বৈষম্যহীন এমপিওভুক্তি হোক সকলের প্রত্যাশা - দৈনিকশিক্ষা

বৈষম্যহীন এমপিওভুক্তি হোক সকলের প্রত্যাশা

ভূপেন্দ্র নাথ রায় |

দেশে হাজার হাজার ননএমপিও ও বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিবন্ধিতদের বঞ্চিত করে শিক্ষামন্ত্রণালয় সেকায়েপভুক্ত অতিরিক্ত শ্রেণি শিক্ষকদের (এসিটি) এমপিওভুক্ত করতে যাচ্ছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসিটিদের এমপিওভুক্তি নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। তবে ননএমপিও শিক্ষকদের অভুক্ত এবং শিক্ষক নিবন্ধিতদের বেকার রেখে এই এমপিও জাতির জন্য কতটুকু মঙ্গলকর, তা বিবেচনা করা দরকার। বছরের পর বছর বেতন-ভাতাহীন ননএমপিও শিক্ষকগণ শিক্ষার আলোক বর্তিকা জ্বালিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু নিজের ঘরেই তাদের আলো জ্বালানোর সামর্থ্য নেই। প্রতিটি দিন তাদের লাগামহীন চাহিদার সাথে যুদ্ধ করে চলতে হচ্ছে এমপিওভুক্তির আশায়।

তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেবা দেয়ার পর সংসারের অন্যান্য কাজ আদৌ করতে পারছেন না। বয়স, পরিবার-পরিজনের কারণে পারছেন না অন্য চাকরির সন্ধান করতে। অতঃপর কোন রকমে গিনিপিগের মতো জীবন ধারণ করে সমাজে টিকে থাকতে হচ্ছে। অন্যদিকে শিক্ষক নিবন্ধিতরা শিক্ষক হওয়ার মনোবাসনা নিয়ে তাকিয়ে আছে এনটিআরসিএ'র দিকে।

শিক্ষক নিবন্ধিতদের অনেকেই আর্থিক সংকটের কারণে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এতদিন শিক্ষকতার চাকরি নিতে পারেনি। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির শিক্ষক নিয়োগে একচ্ছত্র ক্ষমতা খর্ব করে বর্তমান সরকার ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ এনটিআরসির হাতে ন্যস্ত করে। তরুণ মেধাবী শিক্ষক নিবন্ধিতরা স্বপ্ন দেখে মেধার ভিত্তিতে শিক্ষক হওয়ার। কিন্তু উপজেলা কোটার কারণে এনটিআরসিএ কতৃক ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের গণবিজ্ঞপ্তিতে সিংহভাগ সনদধারী বঞ্চিত হয়। শুধু তাই নয়, প্রায় পনেরো হাজার পদের বিপরীতে এনটিআরসিএ মাত্র সাত হাজার নিবন্ধন সনদধারীকে নিয়োগ দিতে সক্ষম হয়। 

এনটিআরসিএ'র জগাখিচুড়ি মেধাতালিকা থেকে ঝরে পড়ে প্রায় আট হাজার নিবন্ধন সনদধারী। এরপর মামলার কারণে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়োগ আরো দুই বছর স্থগিত থাকার পর হাইকোর্টের নির্দেশনায় চলতি বছর নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু হলেও এনটিআরসিএ ই-রিকুইজিশন ও মেধাতালিকা তৈরি ছাড়া কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। বরং চেয়ারম্যান নিয়োগের নাটকীয়তায় ক'মাস অতিবাহিত হলেও আজ পর্যন্ত বদলিকৃত দুই কর্মকর্তার কেউই যোগদান করেনি। ফলে নিয়োগ ব্যবস্থা চালু হলেও এনটিআরসিএ'র কার্যক্রমে অচলাবস্থা কাটিয়ে ওঠেনি। অন্যদিকে বেশির ভাগ ৩৫ বয়সী শিক্ষক নিবন্ধিত এমপিও নীতিমালা/১৮ এর আলোকে বয়স নির্ধারণের শংকায় আতঙ্কিত। এদিকে ননএমপিও প্রতিষ্ঠানগুলোর এমপিওভুক্তিকরণেও কোন অগ্রগতি নেই। অথচ সেকায়েপ প্রকল্পের পাঁচহাজার দুইশো অতিরিক্ত শিক্ষকের এমপিও নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে গেছে। ননএমপিও শিক্ষকদের রেখে এসিটি প্রকল্পের শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির উদ্যোগ শিক্ষিত বেকারদের মাঝে সমসুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে বৈষম্যের সৃষ্টি করেছে।
জানা গেছে, এসিটিদের কিছু সংখ্যক দারুল ইহসানসহ কিছু অখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদধারী। ধারণা করা হচ্ছে, এ কারণেই গত ২৮ আগস্ট শিক্ষামন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের বেসরকারি মাধ্যমিক-৩ শাখার উপসচিব কামরুল হাসান উচ্চ আদালতের আদেশ মোতাবেক দারুল ইহসানের সনদ গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে স্কুল ও কলেজ ব্যবস্থাপনা কমিটির সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত করার স্বাক্ষরিত আদেশ প্রদান করেন। সাধারণের মনে প্রশ্ন জাগে, অনৈতিক কাজের বৈধতা দিতে এ উদ্যোগ নয়তো আবার?
এনটিআরসিএ গত ২৮ জুলাই শিক্ষামন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি প্রেরণ করে। নতুন প্রতিষ্ঠানে পাঠদান অনুমতির জন্য অবশ্যই নিবন্ধিত শিক্ষক থাকতে হবে মর্মে অবগত করা হয়। অনিবন্ধিত কেউ শিক্ষক হওয়ার যোগ্য হতে পারেন না। এই সূত্র ধরে বলা যায়, এসিটিদের পঞ্চাশোর্ধ নম্বর থাকলেও অনেকে আছেন যাদের শিক্ষক নিবন্ধন নেই। তাহলে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কীভাবে নীতিমালা/আইন ভঙ্গ করে অনিবন্ধিত কাউকে শিক্ষক হিসেবে এমপিও'র সুপারিশ করতে পারেন? দেশের সর্বোচ্চ ব্যক্তি মহামান্য রাষ্ট্রপতিও নিয়ম নীতির বাইরে গিয়ে কাজ করতে পারেন না। তাহলে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়ে কীভাবে এরকম অনিয়ম করতে পারেন? আর সেখানে একজন প্রজ্ঞাবান মন্ত্রীও এই নিয়মহীন সিদ্ধান্তে কীভাবে তার স্বমত পোষণ করেন, তার সঠিক জবাব নেই। বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা অনুসারে কোন ব্যক্তিকে নিবন্ধন সনদ ছাড়া বর্তমানে শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার বিধান নেই। এ বিষয়ে মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের বিষয়টি আরো যাচাই করা অত্যাবশক ছিল। 

