বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশন পাঁচালি - দৈনিকশিক্ষা

বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশন পাঁচালি

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

গত ৯ ডিসেম্বর সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন হয়ে গেল। সমাবর্তন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান। এ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা যারা লেখাপড়া শেষ করে, পাস, অনার্স, মাস্টার্স, এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের যোগ্যতা অর্জন করে, তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে সনদপত্র দেয়া হয়। এ উপলক্ষে অনুষ্ঠানের যারা পৌরহিত্য করেন এবং যারা সনদ অর্জন করেন, তাদের বিশেষ গাউন পরতে হয়। ডিগ্রির স্তরভেদ অনুযায়ী গাউনেরও রকমফের হয়। শিক্ষার্থীদের জন্য কনভোকেশন দিবসটি খুবই আনন্দের ও গৌরবেরও বটে। শিক্ষার্থীরা কনভোকেশন গাউন পরে পিতা-মাতা বা অভিভাবকদের সঙ্গে ছবি তোলে। ছবি তোলা হয় বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গেও। কনভোকেশনের দিনটি জীবনে বারবার আসে না। তবে একাধিকবার আসতে পারে। নির্ভর করে কে কতটা ডিগ্রি অর্জন করল তার ওপর। বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, বাংলাদেশ-উত্তরকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা কনভোকেশনের ব্যাপারে একরকম ভাগ্যবান বলা যায়। সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই কিছু ব্যতিক্রম বাদে নিয়মিত কনভোকেশন হচ্ছে। কিন্তু পাকিস্তান আমলে ১৯৬৪ সালের পর ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই কনভোকেশন হতে পারেনি। ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কার্জন হল প্রাঙ্গণে কনভোকেশন হওয়ার কথা ছিল। এ কনভোকেশনে পৌরহিত্য করার জন্য এসেছিলেন তৎকালীন প্রাদেশিক গভর্নর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর আবদুল মোনায়েম খান। প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ডিগ্রিপ্রাপ্তরা মোনায়েম খানের কাছ থেকে সনদ গ্রহণ করবেন না। কনভোকেশন অনুষ্ঠানটি পণ্ড করে দেয়ারও সিদ্ধান্ত ছিল। কারণ মোনায়েম খান ছিলেন স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকারের প্রতিনিধি। দেশে ছিল না কোনো গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের নামে ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ বলে এক উদ্ভট ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। দেশের শাসন ক্ষমতায় কারা থাকবে সে ব্যাপারে জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের কোনো সুযোগ ছিল না। এ কারণেই একটি কলঙ্কিত শাসনব্যবস্থার প্রতিভূর কাছ থেকে ডিগ্রি সনদের মতো পবিত্র কাগজটি গ্রহণ না করার পক্ষে গণতন্ত্রপন্থী ছাত্ররা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

ওই কনভোকেশন অনুষ্ঠানে ডাকসু ও নির্বাচিত হল সংসদের প্রতিনিধিরা আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। এ ছাত্র প্রতিনিধিদের অধিকাংশই ছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ সমর্থক। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দূরতম কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি নিমন্ত্রিত নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধিরা ট্রয়ের দুর্গে ট্রোজান হর্সের সওয়ারি হবে। মোনায়েম খান বিপুলসংখ্যক পুলিশ পরিবেষ্টিত হয়ে কনভোকেশন মঞ্চে আরোহণ করলেন। কনভোকেশন প্যান্ডেলে ঠিক সেই মুহূর্তে গোলযোগ শুরু হয়ে গেল। নিমন্ত্রিত ৮০-৯০ জন ছাত্র প্রতিনিধি সমস্বরে স্লোগান তুলে বিক্ষোভ প্রদর্শন শুরু করল। কনভোকেশনে অংশগ্রহণকারীদের জন্য নির্ধারিত ফোল্ডিং চেয়ারগুলো ছুড়ে ফেলা হল। একই সময়ে কনভোকেশন মণ্ডপের বাইরে শুরু হল সাধারণ ছাত্রদের বিক্ষোভ। এ বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিলেন ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন সভাপতি মরহুম একে বদরুল হক। বদরুল হক সাহেব পরবর্তীকালে হাইকোর্টের বিচারপতি হয়েছিলেন। বদরুল হক সাহেব প্রিন্সকোট পরে সাধারণ ছাত্রদের বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তার পাশেই ছিল আমার অবস্থান। পুলিশ মুহুর্মুহু টিয়ার গ্যাসের সেল ছুড়ছিল। ছাত্ররা ছুড়ছিল ইট-পাটকেল।

কনভোকেশন মণ্ডপে মরহুম শেখ ফজলুল হক মনি জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়েছিলেন। আমার বন্ধু অধ্যাপক হায়াৎ হোসেন সে সময় ছিলেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সহকারী ক্রীড়া সম্পাদক। সেও কনভোকেশন মণ্ডপের অভ্যন্তরে বিক্ষোভ সংগঠিত করতে খুবই সাহসী উদ্যোগ গ্রহণ করে। একপর্যায়ে সে কনভোকেশন প্যান্ডেলের কাপড়ের বেষ্টনীতে আগুন দিতে উদ্যত হয়। এভাবে কনভোকেশনটি পণ্ড হয়ে যায়। পরদিন দৈনিক সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘লণ্ডভণ্ড পণ্ড মণ্ডপে কনভোকেশন অনুষ্ঠিত’।

কনভোকেশনের দিনই সরকারপন্থী এনএসএফের পান্ডারা যারা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছিল তাদের নানা রকম ক্ষতি সাধন করে। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে আমার বন্ধু হায়াৎ হোসেনের বিছানাপত্র ও বইপত্র আগুন দিয়ে এনএসএফের পান্ডারা জ্বালিয়ে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিক্ষোভকারী ছাত্রদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে। ৪৪ জন ছাত্রকে বিভিন্ন মেয়াদে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। শেখ ফজলুল হক মনি ও আসমত আলী সিকদারের মাস্টার্স ডিগ্রি বাতিল করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এ নির্যাতনমূলক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে একজন নির্যাতিত ছাত্র শেখ জাকির আহমদ হাইকোর্টে রিট মামলা করেন। বিস্ময়ের বিষয় হল, তিনিও পরবর্তীকালে হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হয়েছিলেন। অ্যাডভোকেট সবিতা রঞ্জন পাল, যিনি অ্যাডভোকেট এসআর পাল নামে সমধিক পরিচিত, তিনি এ রিট মামলা পরিচালনা করেন। তিনি যুক্তি হাজির করেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, তারা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। কারণ ন্যায়বিচারের সাধারণ সূত্র হল অভিযুক্তকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তি যাতে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পায় সে জন্য তার ওপর ‘কারণ দর্শাও’ নোটিশ জারি করতে হবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ন্যায়বিচারের এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেনি। হাইকোর্টের রায়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বহিষ্কারাদেশসহ সব শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যায়। এ রায় পাকিস্তানের সুপ্রিমকোর্টও বহাল রাখে। বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে যে মন্তব্যটি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে তা হল, আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের নিগড়ের মধ্যে থেকেও উচ্চ আদালত অনেক ক্ষেত্রেই ন্যায়ের পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পেরেছে। ফলে গণতান্ত্রিক আন্দোলন শক্তি সঞ্চয় করতে পেরেছে এবং এ শক্তিই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব করে তুলেছে। পরিতাপের বিষয়, আজ ভাবা যায় না জনগণের ভোটাধিকার হরণের জন্য যারা দায়ী তারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমাবর্তন উৎসবে হাজির হলে ১৯৬৪ সালের মতো প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মুখোমুখি হবেন। কারণ সময় বদলে গেছে। বদলে গেছে সমসাময়িক কালের শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিভঙ্গি। বদলে গেছে ছাত্র রাজনীতির মহত্তম আদর্শের দৃষ্টান্তগুলো।

