গবেষণা হলো জ্ঞানের যে কোনো শাখায় তথ্য সংগ্রহ এবং পর্যবেক্ষণের নিয়ন্ত্রিত ও পদ্ধতিগত নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণ। গবেষণা বৈজ্ঞানিক তথ্যানুসন্ধানের একটি প্রক্রিয়া—যার মাধ্যমে জ্ঞান বিকাশের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজ বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, চিকিত্সাবিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কারের মাধ্যমে মনুষ্য জাতির সমস্যার সমাধানের উপায় যেমনি উদ্ভাবিত হয়েছে, তেমনি মানুষের সমস্যার নানা দিক সম্পর্কেও সচেতন হওয়া গেছে। প্রযুক্তিনির্ভর দুনিয়ায় যে জাতি গবেষণায় যতটা বেশি মনোযোগী, ক্ষমতা আর বিত্তে তারা ততটাই উন্নত। রোববার (৬ অক্টোবর) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
যথাযথ প্রণোদনার অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ধীরে ধীরে গবেষণায় অনাগ্রহী হয়ে পড়ছেন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বাজেট ছিল ১৪ কোটি টাকা; গবেষণা খাতে খরচ হয় ৮ কোটি টাকা। একই অর্থবছরে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা বরাদ্দ ছিল ১ কোটি টাকা অথচ বছর শেষে সমপরিমাণ অর্থ অব্যয়িত রয়ে যায়। দেশের প্রায় এক-চতুর্থাংশ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো গবেষণাই হচ্ছে না। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার যে গুটিকয়েক গবেষণা হচ্ছে, তার বড়ো অংশ আবার আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশে অযোগ্য।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে গবেষণা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, তা কৃষির দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। জলবায়ু পরিবর্তন, শহরায়নের কারণে ভূমিহ্রাসের মতো চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে কৃষি গবেষণায় অধিকতর মনোযোগ। কৃষিকে প্রযুক্তিনির্ভর করার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। কৃষি গবেষণায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা কৃষিকে প্রবল বিক্রমে এগিয়ে নিয়ে গেছে। কৃষিতে গবেষণায় কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসলেও এমন আরো অনেক খাত আছে যেখানে গবেষণার অভাবে প্রত্যাশিত জায়গায় আমরা পৌঁছাতে পারছি না। মানুষের মৌলিক চাহিদা—শিক্ষা ও স্বাস্থ্য তার মধ্যে অন্যতম। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার মানহীনতার অভিযোগ পুরোনো। শিক্ষা গবেষণায় প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করা হচ্ছে না বলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা মানের উত্তরণ ঘটছে না। স্বাস্থ্য খাতে গবেষণার অভাবে স্বাস্থ্যকর্মীদের নির্ভর হতে হচ্ছে বিদেশি গবেষণা অথবা পুরোনো চিকিত্সা পদ্ধতির ওপরে। ১৯৯৭ সালে প্রথম জাতীয় পুষ্টি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করলেও পর্যাপ্ত গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্তের অভাবে প্রথম জাতীয় পুষ্টি কর্মপরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। অপুষ্টি দূরীকরণে দীর্ঘদিনেও কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন না করলেও অপুষ্টি দূরীকরণে করণীয় নিয়ে সরকারি উদ্যোগে তেমন কোনো গবেষণা চোখে পড়ছে না। স্বাস্থ্য খাতে গবেষণার অভাবে সর্বশেষ যে দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হলো গোটা জাতিকে— তা হলো ডেঙ্গু। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ডেঙ্গু অতীব পুরোনো সমস্যা হলেও ডেঙ্গু নিয়ে সুসংগঠিত গবেষণার অভাবে জাতিকে এক অবর্ণনীয় দুর্ভোগ লাঘব করতে হলো। ডেঙ্গু নির্মূলে বর্তমান বিদেশি প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে পার পাওয়া গেলেও ভবিষ্যতে এ সমস্যা পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে নিজস্ব গবেষণার অভাবে জনদুর্ভোগ আবারও চরমে পৌঁছাতে পারে।
যে কোনো দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উত্কর্ষসাধন নির্ভর করে ঐ দেশের গবেষণার যোগ্যতা এবং গবেষণা খাতে প্রযু্ক্ত অবকাঠামোগত সুবিধার ওপর। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত গবেষণার ক্ষেত্রেও যোজন যোজন পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বাংলাদেশেও যে বড়ো পরিসরে গবেষণা অসম্ভব নয়, তা করে দেখিয়েছেন সত্যেন বসু থেকে শুরু করে ড. মাকসুদুল আলম পর্যন্ত বিভিন্ন বিজ্ঞানী। গবেষণার জন্য চাই শিক্ষার্থীদের মাঝে আগ্রহ সৃষ্টি এবং ধারাবাহিক সুযোগ তৈরি। গবেষণার পেছনে অধিক অর্থায়ন করা এবং গবেষণা বাজেট যেন অব্যয়িত না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। উচ্চ শিক্ষায় আসন বৃদ্ধিতে শুধু নজর নয়, প্রকৃত গবেষণার সংখ্যা বৃদ্ধিতে সমান দৃষ্টি আরোপ করতে হবে। উন্নত বিশ্বে বড়ো বড়ো করপোরেট বা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কো-অপারেশনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের শিক্ষার্থীদের জন্য গবেষণার সুযোগ তৈরি করে থাকে। বাংলাদেশেও ইন্ডাস্ট্রি একাডেমি কো-অপারেশন তৈরির মাধ্যমে গবেষণার সুযোগ তৈরি করে গবেষণার সংখ্যা বাড়ানোর একটি উপায় হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক উভয়ের মাঝে গবেষণার আগ্রহ তৈরি করতে পারলেই গবেষণা খাতে সৃষ্ট আপাত ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব।
লেখক :মো. রহমত উল্লাহ, শিক্ষার্থী, মাস্টার্স ইন পাবলিক হেলথ, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি