এবার এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর সারাদেশে ৩ লাখ ৬৯ হাজার খাতা পুনর্মূল্যায়নের আবেদন জমা পড়েছে। শুধু ঢাকা বোর্ডেই ১ লাখ ৪০ হাজার ৯২৩টি খাতা পুনঃনিরীক্ষার আবেদন পড়েছে। আর আবেদনকারীর সংখ্যা ৫৮হাজার ৭০ জন। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দেও এক লাখ ৩৮ হাজার খাতা পুনর্মূল্যায়নের জন্য আবেদন পড়েছিল। সেখান থেকে এক হাজার ৯৯০ জনের ফলও পরিবর্তন করা হয়। এবার প্রতিটি খাতা বাবদ পরীক্ষার্থীদের ফি দিতে হয়েছে ১২৫ টাকা। সেই হিসেবে এই খাতা থেকেই এবার বোর্ডগুলোর আয় হবে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা। এত টাকা আয় করেও শুভংকরের ফাঁকি রেখেই খাতা পুনর্মূল্যায়নের কাজ হচ্ছে। ইতোমধ্যে মহামান্য হাইকোর্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বোর্ডগুলোর কাছে জানতে চেয়েছেন, খাতা পুনর্মূল্যায়ন কেন হবে না? এত শিক্ষার্থী প্রতিবছর খাতা পুনর্মূল্যায়নের জন্য যে আবেদন করে এবং আবেদনের পর অনেক ফলও পরিবর্তিত হয় বিষয়টি আসলে কী? আসলেই কি পরীক্ষকরা খাতা দ্বিতীয়বার মূল্যায়ন করা হয়?
আরও পড়ুন: প্রসঙ্গ এমপিওভুক্তি
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকসহ অনেকেই মনে করেন যে, খাতা পুনর্মূল্যায়ন মানে পুনরায় খাতা দেখা। মূলত হওয়া উচিতও তাই। কিন্তু হচ্ছে এর পুরো উল্টোটা। ফল নিরীক্ষণে মাত্র চারটি বিষয় দেখা হয়। এক, সব প্রশ্নের উত্তরে নম্বর সঠিকভাবে বসানো হয়েছে কি না; দুই, প্রাপ্ত নম্বর গণনা ঠিকভাবে করা হয়েছে কি না; তিন, প্রাপ্ত নম্বর ও এম আর (অপটিক্যাল মার্ক রিডার) শিটে তোলা হয়েছে কি না এবং নম্বর অনুযায়ী ও এমআর শিটের বৃত্ত ভরাট ঠিক আছে কি না? আসল বিষয়টি অর্থাৎ উত্তরপত্র পুনরায় দেখা এবং মূল্যায়ন করা হয় না। একজন পরীক্ষক খাতা দেখার পর তার নম্বর প্রদান করা ঠিক আছে কি না তা দেখা হয় না। আশ্চার্যান্বিত হওয়ার বিষয় বোর্ড ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন যে, শুধুমাত্র নম্বর যোগ-বিয়োগের ভুলেই একেকটি পাবলিক পরীক্ষায় প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়ে থাকে। এই যখন অবস্থা তখন, পুনরায় খাতা দেখলে আবেদনকারীদের বেশিরভাগেরই ফল পরিবর্তন হবে এবং পরীক্ষকদেরও আরও কয়েকগুণ ভুল ধরা পড়বে বলে সংশ্লিষ্টদের বিশ্বাস এবং তা সহজেই বুঝা যায়।
আরও পড়ুন: মাধ্যমিক শিক্ষা কোন পর্যায়ে পরিচালিত হওয়া উচিত
