ভর্তির আগেই ৭০ হাজার টাকা গচ্চা! - দৈনিকশিক্ষা

ভর্তির আগেই ৭০ হাজার টাকা গচ্চা!

বিমল সরকার |

জাতির জন্য দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, রাষ্ট্রের একেবারে শীর্ষস্থান থেকে বারবার তাগিদ দেয়া সত্ত্বেও লাখ লাখ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের স্বার্থে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আজ পর্যন্ত সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা চালু করা সম্ভব হয়নি।

এইচএসসি বা সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর উচ্চতর স্তরে ভর্তি নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রস্তুতি ও চেষ্টা এবং উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার যেন সীমা-পরিসীমা নেই। একই সঙ্গে রয়েছে দুর্ভোগ-বিড়ম্বনা ও ভোগান্তির বিষয়টিও। ভালো মানের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষাকে আজকাল ভর্তিযুদ্ধ বলে অভিহিত করা হচ্ছে। অবশ্য এর পেছনে যুক্তিসঙ্গত কারণও রয়েছে।

ভর্তির আবেদন করা থেকে শুরু করে পরীক্ষা দিয়ে ঘরে ফেরা পর্যন্ত কী লড়াইটাই না লড়ে যেতে হয় একেকজন শিক্ষার্থীকে। এ ছাড়া ওদের সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবকদের লড়াইটাকেই বা খাটো করে দেখার অবকাশ কোথায়?

এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ফল প্রকাশ হতে না হতেই শিক্ষার্থীদের মনে এ ভর্তিযুদ্ধের বিষয়টি ব্যাপকভাবে ঘুরপাক খেতে শুরু করে। উচ্চশিক্ষার স্তর বা পছন্দ অনুযায়ী কোনো প্রফেশনাল কোর্সে ভর্তির জন্য কিশোর-কিশোরী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সঙ্গে তাদের অভিভাবকদেরও দু’চারটি মাস হন্যে হয়ে ছোটাছুটি করতে হয় দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।

স্বাভাবিকভাবে অধিকাংশ শিক্ষার্থীরই লক্ষ্য থাকে ভালো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া। কিন্তু দেশে ভালো মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং এগুলোতে আসন সংখ্যা সীমিত থাকায় অনেকের কাছেই ভর্তিযুদ্ধটি ভয়াবহ রূপ নেয়। সর্বস্তরে সর্বাত্মকভাবে লড়েও কয়েক লাখ শিক্ষার্থীকে শেষ পর্যন্ত বিফল মনোরথ হয়ে সাধারণ কোনো প্রতিষ্ঠানেই ভর্তি হতে হয়।

দেশে বর্তমানে ৪০টি সরকারি এবং ১০০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সরকারি মেডিকেল কলেজ ৩৬টি আর বেসরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে ৭০টি। সরকারি ডেন্টাল কলেজ একটি ও ডেন্টাল ইউনিট নয়টি।

বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ আছে ১৪/১৫টি। রয়েছে ১৬টি ইন্সটিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি। এ ছাড়াও আছে কলেজ অব লেদার টেকনোলজি ও কলেজ অব টেক্সটাইল টেকনোলজিসহ আরও বেশকিছু প্রতিষ্ঠান। সরকারি এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তির চাপ বেশি।

তবে সবচেয়ে বেশি পছন্দের প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষ করে ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, বুয়েট ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজের এক একটি আসনকে সবাই একেবারে সোনার হরিণ বলে জ্ঞান করে থাকেন। কী শিক্ষার্থী, কী অভিভাবক; যত স্বপ্ন, যত প্রতিযোগিতা মূলত এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঘিরেই।

আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষ করে বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরবরাহকৃত ফরম পূরণ করে ভর্তির জন্য আবেদন করতে হতো। এখন কেবল আবেদন নয়, গোটা ভর্তি প্রক্রিয়াটিই সম্পন্ন হয় অনলাইনের মাধ্যমে।

