প্রাচীনকাল থেকে বহুকাল বাংলাদেশেই বাংলা ভাষা ছিল অনার্য ভাষা। বৌদ্ধ যুগে বাংলা ভাষার কিছুটা শ্রেণি উত্তরণ ঘটে। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন বৌদ্ধদের চর্যা সাহিত্য। কিন্তু ব্রাহ্মণ শাসকদের ভয়ে বৌদ্ধ পণ্ডিতরা তাদের সাহিত্যের পুঁথি নিয়ে নেপালে পালিয়েছিলেন। বাংলার প্রাক্তন শাসকরা বাংলা ভাষাকে আখ্যা দিয়েছিলেন 'রৌরব নরকের ভাষা'।
পাঠান হোসেন শাহি আমলে বাংলা ভাষা রাজদরবারের কিছুটা পৃষ্ঠপোষকতা পায়। ফার্সি, তুর্কি, আরবি ভাষার সান্নিধ্যে তার বিকাশ ঘটে। তবে কুলীন ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে তখনও তার আসন লাভ হয়নি। ইংরেজ শাসনামলে বাংলা ভাষার প্রকৃত কৌলীন্য লাভ শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথ একাই তার গীতাঞ্জলির জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করে বাংলাকে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের কুলীন ভাষাগুলোর প্রায় কাছাকাছি ভাষা করে তোলেন।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এবং এখন একটি স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রভাষা হওয়ার সুবাদে বাংলা ভাষার সব অকৌলীন্য এখন ঘুচে গেছে। কিন্তু কৌলীন্য অর্জন করলেও ইংরেজি, ফরাসি ভাষার মতো উন্নত সে হতে পারেনি। যে স্বাধীন দেশটির সে রাষ্ট্রভাষা, সে দেশেও জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে সে বহুলভাবে ব্যবহূত নয়। পাকিস্তান আমলে তাকে উর্দু ভাষার বাঁদি করে রাখা হয়েছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তাকে ইংরেজি ও হিন্দি দুই রূপসী ও অভিজাত সতিনের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলতে হচ্ছে।
বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীন হলেও ঔপনিবেশিকতার মানসিকতা থেকে এখনও মুক্ত হতে পারেনি। নিজ ভাষাচর্চা ও ব্যবহারে হীনম্মন্যতাই তার প্রমাণ। আমাদের শাসকশ্রেণি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তাদের আভিজাত্য ও দূরত্ব বজায় রাখার জন্য তাদের আগের বিদেশি শাসক শ্রেণির ভাষা ও আচার-আচরণ অনুসরণ করতে চায়। আর সাধারণ সামাজিক জীবনে মুম্বাইয়া অপসংস্কৃতির প্রভাব দ্রুত বাড়ছে। বিয়ে অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে সব ধরনের সামাজিক কর্মকাণ্ডে। অর্থনৈতিক উন্নতি সত্ত্বেও দ্রুত সামাজিক অবক্ষয় আমাদের রাজনীতিকেও সুস্থতা অর্জন করতে দিচ্ছে না।
এই অবস্থা অবশ্য নতুন কিছু নয়। ইংরেজদের মতো উন্নত জাতিকেও এই অবস্থার মধ্য দিয়েই আজকের উন্নতিতে পৌঁছতে হয়েছে। পাঁচশ' বছর আগেও ইংরেজদের ভাষা ও সমাজ সংস্কৃতি ছিল ফরাসি ভাষা ও সামাজিক আচার-আচরণ দ্বারা প্রভাবিত। কবি চসারের যুগ থেকে শুরু হয় ইংরেজি ভাষা ও সংস্কৃতির ফরাসি প্রভাবমুক্তি। ইংরেজ অভিজাত শ্রেণি তাদের আভিজাত্য প্রমাণের জন্য ফরাসি ভাষায় অথবা ফরাসি মিশ্রিত ইংরেজি ভাষায় কথা বলতেন। ইংরেজি ভাষা সাহিত্যের দ্রুত উন্নতির সঙ্গে তাদের এই অভ্যাস দূর হয়।
