ভণ্ডুল করতে চান সংসদ সদস্যরা - দৈনিকশিক্ষা

এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগভণ্ডুল করতে চান সংসদ সদস্যরা

রাকিব উদ্দিন |

এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সরকারিভাবে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া ভন্ডুল করতে চান সংসদ সদস্যরা (এমপি)। তারা আগের মতোই ‘ম্যানেজিং কমিটি’র কাছে শিক্ষক নিয়োগের কর্তৃত্ব ফেরত নিতে চান। কিন্তু শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এমপি বা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে নিয়োগের কর্তৃত্ব ফেরত গেলে, দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ পাবে না। এতে শিক্ষার মানের অবনতি ঘটতে থাকবে। শিক্ষক নিয়োগে স্বজনপ্রীতি, ঘুষ, দুর্নীতি বাড়বে। তাছাড়া জনপ্রতিনিধিদের অযাচিত হস্তক্ষেপের লাগাম টানতেই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারিভাবে শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধাস্ত কার্যকর করা হচ্ছে।

শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে এখন বিপরীতমুখী অবস্থানে শিক্ষা প্রশাসন ও সংসদ সদস্যরা। এমপি’রা এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিলের চেষ্টা করছেন। আর এই প্রক্রিয়ায় সফলতা দেখে এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে এখন অনার্স-মাস্টার্সের শিক্ষকও নিয়োগ দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের এই উদ্যোগে সমর্থন রয়েছে ডিসিদের। তবে এই বিষয়ে আপত্তি রয়েছে শিক্ষকদের। তারা শিক্ষক নিয়োগে পিএসসির আদলে কমিশন চান।

এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় দেশব্যাপী বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে কিছুটা হলেও শৃঙ্খলা এসেছে বলে মনে করছেন শিক্ষা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। জেলা প্রশাসকরাও (ডিসি) বলছেন, বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বিশৃঙ্খলা কমেছে। এজন্য তারা সব ধরনের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ চান। শিক্ষক নেতারাও বলছেন, অতীতের চেয়ে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম কমেছে।

কিন্তু এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ করে পূর্বের মতো গভর্নিং বডির কাছে শিক্ষক নিয়োগ ছেড়ে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন জনপ্রশাসন সম্পর্কীয় সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।

সম্প্রতি এ কমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এনটিআরসিএ কর্তৃক কেন্দ্রীয়ভাবে শিক্ষক নিয়োগ ভালোর চেয়ে মন্দ ফল বেশি হচ্ছে। পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়া উল্টাপাল্টা লোককে নিয়োগের জন্য এনটিআরসিএ সুপারিশ করছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী রাজনীতি করে সন্ত্রাসী স্বামীর স্ত্রী, যার শিক্ষা জীবনে ব্রেক অফ স্টাডি রয়েছে-এমন প্রার্থীকেও নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেছে এনটিআরসিএ’।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘সকল সংসদ সদস্য এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া বাতিল চাচ্ছেন; এটা ঠিক নয়। কেউ কেউ এটা চাচ্ছেন। তারা চাইতেই পারেন। তবে এটা ঠিক যে, এখন শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, দুর্নীতি কমেছে।’

উপেক্ষিত শিক্ষানীতি : ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ এর ৬২ পৃষ্ঠায় শিক্ষক নিয়োগের জন্য একটি ‘স্থায়ী জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন’র কথা বলা হয়েছে। এর কর্মপরিধি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘শিক্ষানীতির আওতাধীন ও এমপিওভুক্ত সকল ধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য শিক্ষক নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, বদলি ও পদোন্নতি এবং মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ, নিয়োগকৃত শিক্ষকদের মানোন্নয়ন এবং সীমিত জাতীয় সম্পদের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য কতিপয় ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে।’

