বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা ও শিক্ষক রাজনীতি - দৈনিকশিক্ষা

বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা ও শিক্ষক রাজনীতি

ড. সুলতান মাহমুদ রানা |

সম্প্রতি বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছু ইস্যুতে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। জাতীয় রাজনীতিতে যখন মোটামুটি স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে, ঠিক সে সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছোটখাটো ঘটনায় অস্থিরতা আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের দলাদলি ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। আবার ছাত্র সংগঠনগুলোর আধিপত্য, কোন্দলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি উপাচার্যের অনভিপ্রেত বক্তব্যের ফলেও অচলাবস্থার নজির তৈরি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কমবেশি অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অবশ্য ছাত্রলীগের কোন্দল, আধিপত্য বিস্তার এবং প্রশাসনের সঙ্গে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের টানাপড়েন, শিক্ষকদেও চাওয়া-পাওয়া, ন্যায্যতা-অন্যায্যতার প্রশ্ন প্রভৃতি এসব উত্তেজনা সৃষ্টির কারণ হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌক্তিক কারণে শিক্ষকদের মধ্যে গ্রুপিং এবং প্রশাসনের প্রতি আস্থার সংকট প্রতীয়মান হচ্ছে। এভাবে বিভিন্ন ইস্যুতে সৃষ্ট উত্তেজনা ও সংকট সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। দৈনিক সমকালে  নিবন্ধনটি প্রকাশিত হয়েছে।

উল্লেখ্য, গত ১৮ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে সরকারপন্থি প্যানেলের সভাপতিসহ মোট ৫টি পদের পরাজয়ের কারণে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের পারস্পরিক আস্থা-অনাস্থার প্রশ্ন যেমন উত্থাপিত হয়েছে তেমনি সরকারের ভাবমূর্তিতেও আঘাত হেনেছে। রাবিতে পরপর দুটি নির্বাচনে সরকারপন্থি প্যানেলের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রার্থীর পরাজয়ের দায় নিজ দলের শিক্ষকরাই এড়াতে পারছেন না। কারণ বিপরীত দলের শিক্ষকদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যক শিক্ষক থাকা সত্ত্বেও এই পরাজয়ের সমীকরণ মেলানো সহজ নয়। সঙ্গত কারণেই পরাজয়ের দায় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এক্ষেত্রে খুব ন্যায্যভাবেই দলের নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থার সুযোগ এবং শিক্ষকদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। 

এতদিন আমরা লক্ষ্য করেছি, ক্ষমতার দাপটে সারাদেশে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা নিজেদের পদ-পদবির আশায় ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতো। এখন এই লড়াইটা শুধু শিক্ষার্থীদের মধ্যেই সীমিত নেই, শিক্ষকদেও মধ্যেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটি বাংলাদেশে চিরাচরিত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে রূপ নিয়েছে। উল্লেখ করতে খারাপ লাগলেও এটি সত্য যে, রাজনীতির নেতিবাচক সংস্কৃতি এখন শিক্ষকরাই বেশি প্র্যাকটিস করতে শুরু করেছেন। কে প্রশাসনে যাবে, কে যাবে না, কাকে বাদ রাখতে হবে, কাকে চাকরিচ্যুত করতে হবে, কার বিরুদ্ধে মিথ্যা হয়রানিমূলক আচরণ করতে হবে, কাকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাথায় তুলতে হবে, কাকে মিথ্যা অভিযোগে জর্জরিত করতে হবে, কাকে পদ দিতে হবে, কাকে দিতে হবে না, কার পদোন্নতি বিলম্বে করতে হবে, কার পদোন্নতি দ্রুত করতে হবে- এগুলো এখন শিক্ষক রাজনীতির মূল বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আর এর ফল হিসেবে শিক্ষকদের মধ্যে দলাদলির মাত্রা বেড়েছে আগের তুলনায় অনেক বেশি।

সমসাময়িককালে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকার সমর্থিতরা প্রভাব বিস্তার করে আসছে। আর ক্ষমতা পাওয়া এবং ক্ষমতায় যাওয়ার সূত্রে পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ি চলতে থাকে অনেক বেশি। শিক্ষকদের নামে-বেনামে নানা উড়োচিঠি দিয়ে সমালোচনার সংস্কৃতিও বেড়েছে যথেষ্ট। এসব নেতিবাচক সংস্কৃতি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতিতে অবলোকন করছি। এক কথায় বলা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতির সংস্কৃতি যতটা উচ্চ পর্যায়ে যাওয়ার কথা ছিল, ঠিক তার বিপরীতমুখী হয়ে নিম্ন পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। কয়েকদিন আগেই রাবি প্রশাসনের বিরুদ্ধে শিক্ষামন্ত্রীকে লেখা চিঠি শিক্ষকদের নামে বিলি করা হয়েছে। সত্য-মিথ্যা তথ্যে শিক্ষামন্ত্রীকে লেখা এই চিঠি শিক্ষকদের মানসিকতার ধরন নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এমনকি এমন নামে-বেনামে চিঠি বিলির সংস্কৃতি শিক্ষক রাজনতিকে কলুষিত করে তুলছে। 

