ব্যতিক্রমী মানুষ এখনো আছেন - Dainikshiksha

ব্যতিক্রমী মানুষ এখনো আছেন

মাছুম বিল্লাহ |

এ পৃথিবীতে মানুষের শখের শেষ নেই। প্রভূত অর্থের মালিক কিংবা কোনো কোনো ধনীর দুলাল বিকৃত রুচি চরিতার্থ করার জন্য কত ধরনের অপকর্মই না করে থাকে প্রচুর অর্থের অপচয় ঘটিয়ে। কেউ একটি চাকরি পাওয়ার জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঘুষ দেয়। কেউ বা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়ে কিভাবে মানুষের মাথায় বাড়ি দিয়ে অর্থ উপার্জন করবে সেই চিন্তায় বিভোর। আবার এগুলোর বিপরীতে কিছু মানুষ আছেন যাঁদের থাকে না কোনো অর্থচিন্তা, অর্থলোভ, লালসা বা কারো কাছ থেকে কিছু পাওয়ার চিন্তা। তাঁরা শুধু মানুষকে আলোকিত করতে ব্যস্ত থাকেন, নিজ অর্থ দিয়ে, তাঁদের উপার্জন সহজ নয়, তার পরও। এমন একজন বিরল মানুষ হচ্ছেন মো. জসিম উদ্দিন, বয়স ৩২, কাঠমিস্ত্রি, লেখাপড়া দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। গ্রাম : পাইকপাড়া, থানা : খোকসা, জেলা : কুষ্টিয়া।

নিজের কোনো জমি নেই, ব্যাংক ব্যালান্স নেই, সহজ কোনো অর্থের উৎস নেই; কিন্তু অদ্ভুত এক শখ। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা না থাকলেও তিনি একজন প্রকৃত মানুষ। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালে কী দেখতে পাই? অত্যন্ত ভদ্র পোশাক পরা মেধাবী তরুণের দল, হাতে হকিস্টিক, কোমরে পিস্তল, মুখে অকথ্য গালিগালাজ, আর তা করছে হয়তো কোনো শিক্ষককে, নয়তো কোনো সহপাঠীকে অথবা অনুজকে। এ দৃশ্য এখন নিত্যদিনের। চিন্তা শুধুই প্রত্তিপত্তি, অর্থ, ক্ষমতা আর অবৈধ পথে এগুলো অর্জন।

অথচ জসিম উদ্দিন! নিজ উপার্জনের অর্থ দিয়ে তিনি বই কেনেন, বিতরণ করেন শিশু-কিশোর, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শ্রমজীবীসহ সব বয়স ও পেশার মানুষের মধ্যে। তিনি নিজ উদ্যোগে, নিজ অর্থে ২০১৬ সালের ২৯ অক্টোবর গড়ে তুলেছেন একটি পাঠাগার। বইয়ের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক, পাঠকসংখ্যা ২৫০। বাড়ছে প্রতিদিন। কারা এই পাঠক? গ্রামীণ জনপদের শিশু, কিশোর, ছাত্র-ছাত্রী, গৃহবধূ, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও সাধারণ মানুষ। পাঠাগার খোলা রাখেন প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা ও সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৯টা। পাঠাগারে সংবাদপত্র রাখেন। পাঠাগারের মাসিক খরচ—পেপার বিল ৩০০ টাকা, ঘরভাড়া ২০০ টাকা, বিদ্যুৎ বিল ১০০ টাকা।

নিজ উপার্জনের অর্থ জমিয়ে কয় দিন পর পর বই কেনেন কুষ্টিয়া শহর থেকে। রমজানের আগে আগে এসেছেন ঢাকার নীলক্ষেতে বই কিনতে। বস্তা ভরে বই কিনে নিয়ে গেছেন। তাঁর বন্ধুদের কেউ কেউ বলেছিলেন, ঢাকার নীলক্ষেতে অনেক কম দামে বেশি বই কিনতে পাওয়া যায়। তাই ঢাকায় বই কিনতে আসেন। জসিম উদ্দিন নিজেও পড়েন। পত্রিকা পড়েন নিয়মিত, তাঁর লাইব্রেরিতে পত্রিকা রাখেন। শিক্ষা ও বই সংক্রান্ত লেখা পড়ে তিনি আবিষ্কার করেন আমাকে, চলে আসেন বাসায়। এভাবে বিভিন্ন শিক্ষানুরাগী ও শিক্ষকের কাছে যাচ্ছেন কিছু বইয়ের আশায়, তাঁর পাঠাগারকে আরো উন্নত করার আশায়, গ্রামীণ জনপদের শিশু-কিশোর, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার হাতে জ্ঞানের মশাল বই তুলে দিতে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম তাঁর দিকে। স্রষ্টার সৃষ্টি যে কত ধরনের তা বোঝা মুশকিল।