ভর্তি ফরমের দাম নির্ধারণ কিংবা ভর্তি পরীক্ষা বাবদ নির্ধারিত টাকা আদায়কে কেন্দ্র করে এ পর্যন্ত অনেক অবাঞ্ছিত ও অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে আন্দোলন, বাদানুবাদ, ক্ষোভ-বিক্ষোভ, অবরোধ-মারামারি, কাঁদানে গ্যাস ও টিয়ার শেল নিক্ষেপসহ অনেক কিছুই হয়েছে উচ্চশিক্ষাদানকারী নামকরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। বছরের পর বছর বলতে গেলে পৌনঃপুনিকভাবে চলেছে এসব।

লক্ষ করার বিষয়, ভর্তি মৌসুম এলেই প্রতিবার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ফরমের দাম বাড়িয়ে দেয়। ভর্তি ফরমের দাম শতকরা ১০ ভাগ, ২০ ভাগ, ৩০ ভাগ, এমনকি অবলীলায় ৫০ ভাগ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতেও তারা ইতস্তত করে না।

এ নিয়ে প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে দেখা দেয় নানা ধরনের অসন্তোষ ও ক্ষোভ। অতঃপর শুরু হয় আন্দোলন। ভর্তি ফরমের মূল্য কমানোর আন্দোলন এবং ওই আন্দোলন দমন করতে সময় সময় প্রতিষ্ঠানগুলোয় কত ধরনের বিপত্তিই না সৃষ্টি হয়েছে! ফলে অনেক সময় আন্দোলনের মুখে কর্তৃপক্ষকে বর্ধিত মূল্যের পুরোটাই প্রত্যাহার কিংবা আংশিক হলেও কমিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ বা ইন্সটিটিউট সব মিলিয়ে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং এগুলোয় আসন সংখ্যা শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুপাতে না হলেও একেবারে কম নয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই রয়েছে নানা প্রশ্ন এবং এক একটি প্রতিষ্ঠান গড়েই উঠেছে বাণিজ্যিক মনোভাব নিয়ে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এক একটিতে চারটি, ছয়টি, আটটি, এমনকি এর চেয়েও বেশিসংখ্যক অনুষদ রয়েছে।

সব মিলিয়ে বিভাগ রয়েছে ২০, ৩০, ৪০, ৬০, ৭০ কিংবা এরও বেশি। একজন শিক্ষার্থীর একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ইউনিট বা বিভাগে আবেদন করার সুযোগ থাকে এবং তারা পুরো সুযোগটিই গ্রহণ করতে চায়। প্রথম পছন্দ ও শেষ পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিট বা বিভাগ এভাবে তাকে অনেক জায়গায় আবেদন করতে হয়।

প্রতিটি আবেদনের সঙ্গে পাঁচশ’, সাতশ’, এমনকি আটশ’-এক হাজার টাকা কিংবা আরও বেশি ফি জমা দিলে একেকজন আবেদনকারীর ব্যয় হওয়া মোট টাকার অঙ্কটি কী দাঁড়ায়, তা সহজেই অনুমেয়।

বেশ ক’জন অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এইচএসসি পরীক্ষার পর কোচিং সেন্টারে ভর্তি, ৩-৪ মাসের থাকা-খাওয়া এবং ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ইউনিট ও বিভাগে ভর্তির আবেদন এবং পরীক্ষা বাবদ এ পর্যন্ত একেকজনের পকেট থেকে অন্তত ৬০-৭০ হাজার টাকা চলে গেছে। দেশ জুড়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের আবেদন ও ভর্তি পরীক্ষা তো এখনও রয়েই গেছে!