১৯৬৪-এর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কনভোকেশন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০-এর মার্চে। তখন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর। এডমিরাল এসএম আহসান ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এবং পদাধিকার বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর। তখন ইয়াহিয়ার সামরিক শাসন চলছিল। তদসত্ত্বেও সে বছর চমৎকারভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনটি হয়ে গেল। বেশ ক’বছর কনভোকেশনহীন থাকার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছত্রছাত্রীরা কনভোকেশনের আনন্দ ফিরে পেল। এমন সুন্দর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল একটি আশাবাদের কারণে। আশাবাদটি ছিল দেশে একটি এক লোক এক ভোটভিত্তিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মানুষ গণতন্ত্রের স্বাদ গ্রহণ করতে পারবে। এ জন্য ছাত্রসমাজ সামরিক শাসন সত্ত্বেও সোৎসাহে কনভোকেশন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। এমন আনন্দঘন পরিবেশের মধ্যে কনভোকেশনের ঠিক আগের দিন আমাকে সামরিক আইনে গ্রেফতার করা হল। আমি ছিলাম পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক এবং ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা। আমার গ্রেফতারের ফলে আমার সংগঠনের কর্মী ও অনুসারীরা প্রচণ্ড বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এরা ছিল একটি বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের মিলিট্যান্ট কর্মী ও সমর্থক। তারা ভাইস চ্যান্সেলর আবু সাঈদ চৌধুরী সাহেবকে সাফ জানিয়ে দিল তারা কনভোকেশন হতে দেবে না। এ পরিস্থিতিতে আবু সাঈদ চৌধুরী সাহেব গভর্নর আহসানকে ফোন করে পরিস্থিতি তুলে ধরলেন। গভর্নর আহসান জানালেন, এ গ্রেফতার সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না। সম্ভবত গ্রেফতারের নির্দেশ এসেছে ইসলামাবাদ থেকে। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত কনভোকেশন নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং আমার ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের সঙ্গে সমঝোতা হল এই শর্তে যে, ভাইস চ্যান্সেলর সাহেব কনভোকেশনে তার বক্তৃতায় আমার মুক্তি দাবি করবেন। তিনি তা করেছিলেনও। বাংলাদেশ-উত্তরকালে তার সঙ্গে আমার অনেকবারই কথা হয়েছে। আমার জন্য তার স্নেহের ঘাটতি ছিল না। তিনি আমাকে বলেছিলেন, তোমার সংগঠনের কর্মীরা খুবই জেদি ও দুঃসাহসী, কিন্তু যুক্তির প্রতিও শ্রদ্ধাশীল। তাই সেদিন সংকট সমাধান করা সম্ভব হয়েছিল। আজ দেশে এমন একজন মহৎ ও জ্ঞানী ভাইস চ্যান্সেলরের অভাব রয়েছে। এমন অনুভূতি প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর তার সভাপতির ভাষণে।

উপাচার্য ও শিক্ষকদের কারও কারও ভূমিকায় দুঃখ প্রকাশ করে রাষ্ট্রপাতি বলেছেন, কোনো কোনো উপাচার্য ও শিক্ষকের কর্মকাণ্ড দেখলে মনে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল কাজ কী তা তারা ভুলে গেছেন। প্রশাসনিক পদ-পদবি পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেক শিক্ষকই নিজের শিক্ষক পরিচয় ভুলে যান। রাষ্ট্রপতি অত্যন্ত হক কথা বলেছেন। একজন শিক্ষকের জন্য শিক্ষক ছাড়া আজ কোনো পরিচয় কি বড় হতে পারে? চীনের নেতা মাও জে দংকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, নিজের সম্পর্কে কোন পরিচয় দিতে আপনি আনন্দবোধ করেন? তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে বলেছিলেন, শিক্ষক পরিচয়টি আমার কাছে সবচেয়ে বড় পরিচয়। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় তাকে বলা হতো Great Teacher, Great Leader and Great Helmsman। এই তিন পরিচয়ের মধ্যে তিন Teacher পরিচয়টি সর্বোত্তম বিবেচনা করেছিলেন, তাও আবার Great teacher নয়। মাও জে দং প্রথম জীবনে শিক্ষকতা করেছেন এবং বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে কাজ করেছেন। এখন যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে বিভিন্ন পদ অলঙ্কৃত করেন তারা মাও জে দংয়ের এ উক্তির সঙ্গে আদৌ পরিচিত কিনা সন্দেহ জাগে। রাষ্ট্রপতি আরও বলেছেন, অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এখন দিনে সরকারি ও রাতে বেসরকারি চরিত্র ধারণ করে। এমন মন্তব্য করে রাষ্ট্রপতি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এখন ডিপার্টমেন্ট, ইভিনিং কোর্স, ডিপ্লোমা কোর্স ও ইন্সটিটিউটের ছড়াছড়ি। নিয়মিত কোর্স ছাড়াও এসব বাণিজ্যিক কোর্সের মাধ্যমে প্রতি বছর হাজার হাজার গ্রাজুয়েট বের হচ্ছেন। এসব ডিগ্রি অর্জন করে শিক্ষার্থীরা কতটুকু লাভবান হচ্ছেন, এ ব্যাপারে প্রশ্ন থাকলেও একশ্রেণির শিক্ষক কিন্তু ঠিকই লাভবান হচ্ছেন। তারা নিয়মিত নগদ সুবিধা পাচ্ছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করছেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশের পাশাপাশি সার্বিক পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সন্ধ্যায় মেলায় পরিণত হয়। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আবার কিছু শিক্ষক আছেন, যারা নিয়মিত কোর্সের ব্যাপারে অনেকটা উদাসীন। কিন্তু ইভিনিং কোর্স, ডিপ্লোমা কোর্স ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয়ার ক্ষেত্রে তারা খুবই সিরিয়াস! কারণ এগুলোয় নগদ প্রাপ্তি আছে।