সমাজের অবক্ষয়, তরুণদের বিপথে যাওয়া, মাদকে জড়িয়ে পড়া, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া ইত্যাদির পেছনে কারণ বহু ধরনের। তরুণদের সঠিক পথে আনতে হলে তাদের জ্ঞানের রাজ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। কে বা কারা করবেন সেই কাজটি? করার কথা ছিল সমাজের শিক্ষিত ও বিত্তবানদের। কিন্তু শিক্ষিত জনগোষ্ঠীও পড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে তারা। নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত, চারদিকে কী ঘটছে, কী হচ্ছে তা নিয়ে তেমন কোনো চিন্তা তাদের নেই। বিত্তবানরা আরো বিত্ত-বৈভব বানানোর নেশায় মত্ত। বই, বই পড়া, বই পড়ানো, লাইব্রেরি, জ্ঞানের মশাল ইত্যাদি নিয়ে তাদের তেমন কোনো আগ্রহ লক্ষ করা যায় না ব্যতিক্রমধর্মী দু-চারজন ছাড়া।

কে বা কারা ধরবেন সমাজের হাল? এ অবস্থায় নিজ উদ্যোগে মহৎ কাজে হাত দিয়েছেন জসিম উদ্দিন। গড়ে তুলেছেন লাইব্রেরি, গ্রামে ঘুরে ঘুরে বিনা পয়সায় সংগ্রহ করছেন সদস্য—যাকে যেখানে পাচ্ছেন তাকে। কত সচেতন মানুষ তিনি! কিছু কিছু অভিভাবক ক্লাসের পাঠ্য বই ছাড়া বাইরের বই বাচ্চাদের পড়তে দিতে চান না; যদিও জসিম উদ্দিন তাদের সদস্য করেছেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘স্যার, দেখুন তো শুধু ক্লাসের বই পড়ে ছাত্র-ছাত্রীরা কতটুকু বিদ্যার্জন করতে পারবে! অথচ অনেক অভিভাবক তা বোঝেন না। তাঁরা বাচ্চাদের আমার লাইব্রেরি থেকে বাসায় নিয়ে যান। ’ যে কথাটি বলার কথা ছিল শিক্ষকদের, সমাজের শিক্ষিত লোকদের, সেই কথাটি বলছেন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়া একজন জসিম উদ্দিন। আমাদের শিক্ষকরা নির্দিষ্ট ও সীমিত বই পড়িয়ে তথাকথিত ভালো রেজাল্ট করানো নিয়ে ব্যস্ত, আর প্রকৃত জ্ঞানার্জনের দিকে শিক্ষার্থীদের পথচলাকে করছেন সীমাবদ্ধ। অভিভাবকরা ও গোটা সমাজ এই জ্ঞানহীন ফল লাভের নেশায় মত্ত। ঠিক তখনই একজন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অশিক্ষিত মানুষ সমাজের কত বড় দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন, আমরা সেই গভীরতাটুকু মেপে দেখব না? তাঁর স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে আসব না?

প্রতিদিন তাঁর পাঠক বাড়ছে। আনন্দের সংবাদটি আমাকে জানাচ্ছেন নিয়মিত। ২৪০ থেকে ২৫০ জন পাঠক তাঁর বই পড়ছে প্রতিদিন। যখনই কোনো শিক্ষক তাঁকে কিছু বই উপহার দিচ্ছেন তখনই আনন্দের সঙ্গে আমাকে জানাচ্ছেন। বই পেয়ে তাঁর সে কী আনন্দ! এই নয় কি একজন প্রকৃত আলোকিত মানুষের প্রতিচ্ছবি? সমাজের সর্বস্তরের মানুষই বিত্তবান হওয়ার ধান্দায় থাকে। সবাই যার যার অবস্থান থেকে ওপরে ওঠার চেষ্টায় ব্যস্ত, স্বপ্ন দেখে পুরোটাই অর্থনৈতিক, পুরোটাই আত্মকেন্দ্রিক। এই ব্যবসায়িক যুগে কয়জন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে যাঁরা নিজ ভবিষ্যৎ, নিজ উন্নয়ন, নিজ অর্থনীতিকে সবল করা, নিজ সন্তানের জন্য ভবিষ্যতে বাড়ি-গাড়ি-ব্যাংক ব্যালান্স করা বাদ দিয়ে জ্ঞানের রাজ্যে বিচরণ করেন, আলোর রাজ্যে বিচরণ করেন, সমাজের অন্য মানুষগুলোকে নিজ অর্থ ও সময় ব্যয় করে প্রকৃত আলোয় আলোকিত করার চেষ্টা করেন। যিনি বা যাঁরা এ কাজ করেন তাঁদের সংখ্যা সমাজে বিরল। তাঁদের উৎসাহিত করা, সহায়তা করা আমাদের নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব। কোনো অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলে তাঁর মুখে শোনা যায় কোথায় জমি কিনেছেন, কোথায় বাড়ি করছেন, কয়টি বাড়ি ভাড়া দিয়েছেন। আমি বহু শিক্ষকের মুখেই এই একই কথা শুনতে পাই, যেন জমি কেনা আর বাড়ির মালিক হওয়ার মধ্যেই জীবনের সার্থকতা। বাকি পেশায় যাঁরা জড়িত তাঁদের কথা না হয় না-ই বললাম। যাঁরা সারা জীবন শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞান বিতরণ করেন, তাঁদের মুখেই এসব কথা শুনি আমরা সব সময়। সেই প্রেক্ষাপটে আমরা জসিম উদ্দিনের মতো মানুষকেও দেখি। আসুন, তাঁর কাছ থেকে আমরা শিখি, তাঁর দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিই।

মাছুম বিল্লাহ: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক, ব্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত সাবেক ক্যাডেট কলেজ শিক্ষক।
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0042049884796143