বেপরোয়া কৈশোর, থামাবে কে? - দৈনিকশিক্ষা

বেপরোয়া কৈশোর, থামাবে কে?

পলাশ রায় |

রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর তাঁর ‘ছুটি’ গল্পে বারো তের বছরের ছেলেদের ‘বালাই’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন । আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় হাড়ে হাড়ে এখন তা টের পেতে হচ্ছে নাগরিক সমাজকে। অপ্রতিরোধ্য বললে ভুল হবে, বেপরোয়া হয়ে ওঠছে ছেলেদের জন্য কৈশোরের এ সময়টা। মেয়েদের ক্ষেত্রেও কম বেশি দেখা যাচ্ছে। ঘটছে মানবিক বিপর্যয়, নষ্ট হচ্ছে সমাজ ব্যবস্থা। সবচে বড় কথা, এভাবে চলতে থাকলে জনসংখ্যা বাড়তে থাকবে। কিন্তু রাষ্ট্র হারাবে সুনাগরিক। সকল উন্নয়ন হবে নিষ্ফল।

দেশের দক্ষিণ জনপদের এক ছোট্ট জেলা শহরের বাসিন্দা আমি। জীবিকার ব্যস্ততায় অনেক সময় পথে ঘাটে বা চা পানের দোকানে আড্ডা দেয়ার সময় হয় না। সেদিন সময় করে বের হলাম প্রিয় শহর ঝালকাঠির সুগন্ধা পাড়ে। মনোরম পরিবেশে শান্ত নদীটির পাশেই সেখানে পৌর কর্তৃপক্ষ একটি পার্ক নির্মাণ করেছে ক’বছর আগে। সকাল বিকেল এমনকী রাতেও শহরবাসী সেখানে ভীড় করেন। পরিচিতদের সঙ্গে দেখা হবে ভেবে আমিও গেলাম একদিন। কিন্তু একরাশ হতাশা আর বিষন্নতা নিয়ে ফিরতে হলো ঘরে।

কলেজ জীবনে এক সময় আড্ডা দিতাম ফিরোজ ভাইয়ের ওই চায়ের দোকানে। সেখানেই প্রথম বসলাম। কিন্তু ফিরোজ ভাইয়ের স্থলে ক্যাশ টেবিলে ছোট্ট এক কিশোর বসা। আমি তাকে চিনতে না পারলেও সে ঠিকই চিনে নলল আমাকে। জানলাম ফিরোজ তার বাবা। আর এর মধ্যেই পরপর তিনটি মোটর সাইকেল এসে দোকানটির সামনে থামে। ক্ষিপ্র গতির মোটর সাইকেল থামতেই যেন রাস্তাও কেঁপে ওঠে। পাশের দোকান থেকে সিগারেট কিনে নিয়ে আবার উড়ন্ত গতিতে ছুটল তিন কিশোর চালক। পেছনে একজন করে আরও তিন জন। বয়সটা ওদের একবারেই কম দাড়ি গোঁফের দাগও দেখা যায়নি। তাই একটু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওদের চলে যাওয়া দেখছিলাম। আর মনের অজান্তেই একটু আওয়াজ করেই বলে ফেলাম-বড়জোড় একাদশ-দ্বাদশের ছাত্র এখনই মোটর সাইকেল প্রয়োজন হলো! কথা শেষ করার আগেই অনেকটা বিরহের সুরেই আঞ্চলিক শব্দ উচ্চারণে ফিরোজ ভাইয়ের ছেলেটি বলে ফেলল, ‘কাকা ওরা আমার লগেই টেনে পড়ে।’
সিরাজ নামের দশম শ্রেণিতে পড়া এ ছেলেটির সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে আমার বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না দরিদ্র বাবার কাছে তারও এমন একটি মোটর সাইকেলের আবদার রয়েছে। অপূর্ণতায় তার সীমাহীন ক্ষোভ। শিশুরা সমাজ থেকে শিক্ষা নেবে, চারপাশের সংস্কৃতি তাকে উৎসাহিত করবে এটাই স্বাভাবিক। হোক তা যতোটা মন্দ সংস্কৃতির।

