর শিক্ষার্থীর এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কীভাবে স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করবে?

এখন এই ভয়, শঙ্কা, উদ্বেগকে পেছনে ঠেলে সত্যি যদি আমরা প্রস্তুতির দিকে যাই, তাহলে দুটো পথ আছে। প্রথমটি হলো, বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে হলে কোন কোন বিষয়ে আতি সত্বর প্রস্তুতি প্রয়োজন, তা নিরূপণ করা। শ্রেণিকক্ষের স্বল্পতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যলেঞ্জ। সেখানে প্রায় প্রতিটি বিভাগেই (অল্প কয়েকটি নতুন বিভাগ বাদ দিলে) একটি শ্রেণিকক্ষে পাঠ দিতে হয় ৫০–এর বেশি শিক্ষার্থীদের। কোনো কোনো বিভাগে এই সংখ্যা ১০০–এর ওপরে। একজনকে আরেকজনের আনেকটা গা ঘেঁষেই বসতে হয়। সেখানে কীভাবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা যাবে? আর তা ছাড়া প্রতিদিন এই ৪০ হাজার শিক্ষার্থীর শরীরের তাপমাত্রা মাপাও সম্ভব যে হবে না, তা সহজেই অনুমেয়।

শিক্ষার্থীদের বাইরে শিক্ষকদের বিষয়টিও মনোযোগ দিতে হবে প্রশাসনকে। যেখানে শিক্ষকদের অনেকেরই নিজেদের কোনো বসার কক্ষ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির ১১ বছর পরও আমরা তিনজন সহকর্মী ছোট্ট একটি রুম ভাগাভাগি করি, যেখানে রুমে ঢোকা এবং রুম থেকে বের হওয়াও কষ্টের হয়ে পড়ে। আর সেখানেই টিউটোরিয়াল পরীক্ষাসহ অন্যান্য সব কার্যক্রম চালোনা হয়। ঢাকার বাইরে নতুন চালু হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা আরও করুণ। অনেকগুলোতে কোনো কোনো বিভাগের সব শিক্ষকেরাই এক রুমেই বসেন। তখন কি আসলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হবে?
এর বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যলেঞ্জ শিক্ষার্থীদের আবাসিক হল। সেগুলোতে কীভাবে স্বাস্থ্য সুরক্ষা নীতি মানা হবে, যেখানে এক একটি রুমে ৬–৭ জন থাকেন? ছেলেদের হলগুলোর চিত্র আরও ভয়াবহ। সবকিছু বিবেচনায় এনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। তবে একটি হলের দায়িত্বরত আবাসিক শিক্ষক হিসেবে হলগুলোতে শুধু ‘বৈধ’ শিক্ষার্থীরাই থাকবেন এবং গণরুম ‘থাকবে না’ এই দুই অবস্থান ছাড়া মৌলিক কোনো সংস্কারের পরিকল্পনার কথা জানা যায়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দুই শিফটে ক্লাস চালু করা হলে শ্রেণিকক্ষে সামাজিক দূরত্ব কিছুটা বজায় থাকবে। কিন্তু তাতে শিক্ষকদের পরিশ্রম হবে দ্বিগুণ। সে ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষকদের বেতনের বাইরে বাড়তি ‘প্রণোদনা’র আওতায় আনতে হবে। হলগুলোতে ‘ডাবলিং’ ব্যবস্থা তুলে দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারকে কীভাবে অতি দ্রুত সময়ে একটি হাসপাতালে রূপ দেওয়া যায়, সেদিকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। সব শিক্ষার্থীর জন্য স্বাস্থ্যবিমা করতে হবে (যদিও বেশ কয়েকটি বিভাগ ইতিমধ্যে করেছে)।

এর বাইরের বিকল্প হলো, দীর্ঘমেয়াদি অনলাইন শিক্ষার দিকে ঝোঁক তৈরি করা। সেখানে প্রথম কাজ হবে যেসব শিক্ষার্থী অর্থনৈতিকভাবে নাজুক, তাঁদের প্রতি অর্থনৈতিক সহযোগিতা অব্যাহত রাখা। এর পাশাপাশি সব শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের জন্য ল্যাপটপ অথবা স্মার্ট ফোনের ব্যবস্থা করা। তার পরের ধাপটি হলো মোবাইল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সমঝোতা করে শিক্ষার্থীদের জন্য মোবাইল ডেটা ফ্রি করে দেওয়া।

আমরা অল্প সময়ে হয়তো কোনো বড় ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে পারব না। সেই সামর্থ্যও হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নেই। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই করোনা–পরবর্তী যুদ্ধের জন্য কী ধরনের পরিকল্পনা করছে, সেটি জানা প্রয়োজন। আর এখনো পরিকল্পনা না করলে অচিরেই এই বিষয়ে পরিকল্পনা এবং পদক্ষেপ নেওয়ার আগে সম্ভাব্যতা যাচাই করাও জরুরি।

আমরা অনেক সময়ই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে পারি না। সে জন্য আমাদের মূল্যও দিতে হয় অনেক। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি এখনই পরিকল্পনা না গ্রহণ করে, তাহলে মূল্য যে দিতে হবে, সে বিষয়ে দ্বিমত হওয়ার সুযোগ একেবারেই নেই।

লেখক: জোবাইদা নাসরীন। শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি - dainik shiksha চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.007861852645874