ভাইস চ্যান্সেলর থেকে ভাইসরয় - দৈনিকশিক্ষা

ভাইস চ্যান্সেলর থেকে ভাইসরয়

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

দেশের বিশেষ বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষকরা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে গিয়ে আর ভাইস চ্যান্সেলর থাকেন না, তাঁরা ব্রিটিশ আমলের ভাইসরয় হয়ে পড়েন। নিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যোগসাজশে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। এ ক্ষেত্রে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে ইউজিসি। প্রথমেই সিন্ডিকেটগুলোতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও পছন্দের লোকদের নিয়োগের মাধ্যমে সিন্ডিকেটকে প্রভাব বলয়ে নেওয়ার ষোলোকলা পূর্ণ করা হয়। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ শিক্ষকদের মধ্য থেকে পূর্বপরিচিতি বা অবনত শ্রেণির শিক্ষকদের সিন্ডিকেটে নিয়ে সিন্ডিকেটকে রাবার স্ট্যাম্প প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়। সিন্ডিকেটে প্রতিনিধিত্বে সব নিয়োগকেই প্রভাবিত করার সুযোগ থাকায় এসব সিন্ডিকেট থাকা বা না থাকার মধ্যে কোনো অর্থ থাকে না। ভাইস চ্যান্সেলর নামের ভাইসরয় মহোদয়রা যা বলেন বা করেন, সিন্ডিকেট তা সর্বসম্মতভাবে পাস করে। সিন্ডিকেটে নিয়মবহির্ভূতভাবে বিভিন্ন অজুহাতে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় শত শত নিয়োগের যৌক্তিকতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা হয় না। সিন্ডিকেটকে বলা যায় ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত করার প্রতিষ্ঠান। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সব স্তরেই ভাইসরয়দের বিভিন্ন ধরনের যোগাযোগ থাকে। ফলে দুর্নীতি দমন কমিশন চিৎকার দেওয়ার আগ পর্যন্ত এসব ভাইসরয়ের কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্ন তোলার নজির নেই বললেই চলে। শুক্রবার (৮ নভেম্বর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা আগের প্রতিষ্ঠিত পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের বিরূপ প্রভাব ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বকীয় গতিপ্রবাহকে ব্যাহত করে ব্যাপক মাত্রায়। প্রথমতো ভাইস চ্যান্সেলর-কাম-ভাইসরয়রা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগপ্রাপ্তির পরই ব্রিটিশ শাসনের অনুরূপ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হন। ব্রিটিশরা যেমন বিভাজনের রাজনীতি লালনের মাধ্যমে তাদের দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসন পরিচালনা করেছে, তেমনি তাঁরাও তাঁদের কর্মস্থলে যোগদানের পরপরই শুরু করেন বিভাজনের কৌশল। যেহেতু বেশির ভাগ শিক্ষকই নিয়োগ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থেকে, ফলে এ রকম আজ্ঞাবহ একটা শ্রেণি বের করতে খুব একটা কষ্ট পেতে হয় না। আমেরিকায় যেমন প্রেসিডেন্ট পরিবর্তন হলে বিশাল পরিবর্তন হয়, তেমনি ভিসি পরিবর্তন হলেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আজ্ঞাবহ প্রশাসন সাজানোর জন্য অযোগ্যদের অতিরিক্ত সুবিধা দিয়ে নিজস্ব বলয় সৃষ্টির জন্য প্রচুর রদবদল করা হয় প্রশাসনে। আবার এর ওপর রয়েছে আরেক রোগের ব্যাপক প্রকোপ। এ কাজের জন্য আঞ্চলিকতাকে ব্যবহার করা হয় ব্যাপক মাত্রায়। ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর জরিপ চালালেই এর সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যাবে। তিনটির দুটি বিশ্ববিদ্যালয়েই স্পষ্টত একটি পুরনো বৃহত্তর জেলার শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা এত বেশি যে তা অন্ধেরও চোখ এড়ানোর কথা নয়। অস্থায়ী বা দৈনিক ভিত্তিতে নিয়োগের পর বিশেষ অঞ্চলের কর্মচারীদের স্থায়ী করার কৌশলে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়েই কর্মচারীদের বেশির ভাগই একটি অঞ্চলের। এই প্রক্রিয়া ইদানীং শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যবহার হচ্ছে ব্যাপকভাবে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকাও কম নয়। ঢাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় এক যুগ ধরে ভিসি ও ট্রেজারার উভয় পদেই একই এলাকার লোক কর্মরত রয়েছেন। ফলাফল যা হওয়ার তা-ই হয়েছে নির্বিঘ্নে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভাইস চ্যান্সেলরদের কর্মকাণ্ডে ছাত্রসংগঠনগুলোর নীরব সমর্থনের কারণও এড়িয়ে যাওয়ার বিষয় নয়। অবৈধ বা বৈধ সব নিয়োগেই এক ধরনের প্রচ্ছন্ন বোঝাপড়া থাকে। ফলে অর্থ অনর্থের ব্যাপারটি, বিশেষ করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। উপাচার্যরা কোনো কোনো সময় এগুলো বাঁকা চোখে দেখেন, আবার কোনো কোনো সময় হাত প্রসারিত রেখেই চোখ বন্ধ রাখেন এসব বিষয়ে। চোখ বন্ধ রাখার এ কৌশল ভাইসরয়দের ভূমিকা কিছু না কিছু থাকে। এ ছাড়া আবার রয়েছে বিশেষ বিশেষ সুবিধার ক্ষেত্র। নন-অডিটেবল ফান্ড ও উৎসব ব্যয়। নন-অডিটেবল ফান্ড থেকে যত্রতত্র টাকা ব্যয় প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে করে থাকেন। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সুবিধা ভোগের জন্য এসব ফান্ড থেকে অর্থ ব্যয়ের কোনো বালাই নেই। সব ব্যয়েরই কমিটি থাকে। তবে কমিটিগুলো করা হয় বুঝেশুনেই। এসব কমিটির সদস্যরা হিসাব-নিকাশের চেয়ে স্বাক্ষর দিতে বেশি আগ্রহী। কারণ এতে মিটিং-সিটিং বা ফিটিং অ্যালাউন্স—সবই পকেটে যায় নির্বিঘ্নে। এ ছাড়া বিভিন্ন উৎসবে ব্যয়ের ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতাও ছাত্রনেতাদের বগলে রাখার ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মধ্যে দলাদলি-কোন্দল সৃষ্টির মূল কারণই হলো অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ। নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্যরা একটি গ্রুপকে বগলে রেখে অন্যদের সঙ্গে বৈরিতা লাগিয়ে রাখেন, ফলে নালিশ-সালিসের মাধ্যমে তাঁদের রুটিনকাজ ভালোই চলে। দলাদলি-কোন্দলে নিজের সময় পার করে আর একটি দিনের জন্যও ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা মুখেও আনেন না। সার্থক শাসনকালের পর নতুন পুরস্কার পদবির জন্য উচ্চ মহলে নড়াচড়া শুরু করেন। আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত ভিসিরা আবার আগের মতো কলোনি শাসনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কলোনি শাসনের পরোক্ষ প্রভাব হিসেবে দলাদলি-কানাকানি একপর্যায়ে হানাহানিতে রূপ নেয়; কিন্তু সার্থক ভিসিদের সার্থকতার গল্প শেষ হয় না। নিয়োগ বোর্ডগুলোতে ভিসিদের নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের একচ্ছত্র আধিপত্য সর্বজনবিদিত। তিয়াত্তরের অধ্যাদেশভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাড়া সব বিশ্ববিদ্যালয়েই নিয়োগ বোর্ডের এক্সপার্টদের নাম আসে উপাচার্যদের হাত ধরেই এবং এগুলোতে উপাচার্যরা নিজেদের ঘনিষ্ঠজনদেরই স্থান দিয়ে থাকেন। এখানে বিভিন্ন কোটা থাকলেও উপাচার্যদের প্রভাব বিস্তারে প্রত্যক্ষ সুযোগ থাকায় যা হওয়ার তা-ই হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজের নিয়োগ নিয়েই তর্কবিতর্কের শেষ নেই। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ বোর্ডে তাঁরা যা করেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সাম্প্রতিক বছরগুলোর শিক্ষক নিয়োগের ওপর জরিপ চালালে যে কারো সন্দেহ হতে পারে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নিশ্চয় গর্দভ ছাড়া কেউ লেখাপড়া করে না। অপর পক্ষে পিএসসির পরীক্ষাগুলো বা ব্যাংকের নিয়োগ বোর্ডের পরীক্ষাগুলোর ফলাফল অবশ্যই ভিন্ন ভিন্ন চিত্র প্রদর্শন করে।

এবার আসি স্পর্শকাতর একটি বিষয়ে। উপাচার্যদের আজ্ঞাবহ নয় এমন বা বিরাগভাজন হন এমন শিক্ষকদের দুঃখ-কষ্টের কথা বললে যাঁরা এ জগতের নন, তাঁদের নিজেদের অন্য কোনো গ্রহের বাসিন্দা মনে হতে পারে। বিরাগভাজনদের বিরুদ্ধে অসদাচরণ, শৃঙ্খলাভঙ্গ ও নৈতিক স্খলনের মতো অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। কমিটি গঠন হয় নিজ গ্রুপের শিক্ষকদের দিয়ে। যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উপস্থাপন করা হয় কমিটি গঠনে, তাঁর প্রতিপক্ষের লোকজনই পছন্দনীয়। ফলে এমন কথাও শোনা যায় যে রিপোর্ট আবার কী। স্যার যা বলেছেন তা-ই হবে। আর এরূপ পরিস্থিতিতে সাক্ষী গোপালের অভাব হয় না। নির্বিঘ্নে তখন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের লেবেল লাগিয়ে হেনস্তা করা শুরু হয়। অবশ্য ভিসিরা আগে থেকেই তো হন দলীয় ছাত্রনেতাদের বড় ভাইয়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ। কেউ আবার দলীয় পদ-পদবি নিয়েই আবির্ভূত হন ভিসিরূপে। বড় বড় নেতার সঙ্গে যোগসাজশের নাম করে খড়্গ হাতে তাঁরা থাকেন উদ্ধত। এ পরিস্থিতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের প্রতিবাদ তো দূরের কথা, নোম্যান্স ল্যান্ডে দাঁড়ানোর মতো শিক্ষকও এখন পাওয়া দুরূহ।

সার্বিক অর্থে এক উপাচার্য নিয়োগপ্রক্রিয়ায় অযৌক্তিকভাবে ঢাকা ও গুটিকয়েক বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাধান্য দেওয়ার কারণে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মুক্তবুদ্ধির চর্চা তো দূরের কথা, স্বাধীন চিন্তার মতো পরিবেশও মুখথুবড়ে পড়েছে। দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়েই অন্তত উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব পালনের মতো যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক রয়েছেন। আবার অনেকে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়কে গতিশীল রাখার মতো যোগ্যতাও রাখেন। বর্তমানের এই ব্রিটিশ ধাঁচের শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড গতিশীল হবে। নিজের অবসর পর্যন্ত কর্মস্থল বিবেচনায় সবাই অন্তত অতিথি পাখিদের মতো আচরণ থেকে বিরত থাকবেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ স্বাধীন মতচর্চার উপযোগী হবে, যার ফল ভোগ করবেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ঔপনিবেশিক শাসনতন্ত্রের বলয় থেকে মুক্ত হোক, মুক্ত হোক বিভাজনের রাজনীতি থেকে। সুন্দর হোক, হোঁচট খেয়ে হলেও স্বাধীনভাবে আগামী দিনের পথচলা।

নাসির উদ্দিন আহমদ নোমান : সাবেক শিক্ষক বুয়েট ও ডিন, কলা ও আধুনিক ভাষা অনুষদ, লিডিং, ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ।

এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ - dainik shiksha এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0039610862731934