বালিকা বিদ্যালয়, মহিলা কলেজ আর টেকনিকাল কলেজ ও সরকারি হাই স্কুলের পথ ধরে পার্কটি। সকাল-দুপর, সন্ধ্যা কিংবা রাত- রাস্তাটি দিয়ে পথ চলতে চোখে পড়বে একদল কিশোর। সড়ক ও আশপাশের দোকানপাঠ কিংবা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বারান্দা প্রায় ওদের দখলে থাকে। এক বন্ধু জানাল, এসব এলাকায় চায়ের দোকানগুলোতে বসতে রীতিমত ভয় লাগে তার। আড্ডায় থাকা কিশোরদের অশ্রাব্য বাক্যালাপে সম্মান নিয়ে বাসার জো থাকে না। দোকানপাট তো দূরে থাক, রাস্তা চলার সময় এসব কিশোরের দল নাকি নারীদেরও না দেখার ভান করে অশ্রাব্য সংলাপেই কথা বলে যায়। আর সড়কটিতে কিশোর চালকদের মোটর সাইকেলের গতি সব সময়েই ক্ষিপ্রতায় থাকে নারী শিক্ষার্থীদের মনোযোগ কাড়তে। কিশোরী মেয়েরাও হয়ত হিন্দি সিনেমার মত তার স্বপ্নের নায়ককে এ মিছিল থেকে খুঁজে ফেরে।

যাহোক তারপর বাড়ি ফিরছিলাম। পথে স্কুল শিক্ষক ফয়সাল রহমান জসীমের সঙ্গে দেখা। এক দুর্ঘটনায় পা হারিয়ে হুইল চেয়ার তার নিত্যসঙ্গী। এক সহকর্মীকে নিয়ে স্কুলের পথ থেকে তিনিও হয়ত বাড়ি ফিরছিলেন। অনেক কথার এক পর্যায় বললেন অষ্টম শ্রেণি থেকে স্কুলের ক্লাস নেয়া অনেক ক্ষেত্রে ভীতিকর হয়ে পড়েছে শিক্ষকদের জন্য। শোনালেন অবাক হওয়ার মত আরও কিছু কথা। শিক্ষককে ছাত্রদের বিরুদ্ধে থানায় সাধারণ ডায়েরি করে পাঠদান করতে যাওয়ার মত অবস্থাও তৈরি হয়েছে এখন। তবে তা বাস্তবে সম্ভব হচ্ছে না বলেই অনেক ক্ষেত্রে স্কুলের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের খোঁজ খবর রাখা ছেড়ে দিয়েছেন।

তবে ছেলে মেয়েদের খোঁজ খবর কে নেবেন আজ? রাষ্ট্র আধুনিক হওয়ায় শিক্ষকদের দায়িত্ব অনেকটা কমে গেছে। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে এখন আর শিক্ষককে কিছু দেয়ার নেই তার শিক্ষার্থীদের। খুব ভাল শিক্ষকও এখন পাঠ্যপুস্তকের পড়ার রুটিন ছাড়া আর কিছু নিয়ে আলোচনা করে বিপাকে পড়তে চান না ক্লাস রুমে। যেখানে অভিভাবক উদাসীন, সেখানে শিক্ষক কেন বাড়তি দায়িত্ব পালন করতে যাবেন। আর সবচে বড় কথা, আমাদের দেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় নীতি আদর্শের পাঠ উঠে গেছে। শিক্ষকের মর্যাদা, আলী এ্যান্ড দ্যা বুল, বকুলপুরের স্বাধীনতা কিংবা শরৎ বাবুর মহেষের মত হৃদয়গ্রাহী বা মানবিক শিক্ষা পাওয়ার মত গল্প-কবিতা পাঠ্য থেকে উঠে গেছে।

 

পারিবারিক নীতি আদর্শের শিক্ষাও নেই বললেই চলে। অর্থ উপার্জনের অসম প্রতিযোগিতায় মানুষ হয়ে গেছে যান্ত্রিক। তাই শিশুরা শিক্ষা নেবে কোথায়, এটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। শহর কিংবা গ্রামে বিকেল হলেই গবাদি বা হাঁস মুরগীকে তাড়িয়ে ঘরে আনাতে ছুটোছুটি পড়ে যায় গৃহস্থের । কিন্তু নিজের সন্তান বাড়ি ফিরছে না কেন সেটা দেখার সময় নেই অভিভাবকের। কার বা কাদের সঙ্গে সন্তান মিশছে সে খবর রাখার প্রয়োজন হচ্ছে না অভিভাবকের। অনেক ক্ষেত্রে বেপরোয়া সন্তানকে অভিভাবক সামাজিক নিরাপত্তায় সম্পদ হিসেবেও মনে করছেন। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে জাতি হারাবে সব। মেধাহীন জাতির সঙ্গে অমানবিক জনগোষ্ঠিতে নাগরিক সমাজ নিয়ে রাষ্ট্রকে চলতে হবে, যা কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না।

লেখক: সাংবাদিক ও লেখক।
[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন]

দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0035510063171387