সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ছুটির তালিকা ও শিক্ষাপঞ্জি এবং ক্লাস রুটিনে কিছু সংশোধন এনেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। ছুটিতে কোনো পরিবর্তন আনা না হলেও তালিকায় উল্লেখিত সময়সূচিতে শুধুমাত্র বৃহস্পতিবার দিনের দুই শিফটের বিদ্যালয়ের পাঠদানের সময় ৩০ মিনিট কমানো হয়েছে। তবে, সংশোধিত রুটিনেও এক শিফটের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদানের সময় ৯টা হতে ৩টা ১৫ মিনিট এবং ২ শিফটের বিদ্যালয়ের পাঠদানের সময় ৯টা হতে ৪টা পর্যন্ত বহাল আছে। তাই, ছুটির তালিকা সংশোধন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষকরা। শিক্ষকদের মতে, পাঠদানের সময় নিয়ে ওঠা বৈষম্যের অভিযোগের বিষয়টি রুটিন সংশোধনের সময় আমলে নেয়নি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে রোববার (৫ জানুয়ারি) সংশোধিত ছুটির তালিকা ও ক্লাস রুটিন মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়। সংশোধিত তালিকাতেও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে ৮৫ দিন ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
এর আগে, গত ২৬ ডিসেম্বর ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছুটির তালিকা ও পাঠদানের সময়সূচি অনুমোদন দেয়া হয়। প্রকাশিত তালিকায় বিদ্যালয়ের ছুটি আগের চেয়ে ১০ দিন বাড়িয়ে ৮৫ দিন করা হয়েছে। একইসাথে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদানের সময় নির্ধারণ করা হয়। ছুটির তালিকায় এক শিফটের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদানের সময় ৯টা হতে ৩টা ১৫ মিনিট এবং ২ শিফটের বিদ্যালয়ের পাঠদানের ৯টা হতে ৪টা পর্যন্ত করা হয়েছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুই রকম পাঠদানের সময় নির্ধারণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেন শিক্ষকরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও পাঠদানের সময় দুই রকম করার বিষয়টি সমালোচিত হয়েছে। একইসাথে সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদানের সময় সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৩টা করার দাবি তুলেন শিক্ষকরা।
গত ৫ জানুয়ারি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছে সংশোধিত ছুটির তালিকা ও ক্লাস রুটিন পাঠানো হয়। সংশোধিত ক্লাস রুটিন অনুযায়ী, ২০২০ শিক্ষাবর্ষে এক শিফটের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কার্যক্রম সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩ টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত ও দুই শিফটের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কার্যক্রম সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত পরিচালিত হবে। তবে, প্রতি বৃহস্পতিবার এক শিফটের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কার্যক্রম সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা ২৫ মিনিট পর্যন্ত ও দুই শিফটের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কার্যক্রম সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত পরিচালিত হবে। সে প্রেক্ষিতে বলা যায়, রুটিন সংশোধনের সময় শিক্ষকদের পক্ষ থেকে ওঠা এক শিফট ও দুই শিফটের স্কুলের একই পাঠদানের সময় নির্ধারণের দাবি আমলেই নেয়নি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টরা।
নির্ধারিত পাঠদানের সময় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষকরা। তাদের মতে, একই সাথে নিয়োগ পেয়ে ও একই স্কেলে বেতন পেলেও কেউ ৩টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত কাজ করবে, আবার কাউকে ৪টা পর্যন্ত কাজ করতে হবে যা মেনে নেয়া যায় না। এটা কি বৈষম্য নয়? প্রশ্ন তোলেন তারা। তারা বলেন, পাঠদানের সময় নিয়ে প্রশ্ন তোলার পর রুটিন সংশোধন হল। কিন্তু দুই শিফটের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শুধুমাত্র বৃহস্পতিবারের পাঠদানের সময় ৩০ মিনিট কমানো হয়েছে। যা প্রহসন। বাকি দিনগুলোতে দুই শিফটের স্কুলগুলোর শিক্ষকদের ৪৫ মিনিট বেশি কাজ করতে হবে।