এভাবে লাখ লাখ তো বটেই, এমনকি কোটিরও বেশি টাকা আদায় হয় কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভর্তি পরীক্ষা বাবদ আদায় করা ওই টাকা অথবা এর অংশবিশেষ বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলে জমা দেয়ার বিধান থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নাকি তা মানা হয় না। আদায়কৃত ওই টাকা খরচ বা নিজেদের মাঝে ভাগবাটোয়ারা করতে গিয়ে অনেক সময়ই দেখা দেয় নানা ধরনের বিপত্তি।

ভর্তি ফরম বিক্রি করে কিংবা ভর্তি পরীক্ষা বাবদ আদায় করা কোটি কোটি টাকা শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা নিয়ে নানা দেনদরবার, অভিযোগ, ক্ষোভ-বিক্ষোভ ও হতাশার বিষয়টি অনেকবার পত্র-পত্রিকার খবর হয়েছে।

শুনেছি, আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন ফরমের জন্য কোনো টাকা দিতে হতো না। মাত্র এক টাকা দিয়ে ফরম কিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য আবেদন করা গেছে। আমাদের সেশনে (১৯৭৭-৭৮) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স প্রথমবর্ষে ভর্তি ফরম ও পরীক্ষাসংক্রান্ত সব খরচ বাবদ ফিস ধার্য করা হয় মাত্র তিন টাকা। দেশের অন্যসব বিশ্ববিদ্যালয়েও (রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর, বাংলাদেশ প্রকৌশল এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) তখন ভর্তি বাবদ বলতে গেলে এ পরিমাণ টাকাই আদায় করা হতো।

কিন্তু গত তিন-সাড়ে তিন দশকে কখনও গাণিতিক আবার কখনও জ্যামিতিক হারে বাড়তে বাড়তে ধার্যকৃত ভর্তি ফি’র টাকার অঙ্কটি কোথায় গিয়ে উঠেছে, তা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভর্তিচ্ছু লাখ লাখ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরাই ভালো বলতে পারবেন। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখি। অস্বীকার করার উপায় নেই, এ লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য আমরা ক্রমান্বয়ে এগোচ্ছিও।

কিন্তু এটা কী আজব কথা- কেবল ভর্তি পরীক্ষা বাবদ একজন শিক্ষার্থীর বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ হয়ে যাবে! আমরা জানতে চাই, ভর্তি পরীক্ষা দিন দিন জটিল, নাকি সহজতর করা হচ্ছে? আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় সাফল্যের এ যুগে ভর্তি পরীক্ষাসংশ্লিষ্ট কাজে লোকবল বাড়ানো হচ্ছে, নাকি কমানো হচ্ছে? ভর্তি পরীক্ষার ফি কমানো যেমন-তেমন, আগামী দুই বা তিন বছর পর্যন্ত আর বাড়ানো হবে না- এমন একটি বাণীও যদি কানে পৌঁছত; তবে সংশ্লিষ্টরা স্বস্তি পেতেন।

আমরা চাই, বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে বহুল আলোচিত গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা চালু করে সময় ও অর্থ সাশ্রয়সহ সংশ্লিষ্টদের সব ভোগান্তি-বিড়ম্বনার অবসান। কোনো ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, সংশয়-সন্দেহ অযথা কারও মনে যেন ভর করে না বসে। ভর্তি ফরমের মূল্য, খরচাপাতি, বিল-ভাউচার, ট্যুর-ভ্রমণ, নিজেদের মধ্যে টাকা ভাগবাটোয়ারা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে অসন্তোষ, ক্ষোভ ও দেনদরবার এবং নানা অনভিপ্রেত ঘটনা পত্র-পত্রিকার শিরোনাম হলে আমরা লজ্জা পাই। আশা করি, দায়িত্বশীলরা এসব কিছুর দিকে নজর দেবেন।

লেখক : কলেজ শিক্ষক

সূত্র : যুগান্তর

মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি - dainik shiksha মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! - dainik shiksha খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ - dainik shiksha এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে - dainik shiksha মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা - dainik shiksha মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! - dainik shiksha মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0079340934753418