এদিকে ননএমপিও শিক্ষকরা তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির দাবিতে বহু আন্দোলন করেছেন, বহুবার এমপিওভুক্তির আশ্বাসও পেয়েছেন, কিন্তু তা বাস্তবে পরিণত হয়নি। এজন্যই ননএমপিও শিক্ষকদের আন্দোলনের সময় মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী অনেকবার ননএমপিও প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমপিও করার আশ্বাস দেন, যা পরবর্তীতে মিথ্যাবাদী রাখাল বালকের মতো অবস্থা হয়। এক পর্যায়ে শিক্ষকরা তার কথার ভিত্তি না পেয়ে তাকে আন্দোলন থেকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। 

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে কর্মকর্তারা শুরু থেকেই বিমাতাসুলভ আচরণ করে আসছেন, এ কথা বলার অবকাশ নেই। কিন্তু তাদের একটি কথা স্মরণ রাখা দরকার, স্বাধীনতার আগে কিংবা পরে নামমাত্র কয়েকটি সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল যেগুলোর মাধ্যমে আজকের বাংলাদেশ এ পর্যায়ে আসতে পারার কথা নয়। দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে প্রায় ৯৭ ভাগ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষা বিস্তারে নিরলসভাবে অবদান রেখে যাচ্ছে। আজ প্রশাসনের উচ্চ স্তরে যারা আছেন, তারাও কোনও না কোনও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা অর্জন করেছেন। প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে এসে অতীত ভুলে যাওয়াটা ঠিক গরীবের ঘরে জন্ম নেওয়া উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার মতো। যিনি বড় অফিসার হয়ে পরবর্তীতে নিজের পিতা-মাতাকে তার সহকর্মীদের কাছে কাজের লোক বলে পরিচয় দেন।

ভুক্তভোগী প্রশ্ন তুলেছেন, এত সব বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিও পাওয়ার যোগ্য না হলে তাদের কেন অনুমোদন, স্বীকৃতি দেয়া হলো? কেনই বা একজন তরুণকে স্বপ্ন দেখালেন শিক্ষক হবার, যে ননএমপিও প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করতে করতে এখন প্রৌঢ় বয়সে উপনীত হয়েছেন। আবার অনেকে ননএমপিও ভুক্ত প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে করতে বেতন ভাতা না পেয়েই অবসরে গেছেন। ননএমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের এই চিত্র হলে এতসব প্রতিষ্ঠান চালু করার আগে বন্ধ করার আদেশ দেয়ার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু পাঠদান এবং স্বীকৃতির কার্যক্রম এখনও চলমান আছে। সরকারের উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তি মহোদয়েরা শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন, স্বীকৃতি এবং শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার বৈধতা দিয়েছেন, দিচ্ছেন। তাহলে ননএমপিও শিক্ষকদের বেতন-ভাতা প্রদান করতে এত সঙ্কোচ কেন? এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি অতি আবশ্যক।  অন্যথায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্তা ব্যক্তিদের হঠকারী সিদ্ধান্ত সরকারের উন্নয়নে বাধার কারণ হতে পারে। তাই ননএমপিও শিক্ষক এবং নিয়োগবঞ্চিত শিক্ষক নিবন্ধিত যুবসমাজের চাপা ক্ষোভ বৃহত্তর আন্দোলনে পরিণত হওয়ার আগেই জাতিকে বৈষম্যহীনভাবে এগিয়ে নেওয়ার সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের প্রত্যাশা সকলের। 


লেখক: অধ্যক্ষ, সাইডিরিয়্যাল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ (এসএমএসসি), খানসামা, দিনাজপুর।

 

হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0040390491485596