ফেনীর সোনাগাজীর সোনার মেয়ে নুসরাত জাহান রাফি। জীবনের সোনালি স্বপ্নগুলো দেখা শুরু করার মুহূর্তে এই নিষ্ঠুর পৃথিবী তাকে ত্যাগ করল। বাবার আসনে বসা তারই পীঠকেন্দ্র ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদরাসার অধ্যক্ষ, তারই শিক্ষাগুরু নরপিশাচ সিরাজ উদ দৌলার কামনার হোমানলে পুড়ে প্রাণ নির্গত করতে বাধ্য হয়। কামাতুর সিরাজের দৃষ্টি সব সময় থাকত সুন্দরী ছাত্রীদের প্রতি। নুসরাত হয়েছিল তাঁর শেষ শিকার। এ বছরের মার্চ-এপ্রিল ছিল নুসরাতের কাল মাস। রোববার (১ ডিসেম্বর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, সিরাজের ধর্ষণ প্রচেষ্টায় প্রতিবাদী হয়ে সোনাগাজী থানায় ওসির কাছে অভিযোগ জানাতে যায় মেয়েটি। প্রভাবশালী সিরাজ ও তাঁর শক্তিশালী সমর্থকদের কারণে সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন মামলা গ্রহণ না করে অজ্ঞাত কারণে নুসরাতের জবানবন্দি অপ্রয়োজনীয় জেনেও দৃষ্টিকটুভাবে নিজ মোবাইল ফোনে ধারণ করেন। সেই ভিডিও ধারণকালে পিতৃসুলভ আচরণ তো ছিলই না, বরং একজন অপরাধীকে জেরা করার চেয়েও অসুন্দরভাবে ধমক দিয়ে, চাপ দিয়ে এক বিব্রতকর এবং নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন।
একজন অসহায় মানুষ বিপদে পড়লে প্রথম স্রষ্টাকে স্মরণ করে, এরপর মাকে ডাকে, তারপর পুলিশের কাছে যায় বুকভরা আশা ও দাবি নিয়ে। পুলিশ তখন যদি কাম্য আচরণ করে, মানুষ তাকে দেবতুল্য মনে করে আজীবন পূজা করে। অন্যথা হলে সেই মানুষটির মাথায় পর্বত ভেঙে পড়ে বুক ভেঙে খান খান হয়ে যায়। নুসরাতের মর্মস্পর্শী হত্যাকাণ্ড দেশবাসী শুধু নয়, বিশ্ববাসীও জানে মিডিয়ার কল্যাণে।
বিবিসি, সিএনএন, আলজাজিরাসহ বড় বড় সংবাদমাধ্যম সবাই সংবাদের বিষয় প্রচার করেছে। ইউটিউবে ভারতের প্রচারযন্ত্রেও এটি বহুল প্রচারিত হয়েছিল, এখনো হচ্ছে। অবশেষে নানামুখী চাপে থানায় ধর্ষণ প্রচেষ্টার মামলা হয়। সিরাজ গ্রেপ্তার হন। অধ্যক্ষ এখানে থেমে গেলে এবং নতজানু হয়ে মীমাংসার চেষ্টা করলে নুসরাত বাঁচত। বাঁচতেন সিরাজও কিছু সাজা পেয়ে। সঙ্গে বাঁচত তাঁর সাঙ্গ-সমর্থক ১৫ জনও। সিরাজ তো দমার পাত্র নন, জেলে থেকেও নুসরাতের পরিবারকে রফায় আসতে বাধ্য করার জন্য সাঙাতদের বলেন।
এতে ফল না হলে নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত জেলে বসেই পাকা করেন। সেই অনুযায়ী তাঁর কামচক্রের সদস্যরা এগিয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয় ৬ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে। ১৬ জনের ঘাতকদল নিষ্ঠুরতমভাবে কাজটি সম্পন্ন করে এটিকে আত্মহত্যা বলে প্রচারে নামে। সোনাগাজী থানার সাবেক ওসিকেও দলে ভেড়াতে সক্ষম হয়। অবিশ্বাস্যভাবে এই ঘাতকচক্রে তিনজন নারীও জড়িত হয়। এর মধ্যে একজন আসন্ন সন্তানসম্ভবাও।
