ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন ৯৭ বয়সী। আর তিন বছর পর হবে শতবর্ষী। এই হিসেবে এ উপমহাদেশের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি। এ বিশ্ববিদ্যালয়ই জন্ম দিয়েছিল অনেক বিপ্লবী দেশপ্রেমিক সত্তাকে। এ বিশ্ববিদ্যালয়েই ছিল সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আধার। এমনকি বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি স্বাধীনতা লাভের পেছনে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গর্বের। যার কারণে ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী টার্গেট করেছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়কে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচটি আবাসিক হলে এবং শিক্ষক কোয়ার্টারে তারা আক্রমণ করেছিল। এক একটি বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রের একটি বড় শক্তি। রাষ্ট্র সেই শক্তির ওপর কোনো না কোনোভাবে ভর করে। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তৈরি হয়েছিল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন। রাউফন বসুনিয়া, দীপালি সংঘ প্রাণ দিয়েছিলেন গণতন্ত্রের জন্য, একটি মানবিক সমাজের জন্য। তাদের গুলি করে মারা হয়েছে, তখন আমরা বলেছি, ‘এগুলো স্বৈরাচার সরকার করছে, কারণ তিনি গণতন্ত্র চান না।’ কিন্তু এই গণতন্ত্রের দাবিদার দুই দল ক্ষমতায় আসার পরও বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতন্ত্র আসেনি। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, দেশ স্বাধীনের পর দেশের চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ’৭৩-এর অধ্যাদেশের আওতায় আসে আর এ চারটিই হলো স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়। এ লেখার মূল জায়গা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন এবং একটি মানবিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি।
এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এমন বললে ভুল হবে, কয়েক দশক ধরেই কমবেশি এ চর্চা চলছে। এখন কোনো আন্দোলন হলেই আমরা ভয় পাই, সেটি সরকারবিরোধী কিনা, প্রশাসনবিরোধী কিনা সেটা মাপার চেষ্টা করি, হরহামেশাই ‘জামাত’ বলে ট্যাগ দিই, শুধু সেখানেই থেমে থাকি না সে আন্দোলনকে দমানো, মোচড়ানো এবং রোখার চেষ্টা করি। আন্দোলনকে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অস্থিরতা’ তত্ত্ব দিই, কারণ এখন রাষ্ট্রের শক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন। এখন আর ‘সাধারণ’ শিক্ষার্থীদের ততটা দাম নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ইতিহাস যদি আমরা দেখি, তা হলে সব সময় আমরা দেখব তারা কখনো রাষ্ট্রের আনুগত্য স্বীকার করেনি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জানত যদি রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ থাকে, তা হলে বিশ্ববিদ্যালয় তার স্বকীয়তা হারাবে। কোনো আদর্শ, বর্ণ, জাতীয়তা, মতবাদের ঊর্ধ্বে থেকে সর্বদা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এগিয়ে যেতে হবে। যার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন সবচেয়ে বেশি জরুরি।
‘বিশ্ববিদ্যালয়’ ও ‘স্বায়ত্তশাসন’ এগুলো খুবই ঘনিষ্ঠ শব্দ, অন্তত বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা চিন্তা করলে সেখান দেখা যাবে যে, স্বায়ত্তশাসনের বিকল্প নেই। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ করি, তা হলে আমরা দেখতে পাব যে এখান থেকে শিক্ষার্থীরা কী কী নিচ্ছে। শুধু শিক্ষা এবং গবেষণাই নয়, সে পাবে চিন্তার মুক্তি, যুক্তির মুক্তি, তর্কের পরিবেশ। সে নিয়োজিত থাকবে প্রতিদিনই নিজেকে আবিষ্কারের নেশায়। কিন্তু আমরা দেখি একজন শিক্ষার্থী যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে তার প্রথম চেষ্টা থাকে একটি থাকার জায়গার। সেখানে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতা। ছেলেদের হলের দখল তিন দশক ধরেই আছে ক্ষমতাসীন সংগঠনের হাতে। তাই সাধারণ শিক্ষার্থীরা সিট পায় না। তখন তাকে রাজনৈতিক সংগঠনের ছত্রছায়ায় হলে উঠতে হয়। আর তখন থেকেই সে এক ধরনের রাজনৈতিক দাস বানানো হয়। তখন থেকেই শুরু হয় ভয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা। আর কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে র্যাগিং। বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবনের রোমান্টিক স্বপ্ন সেখানেই শেষ। ফলে একটি শিক্ষার্থীর কাছে বিশ্ববিদ্যালয় আর সেভাবে হয়ে ওঠে না। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল জায়গাই হলো শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মননশীলতা বৃদ্ধি, সংস্কৃতির বিস্তার, ব্যক্তিত্ব তৈরি, চেতনাবোধ জাগ্রত করা, অধিকার সচেতন হওয়া এবং সর্বোপরি মানবিক গুণাবলি শানিত করা। সেদিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমরা যারা যুক্ত আছি, তাদের ওপর দায়িত্ব বর্তায় শিক্ষার্থীর জন্য সেই ধরনের মানবিক পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে তারা যথাথভাবে স্বায়ত্তশাসন ধারণাটিকে কাজে লাগাতে পারবে এবং চেতনাগুলোকে ছেনে নিতে পারবে।
