ভিসিকে সভ্যতা-ভব্যতার সীমারেখা জানতে হবে - দৈনিকশিক্ষা

ভিসিকে সভ্যতা-ভব্যতার সীমারেখা জানতে হবে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উপাচার্য ফারজানা ইসলামের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর গত মঙ্গলবার হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। হামলায় শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সাংবাদিকসহ ৩৫ জন আহত হয়েছেন। হামলার ঘটনার পর এক জরুরি সিন্ডিকেট সভায় অনির্দিষ্টকালের জন্য জাবি বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীরা হল ত্যাগ করেননি। তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ছাত্রলীগ বলছে, আন্দোলনকারীরা শিবিরকর্মী। জাবি উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানোর জন্য ছাত্রলীগকে ধন্যবাদ জানান। ছাত্রলীগের হামলাকে তিনি ‘গণঅভ্যুত্থান’ আখ্যা দেন। রোববার (১০ নভেম্বর) সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও বলা হয়, জাবি ভিসির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর থেকেই সাধারণ শিক্ষার্থীরা তার পদত্যাগ দাবি করে আসছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকও তাদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা যে ন্যক্কারজনক হামলা চালিয়েছে আমরা তার তীব্র নিন্দা জানাই। হামলার সঙ্গে জড়িত ছাত্রলীগের প্রতিটি ক্যাডারকে চিহ্নিত করে কঠোর বিচার করার দাবি জানাই।

ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পেটোয়া বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি দেখা গেছে, যখনই কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কোন দাবি নিয়ে আন্দোলন করছেন তখনই তাদের ওপর হামলা চালাচ্ছে ছাত্রলীগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও যদি শিক্ষার্থীরা কোন আন্দোলন করে তখনও তাদের ওপর হামলা চালানো হয়। কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে হওয়া ছাত্র আন্দোলনে তারা হামলা চালিয়েছে। এসব হামলার একটি ঘটনারও বিচার হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিচার করার পরিবর্তে তাদের পিঠ চাপড়ে দিয়েছে। জাবি উপাচার্যও ব্যতিক্রম নন। তিনি একটি পেটোয়া বাহিনীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মেরে যারা আহত করেছে তাদের তিনি ধন্যবাদ জানিয়েছেন। এরপর তিনি জাবির উপাচার্য থাকেন কীভাবে, সেটা ভেবে আমরা বিস্মিত হই।

এ ঘটনার অনেক আগেই হয়ত যারা দায়িত্বশীল, যারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তাদের দৃষ্টিগোচর হলে এটিকে একটি সমাধানের দিকে নিয়ে যাওয়া যেত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এটা যেন সাধারণ প্রবণতাই হয়ে গেছে যে, কোন সমস্যার চূড়ান্ত অবনতি না ঘটলে এর ভেতরে হস্তক্ষেপ করা হবে না। এমনকি বিষয়টাকে এক ধরনের পরাজয় হিসেবেই গন্য করা হয়। কিন্তু সেটাই কি সমাধানের কৌশল হওয়া উচিত?

জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি যে এক কোটি ষাট লাখ টাকা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ শাখার কাছে হস্তান্তর করেছেন সেটা তো ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরাই গলা উঁচু করে সাংবাদিকদের বলেছেন। সেসবের ভিডিও গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। কারা কারা ছিলেন এ বিতরণের মধ্যে, কারা কারা পেয়েছেন এবং যারা যারা পেয়েছেন তারা অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা পর্যন্ত বলেছেন যে, এত টাকা দেয়া হয়েছে। এরপরও ঘটনা তদন্তে কোনরকম ব্যবস্থা নেয়া হল না কেন? এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি-প্রভিসিরা একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হচ্ছেন, তাহলে তারা কী করে বা কোন যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত হচ্ছেন? সেই নিয়োগ প্রক্রিয়ার মধ্যে কী আছে? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কী করে অপরাজনীতির মধ্যে জড়াচ্ছেন?

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিন্নমত অবলম্বনকারী শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ যা করেছে সেটা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। একটি সভ্য সমাজে এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। আমরা জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় বা গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যদি দেখার চেষ্টা করি, প্রফেসর ফারজানা ইসলামের ভেতর দিয়ে যদি অন্য উপাচার্যদের দেখার চেষ্টা করি, তাদের আচার-আচরণে কী খুব একটা অমিল পাওয়া যায়? এর কারণ কী কেউ খতিয়ে দেখেছে?

জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের বিরুদ্ধে যখন অভিযোগ উঠল তখন এটাও তো হতে পারত যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ জায়গা থেকে উনি নিজেই এ ব্যাপারে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি করেননি। বরং আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক বা ভিসিকে বলতে শুনছি, ছাত্রলীগ যে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ করল এটি তার জন্য আনন্দের দিন। আজ তিনি গণঅভ্যুত্থান দেখেছেন। ভেবে দেখার অবকাশ থাকে যে, আমাদের নৈতিকতার মান কোথায় নামলে একজন উপাচার্য এই ভাষায় কথা বলতে পারেন। কোন শিক্ষাঙ্গনের জন্য কত বড় একটি নৈতিক অধঃপতন যে, ভিসিকে ছাত্রলীগের কাছে আশ্রয় নিতে হয়।

জাহাঙ্গীরনগরে যে আন্দোলনটা হচ্ছে সেটা কী শুধুই ভিসিবিরোধী আন্দোলন? কিংবা গোপালগঞ্জে যেটা হয়েছিল সেটাও কী শুধুই ভিসিবিরোধী? কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীদের ব্যানারে যখন আন্দোলন হয়েছিল সেটাও কী তেমনই কোন প্রতিবাদ? না। জাহাঙ্গীরনগরের আন্দোলনটি প্রমান করেছে এটা অনৈতিকতার বিরুদ্ধে লড়াই। অভিযোগ এসেছে, ভিসি নিজে চাঁদাবাজির টাকা বিতরণ করেছেন। এক্ষেত্রে এ প্রশ্নও তো উঠতে পারে যে, উনি কি ভিসি নাকি কন্ট্রাক্টার। হয়ত এমনও হতে পারে, যে ঘাটে পানি দিলে চলাচল মসৃণ হয় সে ঘাটে পানি দিচ্ছেন বলেই তিনি শিক্ষক এবং সাধারণ শিক্ষার্থীর উপর বলপ্রয়োগের সাহস পান।

ব্যক্তির পরিবর্তন সমস্যার সমাধান নয়। কিন্তু আশু সমাধান ব্যক্তির পরিবর্তন। ফারজানা ইসলামের উচিত ছিল, এই অভিযোগ ওঠার পরে নিজ থেকে এই পদ থেকে সরে যাওয়া। এবং বলা যে, তদন্ত হোক তদন্তে যদি তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ প্রমাণিত না হয় তবে তিনি আবার স্বপদে ফিরে আসবেন। এটিই তো আমরা একজন বিবেকবান মানুষের কাছে প্রত্যাশা করি। এই সভ্যতা-ভব্যতা থেকে যে বাংলাদেশ সরে গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা গত কয়েকমাস ধরেই সেটা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে যাচ্ছেন।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে অথর্ব, অযোগ্য এবং দুর্নীতিবাজ উপাচার্যের পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু কোথাও প্রশাসনের কাঠামো বদলায়নি। ফলে ব্যক্তির পরিবর্তন হলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমস্যার ঘেরাটোপে ঘুরপাক খাচ্ছে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাজেট বেড়েছে। কিন্তু সে বাজেট বাস্তবায়নের দায়বদ্ধতা, দক্ষতা ও সক্ষমতা বেড়েছে কী? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই যদি বলি, ভেবে দেখুন, ১৪০০ কোটি টাকা যদি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন বাজেট হয় সেখানে ব্যবস্থাপনাগত যে দক্ষতা থাকা দরকার, স্বচ্ছতা থাকা দরকার, অংশগ্রহণমূলক এবং পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের দিকে যাওয়া দরকার তার কোন ছিটেফোঁটাও কী আছে? কেউ এব্যাপারে সাফাই গাইতে পারবেন? কাজেই এক্ষেত্রে যদি শুধু সংকটটাকেই উপজীব্য করে সমাধান খোঁজার চেষ্টা করা হয় তবে সেটা ভুল হবে। বিষয়টিকে সামগ্রিকতার মাপকাঠিতেই মাপতে হবে। সমস্যার গভীরে পৌঁছে এ থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে। এখন যারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন, তাদের হাতে কিন্তু মৌলিক কাঠামো পরিবর্তনের ক্ষমতা নেই। তাদের কিন্তু চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর সুযোগ আছে যে, মৌলিক কাঠামোর সমস্যা কী, উপাচার্য নিয়োগ কিংবা মনোনয়নের পদ্ধতিগত জটিলতাগুলো কি এবং তারপরে তাদের যে যোগ্যতা এবং মেধা থাকার কথা সেখানে যদি ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা থাকে সে দুর্বলতাগুলো কোথায়?

প্রথমেই বলতে হবে, কোন একটি ছাত্র সংগঠনকে ভিসি তার স্বপক্ষে গুন্ডামি-পান্ডামি বা শক্তি প্রদর্শনের জায়গায় ব্যবহার করা অন্যায় কীনা? সে অন্যায়ের জন্য তিনি শাস্তিপ্রাপ্ত হবেন কীনা কিংবা তিনি তার কৃতকর্মের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে তিরস্কৃত হবেন কিনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীদের ছাত্রলীগ দ্বারা নির্মমভাবে পেটানোর পর সেটি করা হয়নি। ফলে একই অপকর্ম দানা বাধছে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। যদি জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়টিকেও পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয় তবে সেটির মাত্রা আরও বাড়বে।

সমস্যাটা শুধু ভিসির মধ্যে না, সমস্যাটা শুধু ছাত্রদের মধ্যে না, সমস্যাটা সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেই। যতক্ষণ পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক অধঃপতন ঠেকানো যাচ্ছে না ততক্ষণ পর্যন্ত কোনকিছুতেই পরিবর্তন আসবে না।

খন্দকার মুনতাসীর মামুন : সাংবাদিক।

প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0058290958404541