মহামান্য রাষ্ট্রপতি অন্যায় কিছু বলেননি। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এমন হাল কেন হল তার জন্য রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের কি কোনো দায়-দায়িত্ব নেই? বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এ ব্যাপারে কী ভূমিকা পালন করেছে? নতুন ডিপার্টমেন্ট খুলতে হলে মঞ্জুরি কমিশনের অনুমতির প্রয়োজন হয়। তাহলে নতুন নতুন ডিপার্টমেন্ট কী করে খোলা হচ্ছে? আসল কথা হল, দল ভারি করার জন্য নতুন ডিপার্টমেন্ট করে দলান্ধদের চাকরির ব্যবস্থা করা হবে এবং শিক্ষকের পরিবর্তে ভোটার রিক্রুট করা হবে। আমাদের মতো দেশের অনেক অনিয়ম-বেনিয়মের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবই দায়ী। এখানে দেশের কল্যাণ নয়, গদির কল্যাণের কথাই ভাবা হয়। এ রকম পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীনদের লক্ষ্য হয় প্রতিষ্ঠানগুলো দখল করা। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় Institutional Capture। এই Capture শুধু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ঘটছে এমন নয়। রাষ্ট্রের সব শাখা-প্রশাখা ও প্রতিষ্ঠানেও ঘটছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে যখন রাজনৈতিক দখলবাজির মতো ঘটনা ঘটে তখন তা রাষ্ট্রের জন্য দীর্ঘমেয়াদি মহাবিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

রাষ্ট্রপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ধ্যার পর মেলা বসার ব্যাপারে অনুযোগ করেছেন। যদি জ্ঞানচর্চার জন্য মেলা বসে তাহলে আপত্তির কারণ দেখি না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে রাত ৯টা-১০টা অবধি ক্লাস হয় এবং লাইব্রেরি ও ক্যাফেটেরিয়া সারা রাত খোলা থাকে। সেটাও তো এক ধরনের মেলার মতো। কিন্তু রাষ্ট্রপতি সন্ধ্যার পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে মেলার প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন তাতে জ্ঞানচর্চার উপাদান অনেকটাই অনুপস্থিত বলে তিনি তার উষ্মা প্রকাশ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অতিরিক্ত কোর্স চালু হওয়ার মধ্যে নীতিগতভাবে অন্যায় কিছু আছে মনে করার কারণ নেই। তবে শর্ত থাকে যে, এগুলো আর্থিক নিয়মাচার ভঙ্গ করে করা হবে না এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজকে লঘু করে দেবে না। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই এ রকম ব্যবস্থা আছে। এসব প্রাতিষ্ঠানিক উদ্ভাবনার পেছনে মূলত কাজ করেছে সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আর্থিক সঙ্গতিতে দুর্বলতা। কারণ থেচারাইট অর্থনৈতিক নীতির প্রভাবে ব্রিটেনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য সরকারি মঞ্জুরি হ্রাস পাওয়ার ফলে গবেষণার জন্য অর্থ এবং শিক্ষকদের বেতন-ভাতার অর্থ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে ব্রিটেনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিভিন্ন কর্পোরেট হাউসের সঙ্গে গবেষণা সহযোগিতা এবং বাজারের চাহিদানুযায়ী নতুন নতুন কোর্স চালু করেছে। এর মাধ্যমে যে অর্থ উপার্জিত হয় তার যৌক্তিক ব্যবহারও নিশ্চিত করা হয়েছে। অনেক সময় কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে নতুন কিছু উপসর্গ যোগ হয় রাষ্ট্রীয় নীতির কারণে। এর জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়ী করা সঠিক নয়।

রাষ্ট্রপতি দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া অমানবিক ও অনভিপ্রেত ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এগুলোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেমন দায় এড়াতে পারে না, তেমনি সরকারও দায় এড়াতে পারে না। যে রাজনৈতিক পরিবেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলররা ‘ভাইস’ চ্যান্সেলর হয়ে পড়েন তাতে অধঃপতন ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়ে। পরের ‘ভাইস’ কথাটির অর্থ অভিধান অনুযায়ী পাপ, দোষ, খুঁত, অধর্ম, অনাচার, ব্যভিচার, ব্যাধি, ব্যাসন, কু-অভ্যাস ইত্যাদি। তবে কি এ দেশের কোনো কোনো ভাইস চ্যান্সেলর ‘ভাইস’ চ্যান্সেলর হয়ে গেছেন? তাহলে তো মহাসর্বনাশ! তারপরও বলব, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনও অনেক নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক আছেন। তাদের সম্মান ও মর্যাদা দিতে হবে, পদ-পদবি নয়।

লেখক:  ড. মাহবুব উল্লাহ,  শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0086381435394287