রাষ্ট্র থেকে তবে কি বিশ্ববিদ্যালয় বিচ্ছিন্ন থাকবে? ক্ষমতা নিয়ে যখন এত কথা, তখন এ প্রশ্ন মনে আসা খুবই স্বাভাবিক। আমরা ইউরোপের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখি যে, গির্জাশাসিত সামন্ততান্ত্রিক ইউরোপে যখন গির্জার পোপরা ক্ষমতাকে সম্পূর্ণভাবে নিজেদের হস্তগত করতে থাকে, ঠিক সেই সময়কালে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সৃষ্টি হতে থাকে এই সম্পর্কগুলো জানা এবং চ্যালেঞ্জ করার তাগাদা নিয়ে। ইংল্যান্ডের প্রথম দিকের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে গির্জা এবং পোপের একচ্ছত্র ক্ষমতাকে চ্যালঞ্জ করাই ছিল মূল উদ্দেশ্যগুলোর অন্যতম।
স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে, এর মধ্যে অক্সফোর্র্ড বিশ্ববিদ্যালয় মেজাজের দিক থেকে ছিল প্রথম থেকেই ভিন্ন। অক্সফোর্ড প্রথম থেকেই গির্জার হস্তক্ষেপ নিয়ে সবচেয়ে বেশি সচেতন ছিল। তারা একটি নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্র প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিল, যেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা এই চরিত্র রক্ষায় সচেষ্ট ছিল। রাষ্ট্রীয় কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করতে এলে তারা সমন্বিতভাবে এর প্রতিবাদ করত, এমনকি অক্সফোর্ডে কয়েক দফা মারামারি পর্যন্ত হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের প্রতিবাদস্বরূপ শহর ছেড়ে নির্জন কোনো স্থানে গিয়ে শিক্ষায়তন স্থাপনের হুমকিও দিয়েছিল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অবস্থা যখন এই রকম, তখন এগিয়ে আসেন রাজা তৃতীয় হেনরি। তিনি তার রাজ্য পরিচালনা কর্মপর্ষদকে সরাসরি নির্দেশ দেন, কোনোভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর কোনো রকম হস্তক্ষেপ না করা হয়। এসব আমাদের সবই জানা, তবে মানা হয়নি আর কী!
এটি সহজেই অনুমেয় যে, একটি গণতান্ত্রিক দেশের রাষ্ট্রনীতির সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দ্বন্দ্ব, তর্কাতর্কি লেগে থাকাই স্বাভাবিক। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় তো আর সীমাবদ্ধ কাঠামো নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈতিক চরিত্র কখনো রাষ্ট্রীয় চরিত্রের সঙ্গে মেলে না। তাই সেখানে বনিবনার পরিসর খুবই সীমিত। রাষ্ট্রের দাপুটে শাসন কখনো বিশ্ববিদ্যালয় মেনে নেওয়ার কথা না। আর এই মাথা নত না করার মেজাজকে সম্বল করেই আমরা একে একে পার হয়েছি বায়ান্ন-একাত্তরের মতো লড়াইয়ে জেতা সময়গুলো। তাই নিঃসন্দেহে এবং নিঃসঙ্কোচে বলা যায়, যদি রাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাষ্ট্রের তাঁবেদারি করে তা হলে বুঝতেই হবে সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো মেজাজ নেই, আছে মাথা নত করার চুক্তি।
লেখার প্রথমাংশেই উল্লেখ করেছিলাম, ১৯৭৩ সালে দেশের চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয়েছিল। ‘১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ’ স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন বলে মনে করা হয়। এর কল্যাণে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পেয়েছে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা। এই অধ্যাদেশ ছিল একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর বড় ধরনের রাজনৈতিক ভাবণা। এই অধ্যাদেশের অধীনে থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নির্দিষ্ট বাস্তবতায় নিজেদের মতো করে নীতি প্রণয়নের দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল, সিন্ডিকেট ও সিনেটের। সিনেট অবশ্য এখন সব বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই, বিশেষ করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নেই। যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সিনেট নেই, সেখানে সিন্ডিকেট সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি প্রণয়নের এই সর্বোচ্চ বডিগুলোয় সরকারের প্রতিনিধিত্ব থাকে এবং সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিছুটা হলেও সরকারি নজরদারিতে থাকে।
এখন প্রসঙ্গ হলো যখন এই স্বায়ত্তশাতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আমরা মানবিক পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ হই, তখন আসলে কী দাঁড়ায়? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনিক ব্যক্তিরা যখন ক্ষমতাসীন দলের কর্তাব্যক্তি হন এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক একভাবে অবিচ্ছেদ্য হয়ে ওঠে, দল বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রণ করে, দল সর্বস্ব হয়ে ওঠে, তখন পরিস্থিতি আর স্বায়ত্তশাসনের অনুকূলে থাকে না। তখন সেটি হয়ে যায় দলীয় বিশ্ববিদ্যালয়। তিন দশক ধরে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা এ রকমই। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারের পতন হয়ে দেশে গণতন্ত্র এলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আটকে গেছে দলীয় গহ্বরে। যার কারণে যে কোনো আন্দোলন শুরু হলেও ক্ষমতাসীন সংগঠনের মাধ্যমে সেগুলো ‘ট্যাকল‘ করা হয় এবং তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের প্রচ্ছন্ন আশকারা থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের মেজাজ হারিয়ে ফেলা আদর্শিকভাবে আমাদের বড় পরাজয়।
লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: আমাদের সময়