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে দেখা যায় সরকাদলীয় স্থানীয় রাজনীতির কব্জায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে। প্রশাসন অনেক সতর্ক থাকে যে, স্থানীয় নেতারা যেন সহজেই কোনো ইস্যুতে প্রশাসনবিরোধী আন্দোলনে যেতে না পারে। এ জন্য চাকরির প্রলোভনে হলেও স্থানীয়দের নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের। এই চিত্রটি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ্য করি। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারদলীয় স্থানীয় নেতাকর্মী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে হুমকি-ধমকি ও লাঞ্ছিত করতে দ্বিধা করে না। আবার দুঃখজনক হলেও সত্য, এসব ঘটনার নিন্দা জানানোর জন্য সাধারণ শিক্ষকদের কোনো সুস্পষ্ট অবস্থান দেখা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির বিবৃতিতেও নিন্দা ছাড়া কোনো প্রতিবাদী কর্মসূচি থাকে না। কারণ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখন এমনই হয়েছে। প্রতিবাদের কোনো উপায় কিংবা সুযোগ সৃষ্টির দুঃসাহস কেউ করতে পারেন না কিংবা করতে চান না। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বজনপ্রীতি বহুলাংশে বেশি। শিক্ষকরা নিজ স্বার্থে তার রাজনৈতিক ভাবনার বিপরীতে গিয়ে নিজের অবস্থান নেন। ভোট প্রদানের স্বাধীন অধিকারের নামে বিশ্বাসঘাতকতা করতেও কার্পণ্য করেন না শিক্ষকরা। ক্ষমতার সঙ্গে আপস করেন এমন নজির বা অভিযোগ বর্তমান বাংলাদেশে নেহাত কম নয়। 

কিন্তু এভাবে দলাদলি, কোন্দল, কাদা ছোড়াছুড়ি এবং সর্বোপরি নির্বাচনে বিশ্বাসঘাতকতা চলতে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মূল লক্ষ্যটি ক্রমেই বিনষ্ট হয়ে যাবে। শিক্ষার পরিবেশ রক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তির যেমন গুরুদায়িত্ব রয়েছে তেমনি সাধারণ শিক্ষকদেরও এ বিষয়ে দায়িত্ব কম নয়। বর্তমানে দেশের অগ্রসরমান যাত্রায় তাল মিলিয়ে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে যথাযথভাবে টিকিয়ে রাখতে শুধু এককভাবে উপাচার্যকে নয়, সব শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তার যথাযথ দায়িত্ব পালন করার কোনো বিকল্প নেই। বর্তমান সময়ে শিক্ষকদের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণা, বিভেদ, দলাদলি কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা আমাদের সবারই জানা। এসব নেতিবাচক সংস্কৃতি শিক্ষার পরিবেশকে ব্যাহত করে। নেতিবাচক সংস্কৃতি পরিহার করা আমাদের সবার দায়িত্ব। চলমান নেতিবাচক সংস্কৃতি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে রক্ষা করতে শিক্ষকদেরই বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে। 

বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তচিন্তার জায়গা। কিন্তু মুক্তচিন্তাকে রোধ করার যেসব অপপ্রয়াস লক্ষ্য করা যায় সেগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়কে বাঁচিয়ে রাখতে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার বিকল্প নেই। সর্বোপরি যে কথাটা না বললেই নয়, সরকারপন্থি শিক্ষকদের প্রভাব, উপদলে বিভক্তদের নানামুখী চাপ এবং বিরোধী মানসিকতাসম্পন্নদের ক্রমাগত বিরোধিতা, সরকারদলীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের প্রত্যাশা সব মিলিয়ে ত্রিশঙ্কু অবস্থা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে বাঁচাতে প্রশাসনের পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষকদের লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। 

সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি - dainik shiksha মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! - dainik shiksha খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ - dainik shiksha এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে - dainik shiksha মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা - dainik shiksha মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! - dainik shiksha মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036637783050537