শিক্ষানীতিতে আরও বলা হয়েছে, ‘সরকারি অনুমোদন ও আর্থিক সহায়তাপ্রাপ্ত বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও এবতেদায়ি মাদ্রাসা, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও কলেজের জন্য মেধাভিত্তিক ও উপযুক্ত শিক্ষক নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) অনুরূপ একটি বেসরকারি শিক্ষক নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের মহাসচিব অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম সাজু বলেন, ‘যে লক্ষ্য নিয়ে এনটিআরসিএ প্রতিষ্ঠান করা হয়েছিল, তা ভালো ফল বয়ে আনেনি। শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি আরও জগাখিচুঁরি মার্কা হয়েছে। আমাদের দাবি ছিল, পিএসসির আদলে একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করে শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার। কিন্তু সেটি হলো না।’

আমলাদের কারণে এই কমিশন গঠন করা হয়নি অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগে নানা রকম ভুল-ভ্রান্তি, অসঙ্গতি ও সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। শিক্ষক যে প্রতিষ্ঠানের জন্য আবেদন করেনি, তাকে সেখানে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে; এক বিষয়ের শিক্ষককে অন্য বিষয়ে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে; কোন কোন ক্ষেত্রে পদ শূন্য না থাকা সত্ত্বেও ওইপদে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।’

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি কলেজ শিক্ষকদের সংগঠন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির আপত্তির কারণে শিক্ষক নিয়োগে পৃথক কর্মকমিশন গঠনের উদ্যোগ নিতে পারছে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই কমিশন গঠন হলে নিজেদের অধিকার ও মর্যাদা ক্ষুণœ হতে পারে বলে আশঙ্কা বিসিএস শিক্ষা সমিতির নেতাদের।

বেসরকারি স্কুল-কলেজে শিক্ষক নিয়োগের জন্য ২০০৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে জাতীয় শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) অধীনে এই পরীক্ষা নেয়া শুরু করে। পরীক্ষায় উত্তীর্ণরা শিক্ষক হওয়ার একটি সনদ পান, যা ‘এনটিআরসিএ’ নামে পরিচিত। এর আগে একই দিন একসঙ্গে এক ঘণ্টা এমসিকিউ ও তিন ঘণ্টার লিখিত পরীক্ষা নেয়া হতো। দ্বাদশ শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা থেকে এমসিকিউ ও লিখিত পরীক্ষা আলাদাভাবে নিচ্ছে এনটিআরসিএ।

একই সঙ্গে সনদের মেয়াদ তিন বছর করা হয়। এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা পর্ষদের ক্ষমতা খর্ব করে মেধার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে বলে মনে করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিদ্যমান প্রক্রিয়ায় এনটিআরসিএ দেশের সকল বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকের শূন্যপদের চাহিদাপত্র আহ্বান করে। এরপর প্রতিষ্ঠানগুলো এনটিআরসিএ’র ওয়েবসাইটে গিয়ে নিবন্ধন করে। এই তালিকা অনুযায়ী এনটিআরসিএ’র নিবন্ধনধারী ব্যক্তিদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়। এই কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৫ সালে।

সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রতিবেদন : জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ২৯তম বৈঠকের কার্যবিবরণীতে (৩১ জুলাই প্রকাশিত) বলা হয়েছে, ‘শিক্ষক নিয়োগের মিনিমাম একটি লেভেল বজায় রাখার জন্য নিবন্ধন (এনটিআরসিএ) পরীক্ষা। কিন্তু সেই নিবন্ধন পরীক্ষা কতটুকু কঠোরভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। যোগ্য প্রার্থী বাছাইয়ের লক্ষ্যে পরীক্ষা কঠোর করা প্রয়োজন। আর দুই-এক মিনিটের মৌখিক পরীক্ষায় যোগ্যতা যাচাই হয় না বরং তদবিরের চাপ বাড়ে। মৌখিক পরীক্ষা বন্ধ করা উচিত। লিখিত পরীক্ষা নেয়ার পর উত্তীর্ণদের মৌখিক পরীক্ষার প্রয়োজন নেই।’

প্রতিবেদনে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ‘এনটিআরসিএ’কে রিকুইজিশন (চাহিদাপত্র) দেয়ার পরও দুই-তিন মাস চলে যায়, কিন্তু শূন্যপদ পূরণ হয় না। তাছাড়া কেন্দ্রীয়ভাবে শিক্ষক নিয়োগ দেয়ায় দেখা যায়, বাড়ি যার দিনাজপুরে হয়ত তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে কক্সবাজারে; ফলে জটিলতা সৃষ্টি হয়।’

ব্রাক্ষণবাড়িয়া-৩ আসনের এই এমপি বলেন, ‘নিয়োগ কর্তৃত্ব এনটিআরসিএ’র কাছে থাকায় তার স্কুলে ২ বছর অতিবাহিত হচ্ছে এখনও অংকের শিক্ষক, ইসলাম ধর্মের শিক্ষকের পদ শূন্য পূরণ হচ্ছে না।’

উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী আরও বলেন, ‘সেন্ট্রালাইজ করা গণতন্ত্র না, বিকেন্দ্রীকরণ হচ্ছে গণতান্ত্রিক। এনটিআরসিএ নিয়োগ ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নিয়োগ পদ্ধতিটি কেন্দ্রীভূত করে ফলেছে। তাছাড়া যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত না; যেখানে বেতন দেয় না। সুতরাং সেখানে এনটিআরসিএ শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারে না। এনটিআরসিএ’তে অপেক্ষমান শিক্ষক থাকে কিন্তু তারপর দুই বছরেও অংক, ইংরেজি, বিজ্ঞান শিক্ষক পাওয়া যায় না।’

এনটিআরসিএ’র প্রসার চান ডিসিরা বর্তমানে শুধু এন্ট্রি লেভেলে (প্রভাষক, সহকারী শিক্ষক, সহকারী মৌলভী ইত্যাদি) নিয়োগের লক্ষ্যে প্রার্থী বাছাইয়ের দায়িত্ব এনটিআরসিএ’র। কিন্তু গত ২৪-২৬ জুলাই অনুষ্ঠিত ডিসি সম্মেলনের আগে বেশ কয়েকজন ডিসি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে যেসব প্রস্তাব জমা দেন, তার মধ্যে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের সব নিয়োগ এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে সম্পন্ন করার প্রস্তাব ছিল।

ডিসিরা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে জানান, এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষক নিয়োগ হওয়ায় কিছুটা শৃঙ্খলা এসেছে। অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি কমেছে।

জেলা প্রশাসকদের মনে করেন, প্রতিষ্ঠান প্রধান (অধ্যক্ষ/প্রধান শিক্ষক) ও অন্যান্য সাপোর্ট স্টাফ সংশ্লিষ্ট কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ করায় নানা ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যায়। এসব অনিয়ম বন্ধে এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে দ্রুত নিয়োগ দেয়া যেতে পারে।

বর্তমানে দেশে ২৬ হাজার ৮১টি সাধারণ স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা, ৭৭৫টি কারিগরি কলেজ এবং কারিগরি স্কুলসহ প্রায় ২৮ হাজার এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়াও আর প্রায় আট হাজার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।


সূত্র: সংবাদ 

রোজায় স্কুল: শিক্ষার্থী উপস্থিতি কম, নজরদারিও ঢিলেঢালা - dainik shiksha রোজায় স্কুল: শিক্ষার্থী উপস্থিতি কম, নজরদারিও ঢিলেঢালা পেনশন প্রজ্ঞাপনে উদ্বিগ্ন ঢাবি উপাচার্য - dainik shiksha পেনশন প্রজ্ঞাপনে উদ্বিগ্ন ঢাবি উপাচার্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গবেষণা অনুদান করমুক্ত - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গবেষণা অনুদান করমুক্ত ব্রাজিলে তীব্র গরমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ - dainik shiksha ব্রাজিলে তীব্র গরমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের নামে প্রতারণা, সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের নামে প্রতারণা, সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উচ্চ মাধ্যমিকের সমমান পেলো ‘হেট’ - dainik shiksha উচ্চ মাধ্যমিকের সমমান পেলো ‘হেট’ আটকের ১৩ দিন পরেও বরখাস্ত হননি অধ্যক্ষ - dainik shiksha আটকের ১৩ দিন পরেও বরখাস্ত হননি অধ্যক্ষ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0043590068817139