মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাবই সব পর্যায়ে ভর্তি সমস্যার মূলে। মানসম্মত স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাজধানী কেন্দ্রিক হয়ে গেছে। তাই, কোনও কোনও স্কুলে ভর্তি হতে কয়েক লাখ টাকা ডোনেশন দিতে হচ্ছে। আবার প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক স্কুল শিক্ষার্থী পাচ্ছে না। একইভাবে শহর কেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তিযুদ্ধে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ থাকলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও অনেক আসন ফাঁকা থেকে যাচ্ছে।
শনিবার (৪ জানুয়ারি) রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি সমস্যা : প্রতিকার ও করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে এসব বিষয়টি তুলে ধরেন শিক্ষাবিদরা। এডুকেশন রিফর্ম ইনিশিয়েটিভের (ইআরআই) আয়োজন এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়।
সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ও এডুকেশন রিফর্ম ইনিশিয়েটিভের চেয়ারম্যান ড. আ ন ম এহছানুল হক মিলনের সভাপতিত্বে বৈঠকে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. এস এম এ ফায়েজ। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. সদরুল আমীন। গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনায় এডুকেশন রিফর্ম ইনিশিয়েটিভের সদস্যরাসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট গণ্যমান্য ব্যক্তিরা অংশগ্রহণ করেন।
সভার শুরুতে ইআরআইয়ের পক্ষ থেকে লিখিত প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। এতে বলা হয়, ভর্তি সমস্যার মূলে সারাদেশের জন্য এবং বিশেষত রাজধানীর জন্য যথেষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব। মান রক্ষার জন্য যোগ্য শিক্ষক, ভৌত অবকাঠামে ও যথার্থ ব্যবস্থাপনার অভাব রয়েছে। তাই, অভিভাবকরা পরিচিত স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করতে চান। সেখান থেকেই ভর্তি সমস্যর শুরু। লিখিত প্রবন্ধে আরও বলা হয়, রাজধানীর নামীদামি স্কুলগুলোতে ভর্তি বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। ২০০ আসন ফাঁকা থাকলে ১৫০ শিক্ষার্থী নিয়মমাফিক ভর্তি করা হয়। বাকি আসনগুলোতে টাকার বিনিময়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয় বলে প্রবন্ধে দাবি করা হয়।
প্রবন্ধে আরও বলা হয়, ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি আসনের জন্য ৩৮ জন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি আসনে জন্য ৩৪ জন এবং মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮১৫ আসনের জন্য ৬৫ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। অথচ পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধেক আসন ফাঁকা রয়েছে। মেধা তালিকা থেকে মাত্র ২৫৮ জন ভর্তি হয়েছে। ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি শেষে দেখা যায় ৮৭২ আসন শূণ্য রয়েছে। এ পরিসংখ্যান দেখে দৃশ্যত মনে হয় কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হওয়াটাই শিক্ষা জীবনের মূল লক্ষ্য।
অনুষ্ঠানে মুক্ত আলোচনায় বক্তারা মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে শিক্ষকদের দেয়া আর্থিক সুবিধাবৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তারা বলেন, বহির্বিশ্বে শিক্ষকদের সর্বোচ্চ সম্মান ও আর্থিক সুবিধা দেয়া হয়। তাই মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট হয়। কিন্তু বাংলাদেশে যারা কোনো চাকরি খুঁজে পায় না তারাই শিক্ষকতা পেশায় আসছেন। তাই, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা বাড়াতে হবে। একই সাথে শিক্ষকদের রাজনৈতিক পরিচয় পরিহার করে শিক্ষক পরিচয়ে সমাজের কাজে অংশগ্রহণ করার আহ্বান জানান বক্তারা। তারা আরও বলেন, রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকরা তোষামোদিতে ব্যস্ত থাকেন। শিক্ষক হিসেবে তাদের কাছ থেকে তা কাম্য নয়।
সভায় প্রধান অতিথি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. এস এম এ ফায়েজ বলেন, রাজনৈতিক পরিচয়ের চেয়ে শিক্ষক পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থায় ভিসি বা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের কাছে শিক্ষক পরিচয়ের থেকে রাজনৈতিক পরিচয়টাই গুরুত্বপূর্ণ। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
তিনি আরও বলেন, পদের প্রতি মোহ থাকলে সেই শিক্ষকের কখনোই ভিসি বা কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রধান হওয়া উচিত নয়। শিক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিক প্রভাবের বিরোধিতা করে তিনি প্রশ্ন তোলেন, আমরা কি শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছি না ভোটার?
অনুষ্ঠানের সভাপতির বক্তব্যে আ ন ম এহছানুল হক মিলন কারিগরি শিক্ষায় জোর দিতে কারিগরি শিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠনের দাবি জানান। তিনি বলেন, ২৩টি মন্ত্রণালয় কারিগরি শিক্ষার জন্য কাজ করছে। কিন্তু এ জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় নেই।
তিনি আরও বলেন, কারিগরি শিক্ষাই পারে বাংলাদেশকে বদলে দিতে। এজন্যই রসায়নের শিক্ষার্থী হয়েও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছি কারিগরি শিক্ষার ওপর। কখনো যদি সুযোগ পাই, দেশের কারিগরি শিক্ষার প্রসারে অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগাবো। তিনি বলেন, আগে মালয়েশিয়া থেকে শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পড়তে আসতো। কিন্তু এখন তারা উন্নত। আমরা মালয়েশিয়ায় ডিগ্রি নিতে যাই। মাহথীর মোহাম্মদ মানসম্মত শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছেন তাই তাদের শিক্ষা উন্নত হয়েছে।
শিক্ষকদের সম্মান ও মর্যাদার ওপর গুরুত্ব দিয়ে সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী বলেন, মন্ত্রী থাকতে নিজের শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকতাম। এ নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সভাও ডাকা হয়। সভায় আমি তৎকালীন শিক্ষাসচিবকে বলেছিলাম, আমি সারাজীবনের জন্য মন্ত্রী না। কিন্তু আমার শিক্ষকরা সারাজীবন আমার শিক্ষক থাকবেন।