পারস্যের ভাষা ও সংস্কৃতি ছিল আরবদের চেয়ে অনেক উন্নত। তথাপি আরবদের পারস্য বিজয়ের পর পারসিকদের মধ্যে আরবদের ভাষা সংস্কৃতি প্রাধান্য বিস্তার করে। কিন্তু কবি ফেরদৌসের বিদ্রোহের ফলে পারসিকদের ভাষা সংস্কৃতি আরবদের প্রভাবমুক্ত হয়। বর্তমান পারসিক বা ইরানিরা ধর্মে মুসলমান; কিন্তু ভাষা ও সামাজিক রীতিনীতির ক্ষেত্রে আরবদের চাইতে আলাদা।
বাংলা ভাষাকে কৌলীন্য দানের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব কবি রবীন্দ্রনাথ। তারপর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতিসংঘে তার বাংলায় ভাষণ এই ভাষাকে বিশ্বের অনেক উন্নত ভাষার সমমর্যাদায় তুলে দেয়। তার কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ইউনেস্কোর প্যারিস বৈঠকে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন দিবস একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করা হয় এবং সারাবিশ্বে দিবসটি পালিত হচ্ছে।
পাকিস্তান আমলে অবাঙালি শাসকরা বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি নিধনের চেষ্টা করেছেন। তাকে খণ্ডিত করার জন্য দুই বাংলার মধ্যে ভাষায় বার্লিন ওয়াল খাড়া করেছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই দেয়ালটি ভেঙে পড়ে; কিন্তু তার ভগ্নাংশ থেকে যায়। শেখ হাসিনার আমলে এই ভগ্নাংশ দূর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ভারতের সঙ্গে যুক্তভাবে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালিত হয়। রবীন্দ্র-তীর্থভূমি শান্তিনিকেতনে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মিলন মোহনা হিসেবে একটি বাংলাদেশ ভবন প্রতিষ্ঠা করা হয়।
বাংলা ভাষার অকৌলীন্য দূর হয়েছে। যেটা হয়নি তা হচ্ছে, তার যথাযথ ব্যবহারিক প্রসার। স্বদেশে নয়, বিদেশেও নয়। আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে এখনও স্বভাষার ব্যবহার প্রসারিত হয়নি। তার প্রধান দুটি কারণ- আমাদের এলিট ক্লাসের এখনও বিদেশি ভাষা ব্যবহারে আভিজাত্যবোধ এবং দেশি ভাষাটিরও নিজস্ব সীমাবদ্ধতা। সাহিত্যের ভাষা হিসেবে বাংলা এখন উন্নতির শিখরে। কিন্তু ব্যবহারিক ও বিজ্ঞানের ভাষা হিসেবে অনেক পেছনে। এখন এমনকি হিন্দির কাছ থেকেও আমাদের কথা ধার করতে হয়।
বাংলা ভাষা অবশ্য এখন সংস্কৃত ও আরবি-ফার্সি ভাষার আধিপত্যমুক্ত; কিন্তু ঋণমুক্ত নয়। প্রমথ চৌধুরীর আমল থেকে সাংবাদিকতায় ও সাহিত্যে চলতি ভাষার ব্যবহার প্রাধান্য পাওয়ার ফলে বাংলা ভাষা অন্য ভাষার শিকল ভেঙে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ পায়। এই ভাষার একটা বড় গুণ তার গ্রহণী শক্তি। ফলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাম্প্রতিককালের সব আবিস্কারের নাম সে ঈষৎ পরিবর্তন করে অথবা হুবহু গ্রহণ করতে পেরেছে। যেমন ইংরেজি হসপিটাল হয়েছে বাংলায় হাসপাতাল। একাডেমি হয়েছে আকাদেমি। আবার ইন্টারনেট, ওয়েবসাইট, ফেসবুক বাংলা ভাষায় এসে বাংলা হয়ে গেছে।
একসময় বাংলা ভাষার কিছু পণ্ডিত যেসব বিদেশি কথা বাংলা ভাষা গ্রহণ করে ফেলেছে, সেগুলোরও অনুবাদ করার চেষ্টা করেছিলেন। তার অধিকাংশই ছিল হাস্যকর। যেমন টেলিফোনকে করা হয়েছিল দূর আলাপনী। সাধারণ মানুষ তা গ্রহণ করেনি। তারা টেলিফোনকে টেলিফোনই রেখেছে। পণ্ডিতরা অ্যারোপ্লেনের বাংলা করতে গিয়ে বিমান, খপোত ইত্যাদি নানা নাম দিয়েছেন। সাধারণ মানুষ তার নাম দিয়েছে উড়োজাহাজ। অনুরূপভাবে সাবমেরিনের নাম দিয়েছে ডুবোজাহাজ। সেইসঙ্গে প্লেন এবং সাবমেরিনও বাংলা হয়ে গেছে। এটা বাংলা ভাষার গ্রহণী শক্তির পরিচয় দেয়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকায় বাংলা একাডেমির কর্মকাণ্ড বহুগুণ বেড়েছে। তার একটি অনুবাদ শাখা। এই অনুবাদে বিদেশি বহু শব্দ সহজ বাংলায় অনূদিত হয়েছে এবং বাংলা ভাষার অভিধানও উন্নত ও বর্ধিত হয়েছে। বেশ কিছু নতুন শব্দ ও কথাও উদ্ভাবন করা হয়েছে। বাংলা ভাষার গবেষণা বিভাগটিও সমৃদ্ধ।
সাহিত্যের ভাষা হিসেবে বাংলা খুবই সমৃদ্ধ। কিন্তু যেখানে তার পশ্চাৎপদতা তা হচ্ছে, বিজ্ঞান শিক্ষা। বঙ্গবন্ধুর কাছে একবার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দুঃখ করে বলেছিলেন, 'বাংলা ভাষায় ওষুধের একটা প্রেসক্রিপশন লেখা যায় না, কমার্শিয়াল চিঠি লেখা যায় না, ডিপ্লোমেটিক চিঠিপত্র লেখা আরও অসম্ভব। বঙ্গবন্ধু, আপনি দেশ স্বাধীন করেছেন। পণ্ডিতদের কবল থেকে বাংলা ভাষাকেও মুক্ত করুন। মানুষের মুখের বাংলাকে রাষ্ট্রের প্রাত্যহিক কাজকর্মেও তুলে আনুন। পণ্ডিতদের বলুন ভাষাকে বিজ্ঞান শিক্ষাদানের উপযোগী করে তুলতে। তাহলেই দেখবেন, বাংলা ভাষা ইংরেজি-ফরাসির সমপর্যায়ে উঠে আসার সুযোগ পাবে। সাহিত্যের মতো বিজ্ঞানেরও ভাষা হয়ে উঠবে। জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে ব্যবহারিক ভাষা হবে। বঙ্গবন্ধু তাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন, তিনি সেই চেষ্টা চালাবেন।
ভাষা দিবসের অর্থ ও উদ্দেশ্য, ভাষার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ। প্রতি একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমরা ভাষাশহীদদের স্মরণ করি, তাদের স্মরণোৎসব করি; কিন্তু ভাষা দিবসের গত ৬৭ বছরে ভাষার উন্নয়নে আমরা কতটা এগিয়েছি, তার খতিয়ান করি কি? এখন ২১ ফেব্রুয়ারি সারাবিশ্বেই মাতৃভাষা দিবস। বিশ্বময় সারা ভাষাগোষ্ঠীরই আজ আত্মানুসন্ধানের দিন।
সৌজন্যে: সমকাল