জানা যায়, রাজধানীর মতিঝিল মডেল আইডিয়াল স্কুল ও কলেজের ইংরেজি ভার্সনের একজন শিক্ষার্থী ইংরেজি প্রথমপত্রে ৬০ পেয়েছে বাকি সবগুলোতে সে জিপিএ-৫ পেয়েছে। ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রেও সে পেয়েছে ৯২। ঐ বিদ্যালয়ের ইংরেজি ভার্সনের ১৬ জন শিক্ষার্থীই ইংরেজি প্রথমপত্রে কম নম্বর পেয়েছে; অথচ অন্যান্য সকল বিষয়ে তারা এ প্লাস পেয়েছে। ইংরেজি প্রথমপত্রে তারা ৫৫ থেকে ৬৪ এর মধ্যে নম্বর পেয়েছে। একই ঘটনা বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঘটেছে। খাতা মূল্যায়নে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় আছে ইংরেজি ভার্সনের শিক্ষার্থীরা। এর কারণ হচ্ছে ইংরেজি ভার্সনে যারা পড়াচ্ছেন তাদের বেশিরভাগেরই ইংরেজি ভার্সনে পড়ানোর দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। অনেক বিদ্যালয়ে বাংলা ভার্সনের শিক্ষকরাও ইংরেজি ভার্সনের ক্লাস নেন। এইসব শিক্ষকরা খাতাও মূল্যায়ন করছেন। বর্তমানে ইংরেজি ভার্সনের প্রশ্নও সরাসরি করা হয় না দক্ষ শিক্ষকের অভাবের কারণে। বাংলা ভার্সনের প্রশ্নই ইংরেজিতে অনুবাদ করে পাবলিক পরীক্ষা নেয়া হয়।
আরও পড়ুন: একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির খেলা
যেনতেনভাবে হোক আর অভিজ্ঞ শিক্ষকই হোক কিংবা খাতা মূল্যায়নের উপর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকই হোক না কেন, ভুল হবেই। ভুল হচ্ছে সহনীয় মাত্রায় আর একটি হচ্ছে অসহনীয়, অমোচনীয়, অমার্জনীয়। সরাসরি শিক্ষকতায় থাকাকালীন প্রতিবছর যখন বোর্ডে খাতা নিতে যেতাম তখন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকদের কাছে শুনতাম এবং অনেক প্রমাণ তারা আমাদের দেখাতেন যে কত অভাবনীয় এবং কত রকমের ভুল পরীক্ষকরা করে থাকেন। পরীক্ষার খাতা নৌকা কিংবা লঞ্চডুবিতে ভেসে গেছে, পরীক্ষক অসুস্থতার কারণে বোর্ড পরীক্ষার খাতা ট্রেনে ফেলে এসেছেন, পরীক্ষার খাতা নিয়ে অথবা ফেলে দিয়ে কোনো কোনো পরীক্ষক বিদেশে চলে গেছেন, কাজের মেয়ের দ্বারা ও এমআর শিট পূরণ করানো হয়েছে, ৮২ এর স্থলে নম্বর ২৮ দিয়ে ও এমআর শিট পূরণ করে চূড়ান্ত ফল তৈরি করা হয়েছে ইত্যাদি বহু রকমের তেলেসমাতি ঘটে বোর্ডের খাতায়। আমি নিজেও অনেক সহকর্মীর খাতা দেখার ইতিহাস দেখেছি। আর ভেবেছি কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কী বারোটাই না বাজানো হচ্ছে? এক সহকর্মীর স্ত্রী উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থী ছিলেন। উনি নিজেই ঐ বছর ইংরেজিতে ডাহা ফেল করেছিলেন; অথচ ঐ সহকর্মী উচ্চ মাধ্যমিকের পুরো খাতাগুলোই তার স্ত্রীর দ্বারা পরীক্ষণ করিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন: এবার এসএসসির ফলে গণিত ও ইংরেজিতে বিপরীতমুখী অবস্থান
এসব ঘটনা যুগের পর যুগ ঘটে আসছে। কর্তৃপক্ষের কিছু পদক্ষেপ এ বিষয়গুলোতে পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। বিষয়গুলো নিয়ে বহুবছর যাবত বহুবার লেখালেখি করেছি। কিন্তু পরিবর্তন এখনও খুব একটা দেখতে পাচ্ছি না একমাত্র বেডু (বাংলাদেশ এক্সামিনেশন ডেভেলপমেন্ট ইউনিট) প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া। তবুও সেটি প্রশংসনীয়। উত্তরপত্র