শিক্ষকরা বলেন, মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষকদের বৈষম্যে রাখা যাবে না। শিক্ষকরা এখনো তাদের কাঙ্ক্ষিত বেতন পায়নি। শিক্ষকরা আরও বলেন, একই গ্রেডে বেতন পেয়ে কোন শিক্ষক ৩টা ১৫ মিনিটে কাজ শেষ করবেন কেউ বিকেল ৪টায়। এটা অবশ্যই বৈষম্য। আর ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের বিকেল ৪টা পর্যন্ত স্কুলে রাখাও শিক্ষকদের জন্য চ্যালেঞ্জিং।
শিক্ষকরা আরও বলেন, সরকার শিশুদের পড়ার চাপ কমিয়ে খেলাধুলার মাধ্যমে আনন্দময় শিক্ষার কথা বলছে। অপরদিকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট সময়সূচি বিকেল ৪টা পর্যন্ত করছে। যেখানে সর্বমহল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা তথা শিক্ষার বৈষম্য দূর করতে বলা হয়েছে। কিন্তু গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কিছু কর্মকর্তা এ ধরনের বৈষম্য বারবার সৃষ্টি করে শিক্ষকদের দুই বা ততোধিক ভাগে বিভক্ত করার অপচেষ্টা করছে।
প্রাথমিকের এই বৈষম্যমূলক সময়সূচি বাতিলের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি। সমিতির সভাপতি আতিকুর রহমান আতিক দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদানের সময় সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত করার দাবি জানাচ্ছি। একই দেশে একই সাথে নিয়োগ পেয়ে কেউ ৯টা থেকে ৩টা পর্যন্ত কাজ করবে, আবার কেউ ৯টা থেকে ৪টা পর্যন্ত কাজ করবে তা মেনে নেয়া যায় না। এ সময়সূচি পরিবর্তন বা বাতিল করে বৈষম্য দূর করা না হলে প্রাথমিকের সময়সূচি পরিবর্তনের দাবিতেও আন্দোলনে নামবে শিক্ষকরা।
এদিকে প্রাথমিক দুই রকম সময় সূচি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন প্রবীণ শিক্ষক নেতা ও বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদের সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান। তিনি দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বৈষম্য পছন্দ করতেন না। তিনি সারাজীবন বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। প্রাথমিক শিক্ষায় বৈষম্য দূর করতে বর্তমান সরকার বদ্ধ পরিকর। তবুও, প্রাথমিক শিক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করলে দেখা যায় অনেকটা প্রাথমিক শিক্ষায় বৈষম্য সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের যেসব কর্মকর্তা এভাবে বারবার বৈষম্য সৃষ্টি করে সরকারের ভাবমূর্তি বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করছেন, তাদের চিহ্নিত করতে হবে।
এদিকে প্রাথমিকের পাঠদানের সময় কমানোর দাবি জানিয়েছেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সমিতির নেতারা। গত ২৮ ডিসেম্বর আয়োজিত এক সভায় সমিতির শিক্ষক নেতরা বলেন, বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় সকাল ৯টা থেকে। আর শেষ হয় বিকাল সোয়া ৪টায়। বিদ্যালয়ে পাঠদানের সময় বেশি হওয়ায় কোমলমতি শিশুদের বেশি সময়ে বিদ্যালয়ে ধরে রাখা যায় না। ফলে দিন দিন শিক্ষার্থী সংখ্যা কমে যাচ্ছে। তাই, বিদ্যালয়ের পাঠদানের সময় সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত করার জন্য কর্তৃপক্ষের প্রতি জোর দাবি জানান শিক্ষক নেতারা।
নতুন এই সময়সূচি নিয়ে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে। কেউ কেউ এই সূচিতে খুশি হলেও অধিকাংশই খুশি নন। অভিভাবকদের দাবি, প্রাথমিক বিদ্যালয় হচ্ছে কোমলমতি শিশুদের জন্য আর এখানে এই শিশুদের যদি এই সময়সূচির মধ্যে বিদ্যালয়ে আবদ্ধ করে রাখা হয় তাহলে তাদের মানসিক বিকাশ ঘটা অসম্ভব। কেননা এই বয়সী শিশুদের বইয়ে আবদ্ধ করে না রেখে খেলাধুলা বিনোদনের মধ্যে রাখলেই বেশি শিখবে এবং মানসিক বিকাশ ঘটবে।
দৈনিক শিক্ষার পাঠকদের জন্য সংশোধিত ছুটির তালিকা ও ক্লাস রুটিন তুলে ধরা হলো।