এই নারীরা শুধু জড়িতই হয়নি, পুড়িয়ে মারার ঘটনায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। এদিকে ওসি ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত প্রতিবেদন দেন এবং পুলিশ সুপারও সেই মোতাবেক মিডিয়ায় জানান। পরবর্তী সময়ে ওসির বিরুদ্ধে করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার বাদী ব্যারিস্টার সৈয়দ সামসুল হক সুমন এরূপ দাবি করেন। অনেক জল ঘোলার পর মামলাটির তদন্ত পিবিআই পায় এবং দ্রুততার সঙ্গে চার্জশিট দেয়। সংশ্লিষ্ট নারী ও শিশু নির্যাতন আদালত ৬১ কার্যদিবসে শুনানি শেষে চার্জশিটভুক্ত ১৬ জন আসামিকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। পর্যায়ক্রমে সুপ্রিম কোর্ট চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। সব আসামি এখন কুমিল্লা কেন্দ্রীয় জেলে আছে। নুসরাত হত্যা মামলার ঘটনা এবং রায় দেশবাসী সবারই জানা। তাই আর বিস্তারিতে গেলাম না।
এ লেখার মুখ্য বিষয় হচ্ছে উল্লিখিত ঘটনাটিতে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে। পুলিশের ভূমিকা নিয়ে জনমনে একবাক্যে বলা যায় অতি বিরূপ ধারণা। এর সংগত কারণও আছে। তথাপি পুলিশের ভূমিকা ছিল মিশ্র। একদিকে থানা বা জেলা পুলিশ, অন্য পাশে পিবিআই। আমরা ঘটনার শুরু থেকে সোনাগাজী থানার ওসির ভূমিকার দিকে নজর দেব। অপ্রিয় হলেও সত্য, এলাকার প্রভাবশালী কুনাগরিকদের সঙ্গে কোনো কোনো থানার ওসির একটা বোঝাপড়া বা বন্ধুত্ব থাকে। সোনাগাজীর ওসিও ওই দলের। নুসরাত যখন তার মাসহ থানায় অভিযোগ নিয়ে যায় তখন ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৪ এবং পিআরবির বিধি ২৪৪ অনুসরণ করে ওসি যদি একটি এজাহার রেকর্ড করতেন, তাহলে এই মোয়াজ্জেম আজ দেবতার অবস্থানে থাকতেন।
এ ক্ষেত্রে তাঁর হাতে দুটি অপশন থাকত—১. তদন্ত করে চার্জশিট দেওয়া। ২. অন্তরালে একটি মীমাংসার ব্যবস্থা করা। আইনে না থাকা এবং অপ্রয়োজনীয় হওয়া সত্ত্বেও ওসি নুসরাতের আপত্তিকরভাবে ভিডিও করলেন। ভিডিও করার সময় মেয়েটি আপত্তি করায় এটি প্রকাশ করা হবে না বলে আশ্বস্ত করেন। আইনে না থাকলেও যদি সৎ উদ্দেশ্যে এবং মেয়েটির সহজ সম্মতিতে করলেও এটি হতো আদালতের সম্পদ। ভাইরাল করার সুযোগ ও ক্ষমতা তো আদালতেরও নেই। বাস্তবে সেই রেকর্ড করা ভিডিওটি ওসি মোয়াজ্জেমের মোবাইল ফোন থেকে ভাইরাল হয়েই যায়। ওসি অবশ্য বলার চেষ্টা করেছেন, তিনি নামাজে বসলে কোনো সাংবাদিক এটি করে থাকেন। কে করলেন বড় নয়, ওসির মোবাইল ফোন থেকে ভাইরাল হয়েছে, এটি সত্য।
কারো কারো মতে, ওসি নুসরাতকে চাপে ফেলে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য এটি করেছিলেন। কেন অবাঞ্ছিত কাজটি করেছিলেন, সেটির ব্যাখ্যা তিনিই দিতে পারবেন। বাস্তবে তাঁর কোনো ব্যাখ্যাই আইনে আবৃত হবে না। ফলে তাঁকে সুরক্ষাও দেবে না। এই ওসির উদ্দেশ্যমূলক কাজটি তাঁকে আইনের আওতায় নিয়ে আসে। ওসির আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে ব্যারিস্টার সুমন বাদী হয়ে সরাসরি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সংশ্লিষ্ট আদালতে মামলা করেন। আদালত পিবিআইকে মামলাটির তদন্তভার অর্পণ করেন। ২৭ মে ২০১৯ তারিখে আদালত থেকে ওসিকে গ্রেপ্তারের জন্য ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়। অনেক বিলম্বে পুলিশ ওসি মোয়াজ্জেমকে শাহবাগ থানায় আটক করে এবং পরদিন ফেনী পুলিশ তাঁকে আদালতে সোপর্দ করে ওয়ারেন্টটি তামিল করে।
সেই থেকে মোয়াজ্জেম জেলহাজতে ছিলেন। জামিনের আবেদন উচ্চ আদালত নামঞ্জুর করেন। শুনানির পর গত বৃহস্পতিবার মামলাটির রায় ঘোষিত হয়। এ ধরনের মামলায় এটিই সম্ভবত প্রথম রায়। আট বছরের জেলসহ ১৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। জরিমানার টাকা পরিবারকে দিতে হবে। অনাদায়ে আরো এক বছরের জেল।
ওই আইনের তিনটি ধারায় অভিযোগ আনা হয়। বিচারে একটি ধারা প্রমাণিত হয়নি বলে বিজ্ঞ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মন্তব্য করেন। অন্য দুটি ধারা প্রমাণিত হওয়ায় যথাক্রমে পাঁচ বছর এবং তিন বছরের জেল দেওয়া হয়। বিজ্ঞ বিচারক নুসরাত হত্যা মামলায় ওসির সংশ্লিষ্টতা প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য করেননি। রায়ের পর বাদী তাঁর প্রতিক্রিয়ায় জানান, থানার ওসিরা যে আইনের ঊর্ধ্বে নন, তা প্রমাণিত হলো। তিনি আরো মন্তব্য করেন, ওসিকে মূল হত্যা মামলার দণ্ডবিধির ৩৪ ধারার আওতায় আনলে যথাযথ হতো। নুসরাতের পরিবার তাত্ক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি।
ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে রায়ের ব্যাপারে মিশ্র মতামত পাওয়া যায়। মহিলারা মনে করে, সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলে যথাযথ হতো। অন্য দল মনে করে, সাজা অনেক কঠোর হয়েছে। তিন থেকে ছয় মাসের একটি টোকেন কারাদণ্ড দিলেই হতো। মতামত যা-ই আসুক, এই রায়ের দ্বারা একটি মেসেজ পুলিশ তথা থানার ওসিদের কাছে গেছে যে বেআইনি, অবৈধ, অপরিণামদর্শী কাজ তাঁদের যেকোনো সময় বিপদগ্রস্ত করতে পারে। জনগণ এবং আইনমুখী কাজে যেন তাঁরা নিয়োজিত থাকেন ও আইনবিরুদ্ধে কাজ থেকে বিরত থাকেন। জেলার পুলিশ সুপাররা ৫৫১ সিআরপিসি মোতাবেক সব থানার ওসি। তিনি যেন তাঁর অধীনদের কথা বা কাজের দ্বারা বিভ্রান্ত না হন। পুলিশের পরিচালকরা রায়টির প্রতি গুরুত্ব দেবেন, সেটি জনগণ প্রত্যাশা করে।
প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে ইদানীং মানুষের অনেক ব্যক্তিগত বিষয় ভাইরাল হচ্ছে। জামালপুরে সাবেক ডিসি আলী কবীরের ভিডিও ভাইরালের বিষয় উল্লেখ করা যায়। অনৈতিক কাজের জন্য শাস্তির মুখোমুখি। ভিডিও করে যে ভাইরাল করল, তাকে খুঁজে বের করার কোনো উদ্যোগ নেই। এই ভাইরাল ব্যাধি বন্ধ করার জন্য এখন ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে এটি ভয়াবহ রূপ নেবে, তা নিশ্চিত বলা যায়।
জনমনে পুলিশ সম্পর্কে যে ঢালাও বিরূপ ধারণা আছে, সেটিরও পরিবর্তন আসা দরকার। থানার পুলিশের বেআইনি কাজের বিপরীতে পিবিআইয়ের ভালো কাজগুলোও মূল্যায়ন করা দরকার। থানাগুলোতেও অনেক ভালো ওসি আছেন, তাঁদের মঙ্গলজনক কাজগুলো যাতে বহুলভাবে প্রশংসতি হয়, সেটি নিশ্চিত করা দরকার।
লেখক : মো. নূরুল আনোয়ার, সাবেক আইজিপি।