মূল্যায়নে বেডুর উদ্যোগেই এখন পরীক্ষকদের মডেল উত্তরপত্র দেয়া হয়। পরীক্ষকদের ছয় দিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু ৬০ হাজার পরীক্ষককে প্রশিক্ষণ দিতে অনেক সময়ের প্রয়োজন। তাই বেডু নাকি অনলাইনেও এই প্রশিক্ষণ শুরু করেছে। খাতা মূল্যায়নে আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে তবে সিনসিয়ারলি যারা খাতা দেখেন না তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া আর মডেল উত্তরপত্র প্রদান করেই কতটা কী করা যাবে সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
আরও পড়ুন: প্রাথমিক শিক্ষায় কিছু ইতিবাচক সিদ্ধান্ত
একজন মানুষের ব্যক্তিগত খেয়াল খুশি ও তার কয়েক মিনিটের মূল্যায়ন (একটি খাতা কয়েক মিনিটেই পরীক্ষকরা মূল্যায়ন করে ফেলেন) একজন শিক্ষার্থীর সারাজীবনের বিচার, তার দশ-বার বছরের লেখাপড়ার বিচার, সারাজীবনের এক বৃহৎ রায় ঘোষণা করা হয় এই পাবলিক পরীক্ষার মাধ্যমে। যেভাবে এটি করা হয় সেটি কোনোভাবেই সঠিক কোনো রায় নয়। সঠিক মূল্যায়ন নয়। অনভিজ্ঞ ও নতুন একজন পরীক্ষক তো জানেনই না কীভাবে একটি উত্তরপত্র মূল্যায়ন করতে হয়। অথচ একমাত্র তার রায়ের উপর নির্ভর করছে একজন শিক্ষার্থীর পুরো জীবনের ফল, ইতিহাস, একাডেমিক অর্জন, জীবনের ভবিষ্যৎ মোড়। কী করে এটি হতে পারে! আমি কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজে কর্মরত থাকাকালীন একবার তুখোর এক ব্যাচ এসএসসি পরিক্ষার্থীদের কেউই ইংরেজিতে ‘লেটার মার্কস’ পায়নি। অথচ কলেজের ইন্টারনাল পরীক্ষায় সবাই লেটার মার্কস পেয়েছিল। কারণ অবজেকটিভ অংশে সবাই পূর্ণ ৫০ নম্বরই পেয়েছিল, আর লিখিত ৫০ এর মধ্যে কেউই ৩০ এর নিচে পায়নি। উল্লেখ্য, ক্যাডেট কলেজের ইন্টারনাল পরীক্ষার খাতা বেশ কঠিন করে দেখা হয়। বোর্ড পরীক্ষায় একটি ক্যাডেটও লেটার মার্কস পায়নি। পরে জানা গেল, বোর্ড পরীক্ষার খাতা গ্রামের কোনো এক শিক্ষকের কাছে পড়েছিল। তিনি কী করেছেন, কেন করেছেন জানার কোনো সাধ্য ছিল না। শুধু দেখা গেল ইংরেজিতে কেউই লেটার মার্কস পায়নি। ঐ সময়ে একটু ভালো শিক্ষার্থীরা অবজেকটিভ থাকার কারণে প্রায় সবাই লেটার মার্কস পেত।
নীতিমালা অনুযায়ী প্রধান পরীক্ষক হওয়ার জন্য দশ বছরের এবং পরীক্ষক হওয়ার জন্য পাঁচ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। এসব নিয়ম অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানা হয় না। প্রতিষ্ঠান প্রধান সম্মতি দিলেই পরীক্ষক হয়ে যাচ্ছেন সব ধরনের শিক্ষক। জুনিয়র সেকশনের শিক্ষক পরীক্ষক হচ্ছেন সিনিয়র সেকশনের, কলেজের শিক্ষকও স্কুলের খাতা দেখছেন। আমি দেখেছি কলেজের শিক্ষক মাদরাসার খাতাও পরীক্ষণ করছেন। কোনো একজন শিক্ষক যদি স্বল্প সময়ের জন্য হলেও একটি বিষয় পড়ান, তিনি ঐ বিষয়ের পরীক্ষক হয়ে যান। এভাবে এক বিষয়ের শিক্ষক অন্য বিষয়ের পরীক্ষক হচ্ছেন। আর মাধ্যমিক পর্যায়ে তো বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকই নেই, এই সুযোগটি আরও কাজে লাগানো হচ্ছে। অনেকে তদবির করে পরীক্ষক হন। প্রধান পরীক্ষকদের শতকরা দশটি খাতা পুনর্মূল্যায়ন বা চেক করার কথা। কিন্তু এই কাজটি অনেকেই করেন না, শুধু খাতায় সই করেই তারা খালাস।
খাতা পরীক্ষণে আর একটি সমস্যা হয়। অনেক ভালো প্রতিষ্ঠানের বিশেষ করে শহরের ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষক পরীক্ষক হওয়ার মতো কষ্ট করতে চান না। কারণ অর্থই তাদের কাছে বড় কথা। তারা বোর্ডের খাতা দেখে সময় নষ্ট করার চেয়ে দু’ব্যাচ শিক্ষার্থী পড়িয়ে অনেক বেশি উপার্জন করতে পারেন। তাই বছর দু’য়েক আগে বোর্ড নিয়ম করেছিলে যে, নামকরা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বোর্ডের খাতা অবশ্যই দেখতে হবে। জানি না কতটা কার্যকরী হয়েছে। আর বোর্ড কর্র্তৃপক্ষ তো যত তাড়াতাড়ি ফল ঘোষণা করতে পারে ততই যেন তারা মঙ্গল মনে করেন এবং কৃতিত্ব মনে করেন। আগে বোর্ডের ফল প্রকাশ করতে কমপক্ষে তিন মাস সময় নিতো। এখন সেটি দু’মাসেরও নিচে নেমে এসেছে এবং এজন্য তারা ক্রেডিটও নিচ্ছেন। কিন্তু প্রকৃত মূল্যায়ন কি হচ্ছে?
বোর্ডের খাতা পরীক্ষনে কিছু পরিবর্তন আনতেই হবে। প্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়নকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এতে শিক্ষার্থীদের পড়ার চাপও কমে যাবে, শিক্ষার্থীরা বিষয়ের গভীরে যেতে পারবে এবং এই ধারাবাহিকের ফল বোর্ডেও প্রেরণ করতে হবে যাতে একজন শিক্ষার্থীর হঠাৎ কে নো পরিবর্তন বা বিপর্যয় যাতে সহজেই ধরা পড়ে। এটি করা হলে শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো ক্লাসও করবে এবং এই মূল্যায়নটি গুরুত্ব পাবে। দ্বিতীয় আর একটি বিষয়ে জোর দিতে হবে। সেটি হচেছ বোর্ডের খাতা পরীক্ষণ কোনোভাবেই একজন শিক্ষকের দ্বারা করানো যাবে না। তিনজন হলে ভালো হয়, সম্ভব না হলে অন্তত দু’জন পরীক্ষক একটি উত্তরপত্র পৃথকভাবে মূল্যায়ন করবেন। কারোর নম্বর কেউ জানবেন না। দু’জন বা তিনজনের নম্বর গড় করে ফল তৈরি করতে হবে। এটি করা হলে বর্তমান পরিস্থিতিতে যে লাখ লাখ শিক্ষার্থীর খাতা পুনর্মূল্যায়নের দরখাস্ত জমা পড়ে, অথচ তাদের খাতাও পুনর্মূল্যায়ন করা হয় না সেই অনৈতিক দিকটিকে এড়ানো যাবে এবং লাখ লাখ শিক্ষার্থীকে এভাবে আর ঠকতে হবে না। বোর্ড পরীক্ষার প্রতি মানুষের আস্থা ফিরে আসবে, আস্থা বেড়ে যাবে। পরীক্ষার ফল নিয়ে আর খুব একটা প্রশ্ন থাকবে না, যেটা এখন আছে। শিক্ষার্থীরাও পড়াশুনায় মনোযোগ দিবে। তারা শুধুমাত্র পরীক্ষার্থী হবে না, হবে প্রকৃত শিক্ষার্থী।
লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক, বর্তমানে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত।